বিমানবন্দর-গাজীপুর সড়ক অচল হবার আশঙ্কা

এখনই পরিকল্পনা না নিলে অদূর ভবিষ্যতে হযরত শাহজালাল (রহ.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের প্রবেশ ও বহির্গমনের একমাত্র পথটি অচল হয়ে পড়বে। সেই সঙ্গে স্থবির হয়ে পড়বে গুরুত্বপূর্ণ বিমানবন্দর-গাজীপুর সড়কও।

বিমানবন্দরের মূল প্রবেশ পথের উত্তরপাশে নির্মাণাধীন পাঁচ তারকা হোটেল ও শপিং মল চালু হলে এ দুরবস্থা সৃষ্টির আশঙ্কা করছেন নগর পরিকল্পনাবিদরা। এখনই গভীর রাতে যানজটে আটকা থাকে বিমানবন্দর সড়ক। অনেক সময় রাত ২টা-৩টার দিকেও যানজটের কারণে বিমানযাত্রীরা ফ্লাইট মিস করেন বলে অভিযোগ রয়েছে। অথচ বিমানবন্দর এলাকা যানজট মুক্ত করতে সেখানে একটি ইউলুপ নির্মাণের পরামর্শ দিয়ে আসছেন বিশেষজ্ঞরা। এ জন্য ২০০-৩০০ কোটি টাকা খরচ লাগলেও তা বাস্তবায়ন করা হচ্ছে না। এদিকে বিমানবন্দরের মূল প্রবেশ পথ ঘেঁষে বিশাল পাঁচ তারকা হোটেল, শপিং মল ও একটি তিন তারকা হোটেল নির্মাণ হতে দেখে অনেকেই প্রশ্ন করছেন, তবে কি বিমানবন্দর অচল করার ব্যবস্থা হচ্ছে? শুধু সাধারণ নাগরিকরাই নয়, নগর পরিকল্পনাবিদরাও একই রকম মনে করছেন। তারা বলছেন— অপরিকল্পিতভাবে তৈরি হওয়া এই শপিং মল ও হোটেল দুটি চালু হলে বিমানবন্দরের প্রবেশপথ যানবাহন, লোক চলাচল সবকিছু মিলিয়ে অচল হয়ে পড়বে। এমনিতেই এই আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের প্রবেশপথ সংকুচিত। শপিং মল ও দুটি হোটেল চালু হলে সারাক্ষণ যানজটে আটকা থাকবে এয়ারপোর্ট রোডসহ এ এলাকা। ফলে বিমানবন্দরে প্রবেশ ও বের হওয়া কঠিন হয়ে পড়বে। এমনকি হুমকিতেও পড়বে বিমানবন্দরের নিরাপত্তা। জানা গেছে, প্রায় ১৫ একর জমির ওপর এ প্রকল্পের কাজ হচ্ছে। কাজ অনেকটা শেষের পথে। দ্রুত উদ্বোধন করার পরিকল্পনা নেওয়া হচ্ছে। বরাদ্দ চলছে শপিং মলের দোকানও। এ বিষয়ে স্থপতি ফয়েজউল্লাহ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন—আমাদের দেশে সুশাসন, জাবাবদিহিতা এবং অব্যবস্থাপনার অভাব রয়েছে। এ কারণেই বিমানবন্দরের ভিতরে ও বাইরের এমন বেহাল দশা। পৃথিবীর কোনো দেশে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর এলাকায় এমন অব্যবস্থাপনা নেই। বিমানবন্দরের ভিতরের নিরাপত্তা, সাজসজ্জা থেকে শুরু করে আসা-যাওয়ার পথে ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা লক্ষ্য করা যায়। তিনি বলেন, পাশের দেশ ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লির ইন্দিরা গান্ধী বিমানবন্দরের চিত্র সুন্দর ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে পাল্টে দিয়েছে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান। আমরা এটা থেকে শিক্ষা নিতে পারি। এখনই বিমানবন্দরের সামনের সড়ক রাত-দুপুরে ঘণ্টার পর ঘণ্টা যানজটে আটকা থাকে। আর বড় বড় হোটেল, শপিং মল চালু হলে যানজট কী প্রকট আকার ধারণ করবে তা এখনই অনুমান করা যায়। বিশ্লেষকদের মতে, বিমানবন্দর এলাকায় সকাল-সন্ধ্যা শুধু নয়, গভীর রাতেও যানজটের কারণে চলাফেরা করা যায় না। এরপরও এ এলাকায় অপরিকল্পিতভাবে তৈরি হচ্ছে শপিং মল, পাঁচ তারকা ও তিন তারকা দুটি হোটেল। এই আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে এমনিতেই গাড়ি পার্কিংয়ের স্থান পর্যাপ্ত নয়। যে প্রকল্পে হোটেল ও মল তৈরি হচ্ছে সেই জায়গাটি বর্ধিত পার্কিং স্লট তৈরি করা যেত। কিন্তু তা না করে অপরিনামদর্শী পরিকল্পনার মাধ্যমে সেখানে বানানো হচ্ছে বিশাল হোটেল ও মল। আর এই হোটেল ও শপিং মল চালু হলে শুধু বিমানবন্দরের প্রবেশ ও বহির্গমন পথ বন্ধ হয়ে যাবে না, ভবিষ্যতে তা সরকারের জন্য গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়াতে পারে। তখন পরিত্যক্ত করা হতে পারে ঢাকা শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, ইপকো প্রকল্পের আওতায় বিমানবন্দরের প্রবেশপথের উত্তর পাশে নির্মাণ করা হচ্ছে বিশাল পাঁচ তারকা হোটেল। একই প্রকল্পের আওতায় সেখানে গড়ে উঠছে ৯ লাখ বর্গফুটের একটি বৃহৎ শপিং মল। সঙ্গে আরও একটি তিন তারকা হোটেল। নিরাপত্তা শঙ্কা, যানজট ও ভবিষ্যৎ জায়গা সংকুলানের কথা চিন্তা না করে এসব প্রতিষ্ঠান নির্মাণের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন সচেতন নাগরিক ও পরিকল্পনাবিদরা। সরেজমিনে দেখা গেছে, নির্মাণাধীন হোটেল ও শপিং মলের কারণে বিমানবন্দরের সুদৃশ্য টার্মিনালের একাংশ ঢেকে গেছে। বিশেষ করে উত্তরা থেকে আসার পথে এখন বিমানবন্দরের পরিবর্তে আগে চোখে পড়ছে বিশাল এ অবকাঠামো। সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, হোটেল দুটি চালু হতে কিছু সময় লাগলেও দ্রুত শপিং মল চালু হয়ে যাবে। মলের দোকান বরাদ্দ চলছে। এদিকে বহুল আলোচিত এ প্রকল্প নিয়ে শেষ পর্যায়ে এসেও চলছে নানা সমালোচনা। দেশের প্রধানতম বিমানবন্দরের পাশে এমন অবকাঠামো নির্মাণ কেউই মেনে নিতে পারছেন না। যৌক্তিক এবং বাস্তব সমস্যার কথা তুলে ধরছেন তারা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিমানবন্দরে নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, এমন একটি বহুতল ভবনের টপ ফ্লোর থেকে কিংবা ছাদে উঠে কেউ যদি বিমান টার্গেট করে গুলি চালাতে চায়, তবে সেটি তেমন কোনো কঠিন কাজ হবে না। এ বিল্ডিংয়ের সিকিউরিটির দায়িত্ব বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষের নয়, সেহেতু বিমানবন্দরের মতো কড়া নিরাপত্তাও নিশ্চয়ই থাকবে না। বহু দেশে বিমানবন্দরভিত্তিক ফাইভ স্টার হোটেল ও শপিং মল থাকে, কিন্তু এত কম দূরত্বে গা ঘেঁষে কোথাও এমনটি দেখিনি। ট্রাফিক পুলিশের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ইপকো প্রকল্প চালু হলে বিমানবন্দরের সামনের গুরুত্বপূর্ণ সড়কে যানজট কয়েকগুণ বাড়বে। এমনিতেই এখন বিমানবন্দর সড়কের মোড়ে সারা দিন যানজট লেগেই থাকে। একদিকে বিমানবন্দর থেকে বের হন বিমানের যাত্রীরা, অন্যদিকে রাস্তার বিপরীতে বিমানবন্দর রেলস্টেশন থেকে বের হন রেলের যাত্রীরা। আছে রেলক্রসিং সিগন্যাল। এ ছাড়া বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ঢাকায় আসা-যাওয়ার প্রবেশমুখ হিসেবে ব্যবহৃত হয় এ এয়ারপোর্ট রোড। আন্তজেলা ছাড়াও মহানগরীর বিভিন্ন রুটে চলাচলকারী গণপরিবহনের চাপ তো আছেই। বিমানবন্দরের পাশেই রয়েছে বৃহৎ আবাসিক এলাকা উত্তরা। সব মিলিয়ে প্রতিদিন অসহনীয় যানজটে নাভিশ্বাস উঠে মানুষের। হিমশিম খেতে হয় ট্রাফিক পুলিশকে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, হোটেল ও শপিং মল চালু হলে মানুষ ও পরিবহনের চাপ আরও কয়েকগুণ বাড়বে। শপিং মল কিংবা হোটেলে যাওয়া-আসার জন্য প্রধান সড়ক ছাড়া বিকল্প কোনো পথের ব্যবস্থা না করায় যানবাহন ও মানুষের সমাগমে মূল সড়ক বন্ধ হওয়ার উপক্রম হবে। এতে অচল হয়ে পড়তে পারে বিমানবন্দরে যাতায়াতের স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। বিমানবন্দরে আগাগোড়াই চোরাচালান ও নিরাপত্তার ব্যাপারে প্রশ্ন রয়েছে। প্রায়ই সোনাসহ বিভিন্ন অবৈধ দ্রব্যের চোরাচালানের ঘটনা ঘটছে। এ ছাড়া সন্ত্রাসী হামলা থেকে গুরুত্বপূর্ণ এ বিমানবন্দরকে সুরক্ষার ক্ষেত্রে এত অল্প দূরত্বে এমন একটি ‘পাবলিক প্লেস’ কতখানি যৌক্তিক তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিমানবন্দরে ধারণক্ষমতার চেয়ে মাত্রাতিরিক্ত যাত্রী ও কার্গো বহন করা হচ্ছে। এশিয়া প্রশান্ত মহাসাগরীয় দেশগুলোর মধ্যে বিমান যাত্রী বৃদ্ধির শীর্ষে রয়েছে বাংলাদেশ। জানা গেছে, ২০০০ সালে এই পরিকল্পনা নেওয়া হয়। তখন ইপকো সিভিল এভিয়েশনের ১৫ একর জমির ওপর দুটি হোটেল ও একটি শপিং মল করার প্রস্তাব দেয়। এরপর বাণিজ্যিক সম্ভাবনার কথা বিবেচনা করে অগ্রাধিকারভিত্তিক প্রকল্প হিসেবে ইপকোকে জমি ভাড়া দেয় সিভিল এভিয়েশন। বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর নানা জটিলতায় কাজ বন্ধ থাকে। এরপর আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এলে ফের এটি চালু হয়। যদিও শুরু থেকেই বিপক্ষে ছিলেন সংশ্লিষ্ট অনেকেই।

জাতীয়