চার বছরের গবেষণা ও মতবিনিময়ে স্বীকৃতি পাচ্ছে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী

দুই বছর আগের ঘটনা। নীরব মাহাতো (২৪) উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) দ্বারস্থ হলেন ‘ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর’ সনদের জন্য। তিনি সরকারি চাকরির জন্য আবেদন করবেন। এ জন্যই এ সনদ দরকার। সনদ পেলেন না তিনি। ইউএনওর যুক্তি, সরকারি তালিকায় মাহাতোদের নাম নেই। চাকরির পর এ নিয়ে কোনো বিতর্ক উঠলে তিনি ঝামেলায় পড়বেন।

সিরাজগঞ্জের রায়গঞ্জ উপজেলার নিমগাছিতে বাড়ি নীরবের। তিনি বলেন, ‘ইউএনওর কাছে সনদ না পেয়ে সিরাজগঞ্জের জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে ধরনা দিলাম। এই অফিস থেকেও ইউএনওর যুক্তিই তুলে ধরা হলো। আমি এখনো উপজাতির সনদ পাইনি।’

মাহাতো বাংলাদেশের অন্যতম ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী। এই ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর এক যুবককে সনদ না দেওয়ার পেছনে সরকারের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা যে যুক্তি দেখিয়ে সনদ দেননি, এর পেছনে অবশ্য যথার্থ কারণও ছিল। যেকোনো ব্যক্তির ক্ষেত্রে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর সনদ নিতে গেলে সরকারি কর্মকর্তারা যে তালিকার কথা বলেন, তা মূলত ‘ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান আইন, ২০১০’-তে থাকা একটি তালিকা। এতে যে ২৭টি জাতিগোষ্ঠীর নাম রয়েছে, সরকারি সুবিধা শুধু তারাই ভোগ করতে পারে। সরকারি কর্মকর্তারা তালিকার বাইরের আরও যেসব জাতিগোষ্ঠী আছে, তাদের সুবিধাটা আইনত দিতে পারতেন না। কারণ, কেউ চ্যালেঞ্জ করলে তাঁদের বিপাকে পড়ার আশঙ্কা ছিল। ২০১০ সালে আইনটি হওয়ার পর বাদ পড়া বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর পক্ষ থেকে প্রবল প্রতিবাদ হয়। তালিকাতে ভুলও ছিল বেশ কিছু। আর এ জন্য নীরবের মতো অসংখ্য মানুষকে ভোগান্তিতে পড়তে হয়েছে। প্রান্তিক এসব মানুষ বঞ্চিত হয়েছেন ন্যায্য অধিকার থেকে।

এবার দেশের ৫০টি ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীকে স্বীকৃতি দিচ্ছে সরকার। চার বছর ধরে গবেষণা, বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর সঙ্গে মতবিনিময় করে সরকারের সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় ৫০টি জাতিগোষ্ঠীর তালিকা তৈরি করেছে। একটি আইন করে এখন এসব জাতিগোষ্ঠীকে স্বীকৃতি দেওয়া হবে।

জাতীয় আদিবাসী পরিষদের সভাপতি রবীন্দ্রনাথ সরেন বলেন, ‘স্বাধীনতার পর এই প্রথম এতগুলো জাতিগোষ্ঠীর স্বীকৃতি মিলল। আইনটি করার ফলে এখন আইনে বাদ পড়ে যাওয়া জাতিগোষ্ঠীর মানুষ চাকরি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তিসহ বিভিন্ন সরকারি সহায়তা পাবেন। তাঁদের ভোগান্তি কমবে। এই তালিকার ফলে এসব জাতিগোষ্ঠীর মানুষের ভূমি রক্ষার ক্ষেত্রে যে আইনি রক্ষাকবচ আছে, তারও সুযোগ পাবেন এসব জাতির মানুষ।’

বাংলাদেশের সরকারি চাকরিতে ৫ শতাংশ কোটা সংরক্ষিত আছে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর জন্য। বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তাদের কোটা আছে। এ ছাড়া প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে বিশেষ বরাদ্দ আছে।

ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্বকারী সংগঠনগুলো দুই দশকের বেশি সময় ধরে তাদের ‘আদিবাসী’ হিসেবে সাংবিধানিক স্বীকৃতির দাবি করে আসছে। সর্বশেষ ষোড়শ সংশোধনীর সময় এ দাবি জোরালো হয়।

দেশের ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর সংখ্যা নিরূপণে ১৯৫০ সালের বঙ্গীয় প্রজাস্বত্ব আইনটিকে দীর্ঘ সময় ধরে বিবেচনায় নেওয়া হয়। এই তালিকায় ২১টি জাতিগোষ্ঠীর নাম ছিল।

ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর সংখ্যা নিয়ে বহুদিন ধরে বিতর্ক চলছে। ২০১০ সালে আইনটি হওয়ার পর কিছু জাতির স্বীকৃতি মেলে। আইনটিতে ২৭টি জাতিগোষ্ঠীর কথা উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু উসুই, মং ও পাহাড়ি নামে তিন জাতিগোষ্ঠীর উল্লেখ করা হয়, যাদের বাস্তবে কোনো অস্তিত্বই নেই।

বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং বলেন, ‘তালিকাটি নিয়ে আমাদের শুরু থেকেই আপত্তি ছিল। আমরা একে বাদ নিয়ে আরও গবেষণা করে যথার্থ তালিকা করার দাবি করেছিলাম।’

এসব দাবির পরিপ্রেক্ষিতেই ২০১৪ সালে ‘ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী, বিশেষ পেশাজীবী, বর্ণাশ্রিত গোষ্ঠী ও অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর তালিকা প্রণয়নে’ একটি জাতীয় কমিটি করে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়। এতে আদিবাসী ফোরামসহ বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর সংগঠনের প্রতিনিধি, গবেষক, নাগরিক সংগঠনের প্রতিনিধি, সরকারের নৃগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক একাডেমির পরিচালক এবং মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা যুক্ত হন। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষকদের নিয়ে একটি একাডেমিক কমিটিও গঠিত হয়। চার বছর ধরে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে ৫০টি জাতিগোষ্ঠীর একটি তালিকা করা হয়।

এ বিষয়ে সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর বলেন, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান আইনে (২০১০ সাল) এখন এসব তালিকা যুক্ত হবে। তালিকা মন্ত্রিসভায় পাঠানো হবে। পরে সংসদে আইনটি সংশোধনের জন্য তোলা হবে। তিনি বলেন, ‘আপাতত ৫০টি জাতিগোষ্ঠীকেই স্বীকৃতি দিতে চায় সরকার। তবে এ তালিকা যদি বাড়াতে হয়, তার জন্যও আমরা প্রস্তুত আছি।’

জাতীয়