ড্যাশিং ওপেনার তামিম ইকবালের সেঞ্চুরিতে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে তিন ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজ জিতলো বাংলাদেশ। গতরাতে ওয়ানডে সিরিজের তৃতীয় ও শেষ ম্যাচে ১৮ রানে জয় তুলে নেয় টাইগাররা। এই জয়ে তিন ম্যাচের সিরিজ ২-১ ব্যবধানে জিতলো মাশরাফি বিন মর্তুজার দল। নয় বছর পর বিদেশের মাটিতে ওয়ানডে সিরিজ জয়ের স্বাদ পেল বাংলাদেশ। সর্বশেষ ২০০৯ সালে জিম্বাবুয়ে সফরে পাঁচ ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজ ৪-১ ব্যবধানে জিতেছিলো টাইগাররা। সেই সাথে ছয় বছর পর ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ওয়ানডে সিরিজ জয়ের কৃতিত্ব দেখালো বাংলাদেশ। সর্বশেষ ২০১২ সালে দেশের মাটিতে ক্যারিবীয়দের বিপক্ষে পাঁচ ম্যাচের সিরিজ ৩-২ ব্যবধানে জিতেছিলো বাংলাদেশ।
বাসেটেরেতে টস জিতে প্রথমে ব্যাট করার সিদ্বান্ত নেন বাংলাদেশ দলপতি মাশরাফি বিন মর্তুজা। আগের দু’ম্যাচেও টস ভাগ্যে জয় পেয়েছিলেন ম্যাশ। তাই এটি ছিলো তার হ্যাট্টিক টস জয়। তবে অধিনায়কের টস জয়ের হ্যাট্টিকের দিন শান্ত মেজাজে ছিলেন আগের ম্যাচে মারমুখী রুপে শুরু করা ওপেনার এনামুল হক বিজয়। ধীরলয়ে শুরু করেন তিনি। কিন্তু বলের সাথে পাল্লা দিয়ে রান তোলার চেষ্টা করেছেন আরেক ওপেনার তামিম ইকবাল। তাই ৯ ওভার শেষে বাংলাদেশের স্কোর বিনা উইকেটে ৩৪। এসময় বিজয়ের রান ৩০ বলে ১০ ও তামিমের ২৫ বলে ২০।
তবে ১০ম ওভারের তৃতীয় বলে বিচ্ছিন্ন হয় বাংলাদেশের উদ্বোধণী জুটি। ওয়েস্ট ইন্ডিজের অধিনায়ক জেসন হোল্ডারের বলে মিড-অনে ক্যাচ দিয়ে আউট হন ৩১ বলে ১০ রান করা বিজয়।
বিজয়ের বিদায়ে আবারো একসাথে জুটি বাঁধার সুযোগ পান তামিম ও সাকিব আল হাসান। চলমান সিরিজে তিন ম্যাচেই জুটি বেধেছেন তামিম ও সাকিব। প্রথম ম্যাচে ২০৭ ও দ্বিতীয় ম্যাচে এই দু’বন্ধুর জুটিতে ৯৭ রান পায় বাংলাদেশ।
তাই তৃতীয় ম্যাচেও নিজেদের মেলে ধরতে কার্পন্য করেননি তামিম-সাকিব। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বোলারদের কপালে চিন্তার ভাঁজ ফেলে দেন তারা। বাংলাদেশের রানের চাকা সচল রেখে দলীয় স্কোর তিন অংকে পৌছে দেন তামিম-সাকিব জুটি। এরমধ্যে হাফ-সেঞ্চুরি তুলে এ ম্যাচে ভালো কিছুর ইঙ্গিত দেন তামিম। বন্ধুকে দেখে নিজের ইনিংস বড় করতে থাকেন সাকিব। কিন্তু দুর্ভাগ্য সাকিবের। ৩৭ রানেই থেমে যেতে হয় তাকে। ৪৪ বলের ইনিংসে ৩টি বাউন্ডারি মারেন বাংলাদেশের টেস্ট অধিনায়ক সাকিব। জুটিবদ্ধভাবে করেন ৮১ রান।
সাকিব ফিরে গেলে উইকেটে তামিমের সঙ্গী হবার সুযোগ পান সাবেক অধিনায়ক মুশফিকুর রহিম। কিন্তু বেশিক্ষণ উইকেটে থাকতে পারেননি তিনি। নিজেদের মুখোমুখি হওয়া সপ্তম বলেই ছক্কা মারা মুশি। এ্যাশলে নার্সের বলে বোল্ড আউট হওয়ার আগে ১৪ বলে ১২ রান করেন তিনি।
দলীয় ১৫২ রানে তৃতীয় ব্যাটসম্যান হিসেবে আউট হন মুশফিক। এরপর উইকেটে যোগ দেন মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ। তামিমের সাথে রানের চাকা ঘুড়ানোর দায়িত্ব নেন রিয়াদ। দলের স্কোর বড় করার পথে ওয়ানডে ক্যারিয়ারের ১১তম সেঞ্চুরির স্বাদ নেন তামিম। চলতি সিরিজে এটি ছিলো তামিমের দ্বিতীয় সেঞ্চুরি। অবশ্য তিন অংকে পা দিয়ে নিজের ইনিংসটি আর বড় করতে পারেননি তামিম। শেষ পর্যন্ত ১২৪ বল মোকাবেলা করে ১০৩ রানে দেবেন্দ্র বিশুর বলে আউট হন এই বাঁ-হাতি ব্যাটসম্যান। চলতি সিরিজে সর্বমোট ২৮৭ রান করা তামিম তার ইনিংসটি সাজান ৭টি বাউন্ডারি ও ২টি ওভার বাউন্ডারিতে।
দলীয় ২শ রানে তামিমের আউটে উইকেট যান অধিনায়ক মাশরাফি। এতে অনেকেই অবাকও হয়েছিলেন। সাব্বির রহমান ও মোসাদ্দেকের মত সত্যিকারের ব্যাটসম্যান থাকার পর ৩৯তম ওভারে ক্রিজে কেন মাশরাফি!
দলের রানের গতি বাড়ানোই যে তার প্রধান উদ্দেশ্যে ছিলো, সেটি পরবর্তীতে ঠিকই বুঝা গিয়েছে। ৪২তম ওভারে ওয়েস্ট ইন্ডিজের অধিনায়ক জেসন হোল্ডারের প্রথম তিন ডেলিভারিতে তিনটি চার মারেন মাশরাফি। এতে আত্মবিশ্বাস বেড়ে যায় ম্যাশের। এরপর ওয়েস্ট ইন্ডিজের বোলারদের উপর আরও চড়াও হন মাশরাফি। হোল্ডারকে টানা তিন চারের পর একটি ওভার বাউন্ডারিও মেরেছেন ম্যাশ। তবে ব্যক্তিগত ৩৬ রানেই মাশরাফিকে থামিয়েছেন হোল্ডার। ২৫ বলের ইনিংসে ৪টি চার ও ১টি ছক্কা মারেন মাশরাফি। পঞ্চম উইকেটে মাহমুদুল্লাহ সাথে ৫৩ রান যোগ করেন মাশরাফি।
অধিনায়ক ফিরে যাবার পর উইকেটে গিয়ে এবারও ব্যাট হাতে ব্যর্থ হয়েছেন সাব্বির। অবশ্য তার শুরুটা ছিলো দুর্দান্ত। ২টি বাউন্ডারিতে দ্রুত রান তোলার চেষ্টা করেন সাব্বির। তবে ৯ বলে ১২ রানের বেশি করতে পারেননি তিনি।
কিন্তু শেষদিকে বাংলাদেশকে রানের চূড়ায় বসিয়ে দেবার কাজটা দায়িত্ব নিয়েই করেছেন মাহমুুদুল্লাহ রিয়াদ। ছক্কা মেরে ওয়ানডে ক্যারিয়ারের ১৯তম হাফ-সেঞ্চুরি পূর্ণ করা রিয়াদ, শেষ পর্যন্ত ৬৭ রানে অপরাজিত থাকেন। তার ৪৯ বলের ইনিংসে ৫টি চার ও ৩টি ছক্কা ছিলো। অন্যপ্রান্তে ৫ বলে অপরাজিত ১১ রান করেন মোসাদ্দেক। ফলে ৫০ ওভারে ৬ উইকেটে ৩০১ রানের সংগ্রহ পায় বাংলাদেশ। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে এটিই বাংলাদেশের সর্বোচ্চ সংগ্রহ। শেষ ১০ ওভারে ৯৬ রান সংগ্রহ করতে পারে বাংলাদেশ। ওয়েস্ট ইন্ডিজের পক্ষে অধিনায়ক হোল্ডার ও নার্স ২টি করে উইকেট নেন।
জয়ের জন্য ৩০২ রানের টার্গেটে দেখেশুনে এগোতে থাকে ওয়েস্ট ইন্ডিজ। ওপেনার এভিন লুইস সর্তক থাকলেও ক্রিস গেইল রান তোলায় মনোযোগি ছিলেন। তাই গেইলের ব্যাটিং দৃঢ়তায় ৯ ওভার শেষেই অর্ধশতকের স্বাদ নেয় ওয়েস্ট ইন্ডিজ।
তবে ১১তম ওভারের প্রথম বলেই গেইল-লুইসকে বিচ্ছিন্ন করেন বাংলাদেশ অধিনায়ক মাশরাফি। দুর্দান্ত এক ডেলিভারিতে লুইসকে পরাস্ত করেন ম্যাশ। উইকেটের পেছনে ক্যাচ দিয়ে বিদায় নেন ৩৩ বলে ১৩ রান করা লুইস। সিরিজের প্রত্যক ম্যাচেই মাশরাফির শিকার হলেন লুইস।
এরপর দলের হাল ধরেন গেইল ও সাই হোপ। এই দু’জনে দলকে টেনে নিয়ে ১০৫ রান পর্যন্ত। এরমধ্যে ওয়ানডে ক্যারিয়ারের ৪৯তম হাফ-সেঞ্চুরি তুলে নেন গেইল। হাফ-সেঞ্চুরি তুলে আরও ভয়ংকর হবার পথে ছিলেন গেইল। তবে গেইলকে ৭৩ রানে থামিয়ে দেন বাংলাদেশের পেসার রুবেল হোসেন। ৬টি চারও ৫টি ছক্কায় ৬৬ বলে ৭৩ রান করেন বিধ্বংসী ব্যাটসম্যান গেইল।
গেইল ফিরে যাবার পর ওয়েস্ট ইন্ডিজের পালে রানের হাওয়া যুগিয়েছেন হোপ ও আগের ম্যাচের সেঞ্চুরিয়ান শিমরোন হেটমায়ার। তবে বলের সাথে পাল্লা দিয়ে রান তুলতে পারেননি তারা। বাংলাদেশের নিয়ন্ত্রিত বোলিং-এ রান তোলায় বেগ পেতে হয় ওয়েস্ট ইন্ডিজকে। তাই আস্কিং রেট গিয়ে পৌঁছায় আটে।
এ অবস্থায় ওয়েস্ট ইন্ডিজ শিবিরে তৃতীয় আঘাত হানেন বাংলাদেশের স্পিনার মিরাজ। ২টি চারে ৪২ বলে ৩০ রান করা হেটমায়ারকে শিকার বানান মিরাজ। দলীয় ১৭২ রানে হেটমায়ারের গুরুত্বপূর্ণ উইকেট তুলে নিয়ে আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠে বাংলাদেশ। এরপর দলীয় ১৭৯ রানে আরও একটি উইকেট তুলে নেয় বাংলাদেশ। পাঁচ নম্বরে নামা কাইরন পাওয়েলকে রান আউটের ফাঁেদ ফেলেন বাংলাদেশ অধিনায়ক মাশরাফি। মাত্র ৪ রান করেন পাওয়েল।
১৭৯ রানে ৪ উইকেট হারিয়ে বেশ চাপে পড়ে যায় ওয়েস্ট ইন্ডিজ। সেখান থেকে দলকে ম্যাচে ফেরানোর চেষ্টা করেন হোপ ও রোভম্যান পাওয়েল। পঞ্চম উইকেটে দু’জনের ব্যাটিং নৈপুন্যে ম্যাচে ফেরার স্বপ্ন দেখছিলো ওয়েস্ট ইন্ডিজ। কিন্তু দু’জনের পথে কাটা হয়ে দাঁড়ান বাংলাদেশ অধিনায়ক মাশরাফি। ৬৪ রান করা হোপকে বিদায় দিয়ে ম্যাচের লাগাম টেনে ধরেন ম্যাশ। এ সময় জয়ের জন্য ওয়েস্ট ইন্ডিজের ৪১ বলে ৭৮ রান প্রয়োজন ছিলো।
এ অবস্থায় উইকেটে গিয়ে ব্যাট হাতে সুবিধা করতে পারেননি স্বাগতিক অধিনায়ক জেসন হোল্ডার। ১০ বলে ৯ রান করে বাংলাদেশের কাটার মাস্টার মুস্তাফিজুর রহমানের বলে আউট হন হোল্ডার।
৪৮তম ওভারের প্রথম ষষ্ঠ ব্যাটসম্যান হিসেবে ২৬২ রানে থামেন হোল্ডার। এরপর ১৭ বল থেকে ৪০ রান দরকার পড়লেও সেটি নিতে পারেননি মারমুখী মেজাজে ক্রিজে থাকা রোভম্যান ও আট নম্বরে নামা অ্যাশলে নার্স।
২৭ বলে হাফ-সেঞ্চুরির স্বাদ নেয়া রোভম্যান শেষ পর্যন্ত ৪১ বলে ৭৪ রানে অপরাজিত থাকেন। তার বৃথা যাওয়া ইনিংসে ৫টি চার ও ৪টি ছক্কা ছিলো। অন্যপ্রান্তে ৫ রানে অপরাজিত ছিলেন নার্স। এতে ৫০ ওভার ৬ উইকেটে ২৮৩ রান পর্যন্ত যেতে পারে ওয়েস্ট ইন্ডিজ। বাংলাদেশের পক্ষে মাশরাফি ২টি, মিরাজ-মুস্তাফিজুর-রুবেল ১টি করে উইকেট নেন। ম্যাচ ও সিরিজ সেরা হয়েছেন বাংলাদেশের তামিম ইকবাল।
ওয়ানডে সিরিজ শেষে এবার তিন ম্যাচের টি-২০ লড়াইয়ে নামবে বাংলাদেশ ও ওয়েস্ট ইন্ডিজ। ৩১ জুলাই সেন্ট কিটসে অনুষ্ঠিত হবে সিরিজের প্রথম টি-২০। এরপর ৪ ও ৫ আগস্ট যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডায় হবে সিরিজের বাকি দুই টি-২০।
স্কোর কার্ড :
বাংলাদেশ ইনিংস :
তামিম ইকবাল ক পাওয়েল ব বিশু ১০৩
এনামুল হক ক পাওয়েল ব হোল্ডার ১০
সাকিব আল হাসান ক পল ব নার্স ৩৭
মুশফিকুর রহিম বোল্ড ব নার্স ১২
মাহমুুদুল্লাহ রিয়াদ অপরাজিত ৬৭
মাশরাফি বিন মর্তুজা ক গেইল ব হোল্ডার ৩৬
সাব্বির রহমান ক লুইস ব কটরেল ১২
মোসাদ্দেক হোসেন অপরাজিত ১১
অতিরিক্ত (লে বা-১, নো-১, ও-১১) ১৩
মোট (৬ উইকেট, ৫০ ওভার) ৩০১
উইকেট পতন : ১/৩৫ (এনামুল), ২/১১৬ (সাকিব), ৩/১৫২ (মুশফিকুর), ৪/২০০ (তামিম), ৫/২৫৩ (মাশরাফি), ৬/২৭৯ (সাব্বির)।
বোলিং :
কটরেল : ৯-০-৫৯-১ (ও-২, নো-১),
হোল্ডার : ১০-০-৫৫-২ (ও-২),
বিশু : ১০-১-৪২-১ (ও-২),
পল : ৯-০-৭৭-০ (ও-১),
নার্স : ১০-১-৫৩-২ (ও-২),
গেইল : ২-০-১৪-০ (ও-২)।
ওয়েস্ট ইন্ডিজ ইনিংস :
ক্রিস গেইল ক মিরাজ ব রুবেল ৭৩
এভিন লুইস ক মুশফিকুর ব মাশরাফি ১৩
সাই হোপ ক সাকিব ব মাশরাফি ৬৪
শিমরোন হেটমায়ার বোল্ড ব মিরাজ ৩০
কাইরেন পাওয়েল রান আউট (মাশরাফি) ৪
রোভম্যান পাওয়েল অপরাজিত ৭৪
জেসন হোল্ডার ক রুবেল ব মুস্তাফিজুর ৯
অ্যাশলে নার্স অপরাজিত ৫
অতিরিক্ত (লে বা-৩, ও-৮) ১১
মোট (৬ উইকেট, ৫০ ওভার ) : ২৮৩
উইকেট পতন : ১/৫৩ (লুইস), ২/১০৫ (গেইল), ৩/১৭২ (হেটমায়ার), ৪/১৭৯ (পাওয়েল), ৫/২২৪ (হোপ), ৬/২৬২ (হোল্ডার)।
বোলিং :
মাশরাফি : ১০-০-৬৩-২ (ও-১),
মিরাজ : ১০-০-৪৫-১ (ও-৪),
মুস্তাফিজুর : ১০-০-৬৩-১ (ও-১),
মোসাদ্দেক : ১-০-১০-০,
মাহমুদুল্লাহ : ২-০-২০-০,
রুবেল : ৭-০-৩৪-১,
সাকিব : ১০-০-৪৫-০ (ও-১)।
ফল : বাংলাদেশ ১৮ রানে জয়ী।
সিরিজ : তিন ম্যাচের সিরিজ ২-১ ব্যবধানে জিতলো বাংলাদেশ।
ম্যাচ সেরা : তামিম ইকবাল (বাংলাদেশ)।
সিরিজ সেরা : তামিম ইকবাল (বাংলাদেশ)।