বস্তির শিশুদের ৮৬ শতাংশ খাবারে ক্ষতিকর জীবাণু

বস্তির শিশুদের অপুষ্টির প্রধান কারণ দূষিত পানি ও ক্ষতিকর জীবাণুযুক্ত খাদ্য। আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশের (আইসিডিডিআরবি) এক গবেষণায় দেখা গেছে, বস্তির শিশুরা নিয়মিত যে খাবার খায়, তার ৮৬ শতাংশে বহু ধরনের ক্ষতিকর ছত্রাক থাকে। এ কারণে বস্তির শিশুরা বারবার ডায়রিয়া, আমাশয়সহ বিভিন্ন ধরনের সংক্রামক রোগে আক্রান্ত হয়। এ জন্য শিশুদের স্বাভাবিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়।

ঢাকা শহরের সাদেকখান, বাউনিয়াবাদ, কল্যাণপুর ও গাবতলী বস্তির পাঁচ বছরের কম বয়সী ৩৬০ শিশুর ওপর এই গবেষণা হয়েছে। ২০১৫ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০১৬ সালের মার্চ পর্যন্ত এই গবেষণার তথ্য সংগ্রহের কাজ চলে। খাদ্য ও পানির নমুনা পরীক্ষা করা হয়। গবেষণা ফলাফল নিয়ে একটি প্রবন্ধ যুক্তরাজ্যের শিশু স্বাস্থ্যবিষয়ক আন্তর্জাতিক বৈজ্ঞানিক গবেষণা সাময়িকী এক্টা পিডিয়াট্রিকাতে সম্প্রতি ছাপা হয়েছে।

গবেষণায় নেতৃত্ব দেন আইসডিডিআরবির নিউট্রিশন অ্যান্ড ক্লিনিক্যাল সার্ভিসেস (পুষ্টি ও চিকিৎসাসেবা) বিভাগের রিসার্চ ইনভেস্টিগেটর ঈশিতা মোস্তফা। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, বস্তির শিশুরা যে পানি পান করে এবং যে খাদ্য খায়, তাতে অণুজীবাণুর পরিমাণ শনাক্ত করাই ছিল এই গবেষণার মূল উদ্দেশ্য। গবেষণার ফলাফলে দেখা গেছে, বস্তির শিশুরা বিশুদ্ধ পানি পান করার সুযোগ পায় না।
বিশ্বব্যাংকের সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, ঢাকা শহরে এখন ১ কোটি ৮০ লাখ মানুষের বাস। এদের ৩৫ শতাংশ বা ৬৩ লাখ মানুষ বাস করে বস্তিতে। এই বিপুলসংখ্যক মানুষের পুষ্টি পরিস্থিতির উন্নতিতে সরকারের পৃথক কোনো উদ্যোগ নেই। জাতীয় পুষ্টিসেবা কর্মসূচির ব্যবস্থাপক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, দেশের সব শিশুর জন্য ভিটামিন-এ বিতরণ বা টিকাদান কর্মসূচি আছে, বস্তির শিশুদের জন্যও ওই একই কর্মসূচি। বস্তির মানুষের জন্য আলাদা কোনো কর্মসূচি নেই।

কী পাওয়া গেছে

চারটি বস্তি থেকে ভাত, সবজির তরকারি, ডাল, সুজি, মাছের তরকারি, রুটি, আলু, চা, দুধ, কেক, মাংস, পরোটা, পিঠা, বিস্কুট, মুরগির ঝোল, ডিমের তরকারির ৫৬টি নমুনা সংগ্রহ করে তা পরীক্ষা করেন গবেষকেরা। এসব নমুনা শিশুদের খাওয়ানোর আগ মুহূর্তে সংগ্রহ করা হয়েছিল। নমুনা পরীক্ষায় ৮৬ শতাংশ খাদ্যে এককোষী ও বহুকোষী ছত্রাক, ৭৩ শতাংশ খাদ্যে ব্যাকটেরিয়া পাওয়া গেছে। ডায়রিয়ার জন্য দায়ী ই-কলাই জীবাণু পাওয়া গেছে ৩০ শতাংশ খাবারে। আইসিডিডিআরবির ল্যাবরেটরিতে (পরীক্ষাগারে) ওই সব খাদ্য পরীক্ষা করা হয়।

এ বিষয়ে প্রধান গবেষক ঈশিতা মোস্তফা বলেন, ৬ থেকে ২৪ মাসের শিশুকে মায়ের দুধের পাশাপাশি সম্পূরক খাবার দিতে হয়। কিন্তু বস্তির শিশুদের দেওয়া এই সম্পূরক খাদ্যে ব্যাপকমাত্রায় জীবাণু পাওয়া গেছে।

শিশুদের খাওয়ানোর আগ মুহূর্তে পানির ১৬টি নমুনা সংগ্রহ করা হয় এবং তা পরীক্ষা করা হয়। তাতে দেখা যায়, ১০০ শতাংশ পানিই দূষিত। মানুষের মলে থাকা ব্যাকটেরিয়া, এককোষী ও বহুকোষী ছত্রাক পাওয়া যায় পানির নমুনায়।

স্বাস্থ্যবিধি পুষ্টি পরিস্থিতির উন্নতিতে প্রভাব ফেলে। গবেষকেরা দেখেছেন, শিশুদের শৌচকাজ করানোর পর সাবান দিয়ে হাত পরিষ্কার করেন না ৬৭ শতাংশ মা। অন্যদিকে সম্পূরক খাবার তৈরির আগে হাত পরিষ্কার করেন না ৯৫ শতাংশ মা।

পরিণতি কী

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মা-বাবার স্বাস্থ্যবিধি মেনে না চলা এবং পানিতে জীবাণু ও খাদ্যে ছত্রাক বস্তির শিশুস্বাস্থ্যে বিরূপ প্রভাব ফেলছে। তারা ডায়রিয়া, আমাশয়সহ পানিবাহিত বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। বারবার সংক্রমণের ফলে শিশুদের খাদ্যনালি ও পরিপাকতন্ত্রের স্বাভাবিক কর্মক্ষমতা হ্রাস পাচ্ছে। ফলে শিশুরা বিভিন্ন ধরনের অপুষ্টিজনিত রোগে ভুগছে।

গবেষকেরা দেখেছেন, বস্তির পাঁচ বছরের ৫৮ শতাংশ শিশু খর্বকায়। অর্থাৎ এদের উচ্চতা বয়সের তুলনায় কম। সাধারণভাবে দেশের ৩৩ শতাংশ শিশু খর্বকায়। তুলনা করলে দেখা যায়, খর্বতার হার বস্তির শিশুদের মধ্যে অনেক বেশি।

গবেষণা ফলাফলকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন বাংলাদেশ জাতীয় পুষ্টি পরিষদের মহাপরিচালক অধ্যাপক মোহাম্মদ শাহনেওয়াজ। তিনি বলেন, বস্তির পুষ্টি পরিস্থিতি উদ্বেগজনক। বহু বছর ধরে এটা চলে আসছে। বস্তির শিশুদের স্বাস্থ্য ও পুষ্টি পরিস্থিতির উন্নয়নের জন্য পৃথক কর্মসূচি নেওয়ার পরিকল্পনা তাঁদের রয়েছে।

জাতীয়