পাঁচ হাজার পিস ইয়াবা উদ্ধারের পর দেখানো হয় ৭৫ পিস। এসংক্রান্ত মামলায় আসামিদের আদালতে পাঠালে প্রশ্ন ওঠে, বাকি চার হাজার ৯০০ পিস ইয়াবা কোথায় গেল? পুলিশ আত্মসাৎ করেছে, নাকি অবৈধ সুবিধা নিয়ে আটককৃতদের ফেরত দিয়েছে? বিষয়গুলো জানতে রাজধানীর পল্লবী থানার ওসি দাদন ফকির ও এসআই এস এম কাওসার সুলতানকে আদালতে তলব করা হয় গত ২১ মার্চ। ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট জিয়ারুল ইসলাম এই তলব আদেশ দেন। গত ১ এপ্রিল এই দুজন আদালতে হাজির হয়ে বিষয়গুলোর ব্যাখ্যা দেন। ব্যাখ্যায় আদালত সন্তুষ্ট না হওয়ায় পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে তদন্তের নির্দেশ দেন।
গত ১৮ মার্চ গণমাধ্যমে ‘পাঁচ হাজার পিস ইয়াবা ট্যাবলেট উদ্ধারের পর মামলা হলো ৭৫ পিসের’ শীর্ষক খবর প্রকাশিত হয়। বিষয়টি আদালতের নজরে এলে আদালত এসব পদক্ষেপ গ্রহণ করেন।
আদালতের আদেশে বলা হয়, পাঁচ হাজার পিস ইয়াবাসহ মাদক কারবারি চান্দা ও অন্য তিন নারী-পুরুষকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, আসামি ফেরদৌসের কাছ থেকে ৩৯ পিস ইয়াবা এবং আসামি চান্দার কাছ থেকে ৩৬ পিস ইয়াবা (মোট ৭৫ পিস) উদ্ধার করা হয়েছে। কিন্তু মামলার এজাহার, জব্দ তালিকা ও পুলিশ প্রতিবেদনের কোথায়ও আর কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে অভিযোগ নেই। পাঁচ হাজার পিস ইয়াবা সম্পর্কেও কিছু বলা নেই।
আদালতের আদেশে আরো বলা হয়েছে, আসামিদের গ্রেপ্তারের সময় যে পরিমাণ ইয়াবা উদ্ধার করা হয়েছে তার ৫ শতাংশও জব্দ দেখানো হয়নি। চারজনকে গ্রেপ্তার করা হলেও মোটা অঙ্কের অর্থের বিনিময়ে দুজনকে ছেড়ে দেওয়া হয় বলে গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। বিষয়টি আদালতের নজরে নেওয়া হয়েছে।
আদেশে আরো বলা হয়, মামলার এজাহারকারী এসআই কাওসার সুলতান ও পল্লবী থানার ওসি দাদন ফকির অবৈধ সুবিধা নিয়ে তাঁদের কর্তব্য থেকে বিচ্যুত হয়েছেন। টাকার বিনিময়ে আসামি ছেড়ে দেওয়া, উদ্ধার করা ইয়াবার সংখ্যা কমানো, প্রকৃত ঘটনা আড়াল করে এজাহার দায়ের করার অপরাধে দুই পুলিশ কর্মকর্তা অভিযুক্ত।
রাজধানীর পল্লবীতে গত ১৭ মার্চ পাঁচ হাজার পিস ইয়াবাসহ কমিউনিটি পুলিশিং কমিটির সিনিয়র উপদেষ্টা শাহজাদার স্ত্রী, ছেলের শ্বশুরসহ চারজনকে গ্রেপ্তার করে পল্লবী থানা পুলিশ। পরে মোটা অঙ্কের অর্থের বিনিময়ে দুজনকে ছেড়ে দেওয়া হয়। অন্য দুজনের কাছ থেকে মাত্র ৭৫ পিস ইয়াবা জব্দ দেখিয়ে মামলা করা হয়।
পল্লবী থানার ওসি দাদন ফকির তাঁর বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, ‘যে কথা বলা হচ্ছে তার ১ শতাংশও সত্যতা নেই। ঘটনার দিন আমি ডিএমপিতে ক্রাইম কনফারেন্সে ছিলাম। মামলা নিয়েছে পরিদর্শক-তদন্ত। আর এখানে সমঝোতার কিছুই হয়নি। গত ১ তারিখে বিজ্ঞ আদালতে গিয়ে আমি আমার ব্যাখ্যা দিয়ে এসেছি।’
বর্তমানে মাদক নিয়ে এ রকম ঘটনা প্রায়ই ঘটছে। এতে পুলিশের দুই ধরনের লাভ হয়। বেশি পরিমাণ মাদকদ্রব্য উদ্ধার করে কম দেখিয়ে আদালতে পাঠালে আসামি জামিন পায়। শাস্তির পরিমাণও কম হয়। এর বিনিময়ে আসামির কাছ থেকে মোটা অঙ্কের অর্থ আদায় করে পুলিশ। অন্যদিকে উদ্ধার করা মাদক বিক্রি করে পুলিশ অর্থ আয় করে।
মিথ্যা মাদক মামলায় ফাঁসানোর অনেক নজির রয়েছে। নিরীহদের ধরে মাদক মামলায় জড়িয়ে দেওয়া হয়। এমন একটি ঘটনায় গত ৮ মার্চ পুলিশের হাতে ধরা পড়েন নারায়ণগঞ্জ সদর মডেল থানার এএসআই সোহরাওয়ার্দী রুবেল। তাঁর বাসা থেকে ৫০ হাজার ইয়াবা উদ্ধার করে জেলা ডিবির একটি দল। ওই বাসার কেয়ারটেকারের অভিযোগ, প্রায় সময় রুবেল বিভিন্নজনকে হাতকড়া পরিয়ে ফ্ল্যাটে এনে আটকে রাখতেন। তাঁকে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি কিছু বলতেন না। পরে জানা যায়, আটকদের অর্থের বিনিময়ে ছেড়ে দেওয়া হতো। অর্থ না দিলে মাদক মামলায় আসামি করা হতো। তাঁর বিরুদ্ধে এক ধনাঢ্য নারীকে আটকে রেখে মাদক মামলার ভয় দেখিয়ে পাঁচ লাখ টাকা আদায়ের অভিযোগও রয়েছে।
গত ২২ ফেব্রুয়ারি কুমিল্লার কোতোয়ালি মডেল থানার মালখানা থেকে মাদক সরানোর অভিযোগে দুই এসআইকে ক্লোজ করে জেলা পুলিশ লাইনসে সংযুক্ত করা হয়। এক পরিচ্ছন্নতাকর্মী মালখানার দায়িত্বে থাকা এসআই আহসান হাবীব ও এসআই তপন বকশির সহযোগিতায় মালখানা থেকে মাদকদ্রব্য সরিয়ে অন্যত্র বিক্রি করতেন। বিষয়টি নিয়ে পুলিশ প্রশাসন থেকে তদন্ত কমিটিও গঠন করা হয়।
২০১৫ সালের ২৩ জুন কক্সবাজারের মাদক কারবারিদের কাছ থেকে ইয়াবা আত্মসাতের একটি চাঞ্চল্যকর ঘটনা ধরা পড়ে পুলিশ প্রশাসনের কাছে। ওই দিন ইয়াবা আটকের পর আত্মসাৎ এবং ইয়াবা পাচারের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে কক্সবাজার ডিবির ওসিসহ ১০ পুলিশ কর্মকর্তাকে বদলি করা হয়।
ডিবি সদস্যদের বদলির কিছুদিন আগে ফেনীতে বিপুল পরিমাণ ইয়াবা উদ্ধার করা হয়। উদ্ধার করা ওই ইয়াবা কক্সবাজার ডিবির এসআই বিল্লাল হোসেনের বাসা থেকে গিয়েছিল বলে গ্রেপ্তার পুলিশের এএসআই মাহফুজ র্যাবের কাছে স্বীকার করেন। তিনি আরো ছয়জন পুলিশ সদস্যের নামও প্রকাশ করেন। স্বীকারোক্তিতে তিনি জানায়, কক্সবাজার ডিবির বহুল আলোচিত এসআই বিল্লাল হোসেন প্রতি রাতে মাইক্রোবাসে কক্সবাজার-টেকনাফ সড়ক ও সমুদ্রতীরবর্তী মেরিন ড্রাইভে যানবাহনে তল্লাশি চালাতেন। এসব তল্লাশিতে ইয়াবাসহ অন্য মাদকদ্রব্য পাওয়া গেলে ডিবির সদস্যরা তা আত্মসাৎ করতেন। আবার ইয়াবা উদ্ধার কম দেখিয়ে আটক আসামিকে আদালতে চালান দিতেন। আত্মসাৎ করা ইয়াবা বিক্রি করে দেওয়া হতো। আবার আত্মসাৎ করা ইয়াবা দিয়ে অনেক নিরীহ ব্যক্তিদের হয়রানি করা হতো।
২০১৫ সালের ১৮ ডিসেম্বর উখিয়ার মিজানুর রহমান রহমত বিন মোহাম্মদ তারেককে আটক করে মোটা অঙ্কের অর্থ দাবি করে এসআই বিল্লালের সহযোগী এসআই কামাল। দাবি করা অর্থ দিতে ব্যর্থ হওয়ায় তাকে ২০০ ইয়াবাসহ আটক দেখিয়ে আদালতে চালান করা হয়।
২০১৭ সালের ১০ আগস্ট টেকনাফে একটি মাছ ধরার ট্রলার থেকে ছয় লাখ ইয়াবা উদ্ধার করে ডিবি পুলিশ। এর মধ্যে সাড়ে পাঁচ লাখ পিস গায়েব করা হয়। এ নিয়ে তদন্তও হয়েছে।
কক্সবাজারের পুলিশ সুপার (এসপি) ড. এ কে এম ইকবাল হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, ইয়াবা আত্মসাৎ বাণিজ্যে কয়েকজন পুলিশ সদস্য জড়িত থাকার অভিযোগ পাওয়া গেছে। বিষয়টি পুলিশ সদর দপ্তরকে জানানো হয়েছে। এ নিয়ে পুলিশ সদর দপ্তর থেকে তদন্ত করা হচ্ছে। তিনি আরো বলেন, এ ধরনের ঘটনায় বেশ কয়েকজন পুলিশ সদস্যকে কক্সবাজার ডিবি পুলিশ থেকে অন্যত্র বদলি করা হয়েছে। তিনি জানান, এক ব্যবসায়ীর কাছ থেকে মুক্তিপণ দাবি করে ১৭ লাখ টাকা নিয়ে যাওয়ার সময় সেনাবাহিনীর হাতে আটক পুলিশের সাত সদস্য বর্তমানে কারাগারে আছেন। তাঁদের বিরুদ্ধে তদন্ত অব্যাহত আছে।
২০১৫ সালের ২০ সেপ্টেম্বর রাজশাহীর টাঙ্গর এলাকা থেকে ৩৫ পিস ইয়াবাসহ রতন সরকার নামে এক ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করা হয়। তার কাছ থেকে অর্থ আদায় করে অন্য মামলায় তাকে আদালতে চালান দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের এএসআই লুত্ফর রহমানের বিরুদ্ধে।
অপরাধ বিশেষজ্ঞ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. আবদুল হাকিম সরকার কালের কণ্ঠকে বলেন, মাদক কারবারি বা বহনকারীদের আটক করে মাদকদ্রব্য আত্মসাৎ করার ঘটনা আগেও ঘটেছে। এখন গণমাধ্যমে প্রকাশের কারণে অনেকে বিষয়গুলো জানছে। পুলিশের এ ধরনের অপরাধের মাত্রা বেড়েছে। পুলিশ বিভাগ একটি সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান। পেশাগত যেসব নীতিমালা রয়েছে, তা মেনে চলা প্রত্যেকের দায়িত্ব। আর ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নজরদারি থাকতে হবে অধীনরা সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করছে কি না।
বাংলাদেশ আইন ও আন্তর্জাতিক বিষয়ক ইনস্টিটিউটের গবেষণা কর্মকর্তা শাহ নেওয়াজ কালের কণ্ঠকে বলেন, পুলিশের কিছু সদস্য বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছেন। এ কারণে বিভিন্ন মাদক বহনকারীর কাছ থেকে উদ্ধার করা মাদকদ্রব্য আত্মসাতের ঘটনা ঘটছে। পুলিশের মাদক বাণিজ্যের ফলেও মাদক কারবারিরা উৎসাহিত হয়। এসব বন্ধে পুলিশের কাজে মনিটরিংব্যবস্থা থাকা প্রয়োজন।