খেলাপি ঋণ আড়াল করতে বিশেষ ছাড়ে ঋণ নবায়নের হিড়িক পড়েছে ব্যাংকিং খাতে। মাত্র ছয় মাসে এমন প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকার খেলাপি ঋণ নবায়ন করা হয়েছে। এর সাথে চলছে শূন্য সুদে ঋণ পুনর্গঠন। বিশ্লেষকদের মতে, এসব ঋণ আদায় না হয়েও ব্যাংকিং খাতে আদায় দেখানো হচ্ছে। এতে এর বিপরীতে প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হচ্ছে। খেলাপি ঋণ আড়াল হয়ে যাচ্ছে, বিপরীতে স্ফীত হচ্ছে আয়। আর এ আয়ের ওপর ভিত্তি করেই নগদে লভ্যাংশের নামে ব্যাংক থেকে অর্থ বের করে নেয়া হচ্ছে। অপর দিকে, তহবিল সংগ্রহ ব্যয় কমছে না; বরং নির্ধারিত মেয়াদ শেষে আমানতকারীদের অর্থ সুদে-আসলে পরিশোধ করতে হচ্ছে। এতে ব্যাংকিং খাতে প্রকৃত আয় যেমন কমছে, তেমিন এভাবে চলতে থাকলে এক সময় এসে তহবিল ব্যবস্থাপনায় বিশৃঙ্খলা হওয়ার আশঙ্কা করছেন তারা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, গত ছয় মাসের মধ্যে শুধু সেপ্টেম্বর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত তিন মাসে খেলাপি ঋণ নবায়ন হয়েছিল আট হাজার ৪২ কোটি টাকা। পরের তিন মাসে প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে সরকারি ব্যাংকগুলোর চেয়ে বেসরকারি ব্যাংকগুলোই সবচেয়ে বেশি ঋণ নবায়ন করেছে। যেমন প্রথম তিন মাসে আট হাজার ৪২ কোটি টাকার মধ্যে প্রায় ছয় হাজার ২০০ কোটি টাকাই ছিল বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর। বাকি অর্থ ছিল সরকারি, বিশেষায়িত ও বিদেশী ব্যাংকগুলোর। পরের দেড় হাজার কোটি টাকার মধ্যে এক হাজার ১২ কোটি টাকা বেসরকারি ব্যাংকগুলোর। আর অন্য ব্যাংকগুলোর ছিল সাড়ে ৩০০ কোটি টাকা। সবমিলিয়ে ১০ হাজার কোটি টাকার মধ্যে সাড়ে সাত হাজার কোটি টাকাই বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো নবায়ন করেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের এক দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জানিয়েছেন, রাজনৈতিক বিবেচনায় সরকারি ব্যাংকগুলোতে ঋণ দেয়া হয় অনেক ক্ষেত্রে। আবার ঋণ নবায়ন করাও হয় একই কারণে। এতে সরকারি ব্যাংকগুলোর ওপর একটি অদৃশ্য চাপ থাকে সবসময়ই। কিন্তু বেসরকারি ব্যাংকগুলোর এ চাপ নেই। কিন্তু এখন অনেক ক্ষেত্রেই বেসরকারি খাতের পরিচালকেরা ভাগবাটোয়ারা করে খেলাপি ঋণ নবায়ন করছেন। নিজ ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে না পারলেও অন্য ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে পারেন পরিচালকেরা। ঋণ খেলাপি হলে কোনো পরিচালক পদ হারাতে হয় ব্যাংক থেকে। ফলে এখন নিজেদের মধ্যে যোগসাজশ করেই এক ব্যাংকের পরিচালক অন্য ব্যাংক থেকে ঋণ নিচ্ছেন ও ঋণ পরিশোধ না করেই কোনো কোনো সময় ভুয়া ঋণ সৃষ্টি করে আদায় দেখাচ্ছেন। আবার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী ডাউন পেমেন্ট না দিয়েই ঋণ নবায়ন করছেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের বিভিন্ন সময় পরিদর্শনে এর একাধিক ঘটনা উদঘাটন করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
প্রশ্ন উঠেছে এভাবে কত দিন চলবে। এ বিষয়ে দেশের প্রথম প্রজন্মের একজন তহবিল ব্যবস্থাপক গতকাল নয়া দিগন্তকে জানিয়েছেন, ব্যাংকগুলোর সবচেয়ে বেশি আয় হয় বিভিন্ন খাতে ঋণ দিয়ে। আর এ ঋণের অর্থ আসে আমানতকারীদের কাছ থেকে। আমানতকারীরা ব্যাংকে যে পরিমাণ অর্থ জমা রাখেন তার একটি অংশ ব্যাংক হাতে রেখে বাকি অর্থ বিনিয়োগ করে থাকে। যেমন, ১০০ টাকার আমানত নিলে ব্যাংক ১৯ টাকা নিরাপত্তা সঞ্চিতি (এসএলআর ও সিআরআর) রেখে বাকি ৮১ টাকা বিনিয়োগ করতে পারে। ১০০ টাকার আমানত ১০ বছর পরে ২০০ টাকা পরিশোধের শর্তে ব্যাংক আমানতকারীদের কাছ থেকে আমানত সংগ্রহ করল। কিন্তু যে ৮১ টাকা বিনিয়োগ করল তা যদি আদায় না হয় বা সুদ পরিশোধ না করা হয় তাহলে ব্যাংকের নিট আয় না হয়ে বরং নিট লোকসানের সম্মুখীন হবে। কারণ কারসাজির মাধ্যমে ঋণ আদায় না করে আদায় দেখানো হলে ১০ বছর পর ৮১ টাকাই থাকবে। তা-ও গ্রাহকের কাছে। আর ১০ বছর পর আমানতকারীকে সুদে-আসলে পরিশোধ করতে হবে ২০০ টাকা। এভাবে ব্যাংকের প্রকৃত আয় হবে ঋণাত্মক (২০০-৮১) ১০৯ টাকা। এভাবে চলতে থাকলে এক সময় আমানতকারীদের অর্থই ফেরত দিতে পারবে না ব্যাংকগুলো। তহবিল ব্যবস্থাপনায় দেখা দেবে অরাজকতা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান মতে, আলোচ্য সময়ে সবচেয়ে বেশি ঋণ নবায়ন হয়েছে ব্র্যাক ব্যাংক, ডাচ্ বাংলা ব্যাংক, বাংলাদেশ ইসলামী ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংক, মার্কেন্টাইল ব্যাংক, প্রাইম ব্যাংক, প্রিমিয়ার ব্যাংক, ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক, স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক ইত্যাদি। এর মধ্যে ছয় মাসে ইসলামী ব্যাংক একাই ঋণ নবায়ন করেছে এক হাজার ১০০ কোটি টাকা।
ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে আরো শক্ত হাতে ব্যাংকগুলোকে তদারকি করতে হবে।