জয়ীতা রায়
১৩ বছর ধরে রাজধানীর কলাবাগান এলাকায় বাসা ভাড়া থাকেন লুৎফর রহমান। প্রথমে যখন বাসায় ওঠেন তখন ভাড়া ছিল ৮ হাজার টাকা। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন রকম হারে বাড়িয়ে এখন প্রতি মাসে তাকে ২২ হাজার টাকা বাসা ভাড়া গুনতে হয়। ছেলেমেয়ের স্কুল এবং তার অফিস কাছে হওয়ায় বেশি ভাড়ার খড়গ নিয়েই বসবাস করছেন তিনি।
শুধু কলাবাগান নয় রাজধানীর সব এলাকাতেই বাসা ভাড়া বাড়ছে। নগরের মিরপুর, মোহাম্মদপুর, কল্যাণপুর, কাঁঠালবাগান, গ্রিন রোড, ধানমন্ডি, রামপুরা, সেগুনবাগিচা, বংশাল, গুলশান, বনানী, উত্তরা, আগারগাঁও, শ্যামলী, মগবাজার, মালিবাগসহ বিভিন্ন এলাকার ভাড়াটের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রতি বছরই বাড়ির মালিক ভাড়া বাড়ান। জীবনযাত্রার খরচ বাড়ছে দাবি করে বছরের শুরু শেষ নেই যখন-তখন বাড়ানো হয় বাড়ি ভাড়া। আরোপ করা ভাড়া না দিতে চাইলে দেওয়া হয় বাড়ি ছাড়ার নোটিস। বাড়ি ভাড়া সংক্রান্ত আইন না জানায় এবং আইনের প্রয়োগ না থাকায় নিরুপায় হয়ে বাসিন্দারা মেনে নেন বেশি ভাড়ার শর্ত।
ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণবিষয়ক সংগঠন কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) একটি সমীক্ষায় দেখা যায়, গত ২৫ বছরে রাজধানীতে বাড়ি ভাড়া বেড়েছে প্রায় ৪০০ শতাংশ। অথচ একই সময়ে নিত্যপণ্যের দাম বেড়েছে ২০০ শতাংশ। অর্থাৎ নিত্যপণ্যের দামের তুলনায় বাড়ি ভাড়া বৃদ্ধির হার প্রায় দ্বিগুণ। রাজধানীতে ১৯৯০ সালে পাকা ভবনে দুই কক্ষের একটি বাসার ভাড়া ছিল ২ হাজার ৯৪২ টাকা। ২০১৫ সালে সেই ভাড়া দাঁড়িয়েছে ১৮ হাজার ১৫০ টাকা। গত বছর এই ভাড়া এসে ঠেকেছে ২১ হাজার ৩৪০ টাকায়। ২০০৬ সাল থেকে গত ১০ বছরে ভাড়া বেড়েছে সবচেয়ে বেশি। বিশ্বব্যাংকের তথ্যানুসারে ২০০০-২০১০ সাল পর্যন্ত দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশে নগরায়ণের গতি ছিল বেশি।
এ ছাড়া ২০১০ সালে ৪৫ দশমিক ৭ শতাংশ লোক শহরে বসবাস করে। বাড়ি ভাড়া বাড়ার আরও একটি কারণ হচ্ছে লোকজন নানা কারণে ঢাকামুখী। যে কারণে চাহিদা এ জোগানের মধ্যে কোনো সামঞ্জস্য নেই।
কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্ত মানুষ যেসব এলাকায় বসবাস করে সেখানে বাড়ির চাহিদার তুলনায় সংখ্যা কম। ফলে বাড়িওয়ালারা ভাড়াটিয়াদের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে পারে। বাড়ি ভাড়া, গ্যাস, পানি, বিদ্যুতের বিল বাড়ায় ঢাকাবাসীর দৈনন্দিন ব্যয় বাড়ছে। বাড়ি ভাড়া নিয়ে যে আইন আছে তা ভাড়াটিয়া সহায়ক নয়। সরকারের আইন প্রয়োগের বিষয়ে সচেতন হওয়ার পাশাপাশি গৃহায়ণ কর্মসূচির উদ্যোগ বাড়াতে হবে।
ঢাকার প্রায় ৯০ শতাংশ মানুষই ভাড়াটে। ক্যাবের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাড়িওয়ালাদের ৮০ শতাংশই বাড়ি ভাড়ার আয় দিয়ে জীবিকা নির্বাহ করেন এবং ঢাকার ২৮ দশমিক ৩৬ শতাংশ বাড়িওয়ালা ভাড়াটেদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেন। ভাড়াটেরা বাড়ি ভাড়া আইন সম্পর্কে না জানার কারণে বাড়িওয়ালাদের দ্বারা নির্যাতিত ও নিগৃহীত হওয়া সত্ত্বেও আইনি পদক্ষেপ নিতে পারছেন না। বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণ-সম্পর্কিত অধ্যাদেশটি প্রথম জারি করা হয় ১৯৬৩ সালে। বর্তমানে প্রচলিত বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইনটি ১৯৯১ সালের। বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইন-১৯৯১ এ বলা আছে, কোনো বাড়ির ভাড়া মানসম্মত ভাড়ার অধিক বৃদ্ধি করা হলে ওই অধিক ভাড়া, কোনো চুক্তিতে ভিন্নরূপ কিছু থাকা সত্ত্বেও আদায়যোগ্য হবে না। মানসম্মত ভাড়া, বাড়ি-মালিক বা ভাড়াটের আবেদনের ভিত্তিতে প্রতি দুই বছর পর (নিয়ন্ত্রক কর্তৃক) পুনর্নির্ধারণ করা যাবে। ভাড়াটে কর্তৃক ভাড়া পরিশোধ করা হলে বাড়ির মালিক তত্ক্ষণাৎ ভাড়া প্রাপ্তির একটি রসিদ বিধি দ্বারা নির্ধারিত ফরমে স্বাক্ষর করে ভাড়াটেকে প্রদান করবেন। কিন্তু এসব নিয়মের কোনোটারই প্রয়োগ ঘটে না বাস্তবে।
বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইন, ১৯৯১ কার্যকর করতে ২০১০ সালে মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশ জনস্বার্থে হাই কোর্টে রিট আবেদন করেছিল। রিট আবেদনের পক্ষে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মনজিল মোরসেদ ছিলেন।
এ ব্যাপারে তিনি বলেন, এ বছরের জানুয়ারিতে বাড়ি ভাড়া আইনটির নানা দিক নিয়ে আবার হাই কোর্টে শুনানি হয়। সে সময় সদ্য অবসরে যাওয়া আপিল বিভাগের সাবেক বিচারপতি ওয়াহাব মিয়া আবার শুনানির কথা বলেন। তার পরে আবার প্রধান বিচারপতি বদলেছে। সে অনুসারে আগের সব সিদ্ধান্ত নতুন করে হবে বলে জানান মনজিল মোরসেদ। হাই কোর্ট খুললে এ বিষয়ে শুনানি হতে পারে বলে জানান তিনি।