বাজেট প্রতিক্রিয়া ২০১৭-১৮ প্রস্তাবিত বাজেট: অধিকাংশ তামাকপণ্যের প্রকৃত মূল্য কমবে- বাড়বে মৃত্যু

১০ জুন ২০১৭, শনিবার, জাতীয় প্রেসক্লাবের ভিআইপি লাউঞ্জে প্রজ্ঞা (প্রগতির জন্য জ্ঞান) ও এন্টি টোব্যাকো মিডিয়া এলায়েন্স -আত্মা’র উদ্যোগে তামাকবিরোধী সংগঠন ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন, ঢাকা আহছানিয়া মিশন, এসোসিয়েশন ফর কমিউনিটি ডেভেলপমেন্ট (এসিডি), এইড ফাউন্ডেশন, ডব্লিউবিবি ট্রাস্ট, ইয়ং পাওয়ার ইন সোশ্যাল একশন (ইপসা), টোব্যাকো কন্ট্রোল এন্ড রিসার্চ সেল (টিসিআরসি) এবং তামাকবিরোধী নারী জোট (তাবিনাজ) সম্মিলিতভাবে তামাক কর বিষয়ক বাজেট পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে। সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন ড. রুমানা হক, অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। সংবাদ সম্মেলনে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ, চেয়ারম্যান, পল্লী কর্ম সহায়ক ফাউন্ডেশন (পিকেএসএফ)। বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) এর সাবেক সদস্য (ট্যাক্স পলিসি) মো: আমিনুর রহমান। ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন অব বাংলাদেশ এর প্রতিষ্ঠাতা জাতীয় অধ্যাপক ব্রিগেডিয়ার (অব:) আব্দুল মালিক সভাপতিত্ব করেন। এটিএন বাংলার প্রধান প্রতিবেদক ও এন্টি টোব্যাকো মিডিয়া এলায়েন্স- আত্মা’র কো-কনভেনর নাদিরা কিরণ এর সঞ্চালনায় সংবাদ সম্মেলনে আরো উপস্থিত ছিলেন তামাকবিরোধী সংগঠন ও দাতা সংস্থার প্রতিনিধিবৃন্দ।

সংবাদ সম্মেলনে ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ বলেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা সত্ত্বেও প্রস্তাবিত বাজেটে তামাকের কর কাঠামো সহজ করার পরিবর্তে সিগারেটের নতুন মূল্যস্তর সৃষ্টি করার মাধ্যমে কর কাঠামোকে আরও জটিল করা হয়েছে। এতে কর ফাঁকির প্রবণতা বৃদ্ধি পাবে। সুতরাং চূড়ান্ত বাজেটে মূল্যস্তর প্রথা বিলুপ্তির দাবি জানান তিনি। এছাড়াও তিনি বলেন, টেকসই উন্নয়নের জন্য সুস্বাস্থ্য অন্যতম শর্ত, আর এজন্য তামাক নিয়ন্ত্রণ অতীব জরুরি। মো: আমিনুর রহমান বলেন, নতুন মূল্যস্তর সৃষ্টি করার ফলে উদ্ভূত জটিলতা মোকাবেলা এবং কর আহরণে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে অনেক বেশি বেগ পেতে হবে। এরফলে লাভবান হবে তামাক কোম্পানি। চূড়ান্ত বাজেটে বিষয়টি পূনর্বিবেচনার আশা ব্যক্ত করেন তিনি এবং একই সাথে এনবিআরের টোব্যাকো ট্যাক্স সেলকে সক্রিয় করার তাগিদ জানান তিনি। জাতীয় অধ্যাপক ব্রিগেডিয়ার (অব:) আব্দুল মালিক বলেন, তামাকজনিত ক্ষতি কমিয়ে আনতে আমাদের প্রতিরোধ ব্যবস্থা শক্তিশালী করা প্রয়োজন, এজন্য তামাকের উপর কর বৃদ্ধি উৎকৃষ্ট পন্থা।

উল্লেখ্য, ২০১৭-১৮ অর্থবছরের বাজেটে জটিল বহুস্তরভিত্তিক এডভ্যালোরেম পদ্ধতির পরিবর্তে সকল তামাকপণ্যে সুনির্দিষ্ট কর আরোপ করার দাবি করা হলেও প্রস্তাবিত বাজেটে এর কোনো প্রতিফলন নেই। বরং সিগারেটের সর্ব নিম্নস্তর ভেঙ্গে দেশি এবং আন্তর্জাতিক ব্রান্ড নামে দুটি স্তরে বিভক্ত করে তামাক কর-কাঠামোর জটিলতা আরও বৃদ্ধি করা হয়েছে। দেশি ব্রান্ডের প্রতি ১০ শলাকা সিগারেটের সর্বনিম্ন মূল্য ২৩ টাকা থেকে বাড়িয়ে ২৭ টাকা এবং সম্পূরক শুল্ক মাত্র ২ শতাংশ বৃদ্ধি করে ৫২ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে। এই বৃদ্ধির হার বিগত অর্থবছরের তুলনায় কম। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে এইস্তরের সিগারেটের সর্বনিম্ন মূল্য ২৮ শতাংশ বৃদ্ধি করা হলেও এবার ১৭.৪ শতাংশ মূল্য বৃদ্ধির প্রস্তাব করা হয়েছে। অন্যদিকে, আন্তর্জাতিক ব্রান্ডের প্রতি ১০ শলাকা সিগারেটের সর্বনিম্ন মূল্য ৩৫ টাকা নির্ধারণের প্রস্তাব করা হয়েছে। কিন্তু বাজেট ঘোষণা হওয়ার পরের দিন বহুজাতিক তামাক কোম্পানি ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো কোম্পানি (বিএটিবি) তাদের উৎপাদিত নিম্নস্তরের ১০ শলাকা সিগারেটের মূল্য ২৭ টাকা উল্লেখ করে গণমাধ্যমে বিজ্ঞাপন প্রকাশ করেছে, যার সাথে মাননীয় অর্থমন্ত্রীর এ সংক্রান্ত বাজেট বক্তৃতার কোন মিল নেই। বহুজাতিক তামাক কোম্পানির সিগারেট নিম্নস্তরের সিগারেটের বাজার দখল করছে বিধায় দেশি সিগারেট কোম্পানিকে সুরক্ষা দিতেই এই স্তর বিভাজন বলে অর্থমন্ত্রী তার বাজেট বক্তৃতায় উল্লেখ করেছেন।

প্রস্তাবিত বাজেটে সিগারেটের উচ্চ এবং প্রিমিয়াম স্তরের মূল্য এবং করহার অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে। জনগণের মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি এবং মূল্যস্ফীতির ফলে ভোক্তা পর্যায়ে এই দুই স্তরের সিগারেটের প্রকৃত মূল্য হ্রাস পাবে। প্রস্তাবিত বাজেটে সবচেয়ে বেশি লাভবান হবে বহুজাতিক তামাক কোম্পানি বিএটিবি, যাদের উৎপাদিত ১৫টি ব্রান্ডের মধ্যে ১০টিই উচ্চ ও প্রিমিয়াম স্তরের সিগারেট।

প্রস্তাবিত বাজেটে ধোঁয়াবিহীন তামাকজাত পণ্য, জর্দা ও গুলের উপর কর বাড়ানো হয়নি। দেশে অর্ধেকেরও বেশি তামাক ব্যবহারকারী ধোঁয়াবিহীন তামাক (জর্দা ও গুল) সেবন করেন অর্থাৎ বাংলাদেশের ৪ কোটি ১৩ লক্ষ তামাক ব্যবহারকারীর মধ্যে ২ কোটি ৫৯ লক্ষই ধোঁয়াবিহীন তামাক ব্যবহারকারী। আমাদের দেশে দরিদ্র জনগোষ্ঠী বিশেষতঃ নারীদের মাঝে এই পণ্য ব্যবহারের প্রবণতা সবচেয়ে বেশি। এই বিশাল জনগোষ্ঠীকে জর্দা-গুল ব্যবহারের স্বাস্থ্যঝুঁকি থেকে রক্ষা করার কোনো উদ্যোগ প্রস্তাবিত বাজেটে নেই, যা অত্যন্ত হতাশাজনক।

প্রস্তাবিত বাজেটে ফিল্টারবিহীন ২৫ শলাকা এবং ফিল্টারযুক্ত ২০ শলাকার বিড়ির প্যাকেটের দাম ১৫ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। একইসাথে বিড়ির প্রচলিত ট্যারিফ ভ্যালু বিলুপ্ত করা হয়েছে। এরফলে বিড়ির কর আদায়ের জটিলতা কিছুটা হলেও সহজ হবে। মাননীয় অর্থমন্ত্রী তার বাজেট বক্তৃতায় আগামী ৩ বছরের মধ্যে বিড়ি উৎপাদন বন্ধ করার ঘোষণা দিয়েছেন, কিন্তু বিড়ির উপর করহার এবং মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাবে এর তেমন কোনো প্রতিফলন নেই। কেননা, ২০১৬-১৭ অর্থ বছরে করারোপের মাধ্যমে বিড়ির মূল্য প্রায় ৫০ শতাংশ বাড়ানো হলেও এবারের প্রস্তাবে মূল্যবৃদ্ধি হবে মাত্র ৪১.৩৮ শতাংশ। এছাড়া সম্পূরক শুল্ক অপরিবর্তিত রেখে কার্যত বিড়ি মালিকদের সুবিধা দেয়া হয়েছে প্রস্তাবিত বাজেটে।

ই-সিগারেট ও এর রিফিল প্যাকের উপর ১০০ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক আরোপ, তামাক ও তামাকজাত পণ্য রপ্তানি শুল্ক ১০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ২৫ শতাংশ নির্ধারণ এবং সকল তামাকজাত পণ্য প্রস্তুতকারী করদাতার উক্ত ব্যবসায় হতে অর্জিত আয়ের উপর ২.৫ শতাংশ হারে সারচার্জ আরোপের প্রস্তাব প্রশংসনীয় উদ্যোগ।

সংবাদ সম্মেলনে ২০১৬-১৭ সালের চূড়ান্ত বাজেটে অন্তর্ভুক্তির জন্য নিম্নোক্ত প্রস্তাবনাসমূহ তুলে ধরা হয়:

প্রস্তাবনাসমূহ
১. সিগারেট (১০ শলাকার প্যাকেট): নিম্নস্তরের সিগারেটে ২৫.৯৫ টাকা, উচ্চস্তরের সিগারেটে ৪৯.৬০ টাকা এবং প্রিমিয়াম স্তরের সিগারেটে ৮২ টাকা সুনির্দিষ্ট কর ধার্য করে খুচরা মূল্য যথাক্রমে কমপক্ষে ৪০ টাকা, ৭০ টাকা এবং ১২০ টাকা নির্ধারণ করা;
২. বিড়ি (২৫ শলাকা): বিড়ির ফিল্টারযুক্ত ও ফিল্টারবিহীন এই বিভাজন বাতিল করে প্রতি ২৫ শলাকা বিড়ির উপর ১০.১৩ টাকা সুনির্দিষ্ট কর আরোপ করে বিড়ির খুচরা মূল্য ২২.৩০ টাকা নির্ধারণ করা;
৩. ধোঁয়াবিহীন তামাকপণ্য (জর্দা ও গুল): প্রতি ২০ গ্রাম ওজনের ধোঁয়াবিহীন তামাকপণ্যে ১৬ টাকা সুনির্দিষ্ট কর আরোপ করে এসআরও এর মাধ্যমে এর খুচরা মূল্য কমপক্ষে ৩২ টাকা নির্ধারণ করা;
৪. তামাকপণ্যের উপর ২% স্বাস্থ্য উন্নয়ন সারচার্জ আরোপ করা। এখান থেকে অর্জিত রাজস্ব মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা মোতাবেক জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি পরিচালনায় ব্যয় করা;

অর্থ বাণিজ্য