যথাসময়ে নির্বাচন অনুষ্ঠান বিষয়ে সকল শংকা ঝেড়ে ফেলে দিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দৃপ্তকন্ঠে বলেছেন, বাংলাদেশে যথাসময়েই আগামীর নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘নির্বাচন কমিশন নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। তাঁরা যখন নির্বাচনের সিডিউল ঘোষণা দেবে, তখনই নির্বাচন হবে। বাংলাদেশে এই নির্বাচন অবশ্যই হবে-এটাই আমি বিশ্বাস করি।’ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আজ বিকেলে তাঁর সরকারী বাসভন গণভবনে সাস্প্রতিক সৌদি আরব সফর নিয়ে আয়োজিত এক জনাকীর্ন সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে একথা বলেন।
দেশে আগামী নির্বাচন যথাসময়ে অনুষ্ঠানের বিষয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের আশংকা থাকা সংক্রান্ত প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘তারা সংশয়ের সৃষ্টি করছে কারণ তাদের আসল উদ্দেশ্য বাংলাদেশে আর যেন গণতন্ত্র না থাকে এবং দেশে গণতন্ত্র না থাকলেই তাদের জন্য নানারকম সুযোগ সৃষ্টি হয়।’ সৌদি আরবে সফর বিষয়ে সাংবাদিকদের অবহিতকরণে এই সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন হলেও এতে প্রাসঙ্গিকভাবেই আগামীর জাতীয় সংসদ নির্বাচন, নির্বাচনকে সামনে রেখে আওয়ামী বিরোধী জোটের জাতীয় ঐক্য গঠন প্রক্রিয়া, ব্যরিষ্টার মইনুল হোসেনের বিরুদ্ধে এক নারী সাংবাদিকের মামলা, দেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট এবং তথাকথিত সুশীল সমাজের ভ’মিকা ঘুরে ফিরে সাংবাদিকদের প্রশ্নে চলে আসে এবং প্রধানমন্ত্রীও তাঁর অনুপুঙ্খ উত্তর দেন।
সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রী এ এইচ মাহমুদ আলী এ সময় মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন। প্রেস সচিব ইহসানুল করিম সংবাদ সম্মেলনটি সঞ্চালনা করেন। প্রধামন্ত্রী বলেন, ‘নির্বাচনের প্রস্তুুতি নিচেছ নির্বাচন কমিশন। এখানে সরকারের কোন ভূমিকা নাই। নির্বাচন কমিশন স্বাধীন তাঁরা স্বাধীনভাবেই নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে।’ তিনি বলেন, আমরা চাই বাংলাদেশে যথাসময়ে নির্বাচন হোক এবং সুষ্ঠুভাবে এই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে সেটা আমরা বিশ্বাস করি।’
প্রধানমন্ত্রী ষড়যন্ত্রের প্রসঙ্গে বলেন, ষড়যন্ত্রটাতো বাংলাদেশে চিরাচরিত একটা বিষয়, প্রতিনিয়তই ষড়যন্ত্র হচ্ছে, এটা চলবে এবং থাকবে আর এরমধ্য দিয়েইতো বাংলাদেশকে আমরা আর্থসামাজিকভাবে উন্নয়নের পথে নিয়ে যেতে সমর্থ হয়েছি । ষড়যন্ত্র তো কম হয়নি। কিন্তু সবকিছু মোকাবেলা করে এগিয়ে যেতে পারছি, তার কারণ একটাই। জনগণই শক্তি আমাদের। বঙ্গবন্ধু কন্যা এ সময় জনগণের ক্ষমতার ওপর তাঁর অগাধ আস্থা ব্যাক্ত করে বলেন, ‘আমি জনগণের শক্তিতে বিশ্বাস করি, আমার ওপর জনগণের আস্থা এবং বিশ্বাস আছে বলে আমি মনে করি। কাজেই এদেশে যাতে সুষ্ঠু নির্বাচন হয়, সেটাই আমি চাই। সকল ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করে আমরা সে নির্বাচন করতে সক্ষম হব।’ তিনি বলেন, ‘নির্বাচন কমিশন নির্বাচনের যে প্রস্তুতি নিচ্ছে। তাঁরা যখন নির্বাচনের সিডিউল ঘোষণা দেবে, সে অনুযায়ী তখনই নির্বাচন হবে। বাংলাদেশে এই নির্বাচন অবশ্যই হবে-এটাই আমি বিশ্বাস করি। যেকোন ষড়যন্ত্র হোক তা মোকাবেলা করবার মত শক্তি আওয়ামী লীগ রাখে আর আমার সরকারও রাখে।’
আরেক প্রশ্নে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘২০১৪ এর নির্বাচন ঠেকাতে অনেক চেষ্টা হয়েছে। বিদেশি বন্ধু নিয়েও চেষ্টা করেছিল। কিন্তু পারেনি। কারন জনগণ সচেতন ছিল। আমার বিশ্বাস এবারও জনগণ সচেতন রয়েছে। কাজেই তাদের কোনো নালিশ কাজে আসবে না।
প্রধানমন্ত্রী নির্বাচনকে কেন্দ্র করে জাতীয় ঐক্য গঠন সম্পর্কে বলেন, তাদের মেকিং এবং ব্রেকিং নিয়ে চিন্তার কিছু নাই আপনারা দেখতে থাকেন এই ভাঙ্গাগড়ার খেলা কোথায় গিয়ে দাঁড়ায় কিন্তু আমি দেখতে চাই তাঁরা ঐক্য গড়ে সিলেটের মাজার থেকে নির্বাচনী প্রচারে নামবে সেটাতো খুব ভাল কথা । ‘কিন্তু এর বাইরে দেশে আবার যদি কেউ অগ্নি সন্ত্রাস করতে চায় আমিতো বিশ্বাস করি সরকারের পক্ষ থেকে যা যা করনীয় তাতো করবোই কিন্তু বাংলাদেশের জনগণও রুখে দাঁড়াবে’ বলেন তিনি। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বাংলাদেশের জনগণও এটায় রুখে দাঁড়াতে পারবে- আমি জনগণের কাছে সেই আহ্বানই জানাবো যে, এ ধরনের কোন ষড়যন্ত্র হলে তাঁরা যেন সকলে মিলে রুখে দাঁড়ায়। তাহলে আর কেউ কিছু করতে পারবে না।’
ঐক্যফ্রন্ট নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘এখানে তো রাজনৈতিক স্বাধীনতা রয়েছে, কথা বলার স্বাধীনতা আছে, সাংবাদিকতার স্বাধীনতা আছে, সব কিছু মুক্ত। তবে, কারা কারা এক হলো, সেটা আপনারা একটু খোঁজ নিয়ে দেখবেন।’ আওয়ামী লীগ সভাপতি বলেন, ‘যারা সেখানে ঐক্যবদ্ধ হয়েছে, তারা কোথা থেকে এসেছে, কার কী ধরনের ভূমিকা, কী ধরনের বাচনভঙ্গি, এমনকি মেয়েদের প্রতি যে কী ধরনের কটূক্তি করতে পারে, সে প্রতিযোগিতাও তৈরি হয়েছে। তিনি বলেন, ‘আওয়ামী লীগ এটা নিয়ে কোনো দুশ্চিন্তা করে না। বরং একটা হয়েছে, এটাই ভালো। এখানে স্বাধীনতাবিরোধী আছে, এখানে জাতির পিতার হত্যাকারীদের মদতদাতা, ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স দিয়ে তাদের বিভিন্ন দূতাবাসে চাকরি দিয়ে পুরস্কৃত করা, এমনকি যারা জঙ্গিবাদ-সন্ত্রাস সৃষ্টি করেছে, বাংলাদেশকে দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন করেছে, তারা মিলেই কিন্তু এক জায়গায় হয়েছে। এটাকে বাংলাদেশের মানুষ কিভাবে দেখে, সেটাই বড় কথা।’ নারী সাংবাদিককে টেলিভিশন লাইভে কটুক্তি করা জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট নেতা মইনুল হোসেনের কঠোর সমালোচনা করে এই নেতার অতীতের নানা নেতিবাচক ঘটনা তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, তিনি আরও ঘটনা জানেন, সময় মতো প্রকাশ করবেন।
তিনি মইনুলের বাচনভঙ্গী নিয়েও প্রশ্ন তোলেন। বলেন, ‘তার অ্যাটিচিউডিই ছিল খারাপ। কার কাছ থেকে কী আশা করবেন?’ প্রধানমন্ত্রীর অভিযোগ, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তানের দালালি করে বেড়াতেন মইনুল হোসেন। ইত্তেফাক থেকে সাংবাদিক সিরাজউদ্দিন হোসেনকে তুলে নেয়ার পেছনেও মইনুলের দায় ছিল বলে জানান তিনি।
বঙ্গবন্ধু কন্যা বলেন, ১৯৭৫ সালে জাতির পিতাকে হত্যার পর খন্দকার মোশতাকের নেতৃত্বে দলে যোগ দেন মইনুল হোসেন। এরপর তিনি নিজেও খুনি বজলুল হুদা, আজিজ পাশা এবং সুলতান শাহরিয়ার খানকে নিয়ে দল করেন। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘তার কাছ থেকে ভালো ভদ্র ব্যবহার আর কী পাবেন?’
দুই ভাই মইনুল হোসেন এবং আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর মধ্যে ইত্তেফাকের মালিকানা নিয়ে দ্বদ্বের জেরে খুনের ঘটনা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘নিজে মার্ডার করে ভাইকে ফাঁসানোর প্রচেষ্টা চালিয়েছিল। কাকরাইলের বাড়ি নিয়েও ঝামেলা আছে। সেখানেও স্টেট ভার্সাস মামলার রায় আছে, আপনারা সাংবাদিকরা আছেন, বের করে দেখেন।’
উল্লেখ্য, সাংবাদিক মাসুদা ভাট্টি যেমন মইনুলের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন, তেমনি ব্যারিষ্টার মইনুল হোসেনের পক্ষ থেকেও আইনি নোটিশ পাঠানো হয়েছে। এতে অভিযোগ করা হয়েছে, তাকে জামায়াত বলে সম্মানহানির চেষ্টা করা হচ্ছে। প্রমাণ না দিতে না পারলে মামলা করার হুঁশিয়ারিও দেয়া হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী মনে করেন, এই মামলা হতে পারে না। তারপরও বিচারকরা যদি মামলা নেন তাহলে কিছু বলার নেই।
মইনুলের জামায়াত সংশ্লিষ্টতা প্রমাণ করতে হয় কেন?- এমন প্রশ্ন রেখে শেখ হাসিনা বলেন, ‘শিবিরের অনুষ্ঠানে গিয়ে যে বক্তৃতা দিয়েছিলেন সেটা খুঁজে বার করেন। প্রমাণ তো আছেই, ভিডিও তো আছেই। ইত্তেফাকেই ছাপা হয়েছে। সেটা বের করে প্রমাণ করে দিয়ে দেন। তিনি যে শিবিরের মিটিংয়ে গিয়ে বক্তৃতা দিলেন, তাতে জামায়াত সমর্থন সে করে না, সেটা সে কী করে বলবে।’ আরেক প্রশ্নের উত্তরে আওয়ামী লীগ সভাপতি বলেন, ‘আমি বলতে চাই, আপনারা যারা নারী সাংবাদিক, তারাইবা কী করছেন। নারী সাংবাদিকরা আপনারা প্রতিবাদ করেন। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যা করার করবে। আপনারা মামলা করেন। আমরা যা করার করব।’
নির্বাচনকালীন মন্ত্রীসভা গঠন প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী এক প্রশ্নের উত্তরে বলেন, গত নির্বাচনে তৎকালীন বিরোধীদল বিএনপিকে আহ্বান জানিয়েছিলাম-যেন তারা মন্ত্রিসভায় আসে। সবাই মিলে একটা মন্ত্রিসভা করে নির্বাচন করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু তারা আসেনি।
তিনি বলেন, পরবর্তীতে আমরা মন্ত্রিসভা ছোট করে একটা নির্বাচন করেছি। কিন্তু এখন প্রেক্ষাপট আলাদা। আগের মন্ত্রিসভায় আওয়ামী লীগ ছাড়া অন্য কোনো দল ছিল না। এখন জনগণের প্রতিনিধিদের প্রায় সবাই মন্ত্রিসভায় রয়েছে।
শেখ হাসিনা বলেন, আমাদের অনেকগুলো উন্নয়নমূলক প্রকল্প চলমান রয়েছে, অনেক কাজ করতে হবে। মন্ত্রিসভা ছোট হলে আমাদের উন্নয়নে সমস্যা হবে কিনা সেটাই ভাবছি। তিনি বলেন, এখন মন্ত্রিসভা ছোট করে একজনকে দু-তিনটা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দিলে পারবে কিনা। এতে উন্নয়নে বাধা হবে কিনা সেটা নিয়ে ভাবতে হবে। সরকার প্রধান বলেন, আগামী ৩-৪ মাসে উন্নয়ন কর্মকান্ডকে আরও এগিয়ে নিতে চাই। যা হোক, আমি রাষ্ট্রপতির সঙ্গে আলোচনা করেছি। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এভাবে নির্বাচন হয়। অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, ব্রিটেন, ভারতের মতো দেশে এভাবে নির্বাচন হয়ে থাকে।
নির্বাচন বানচালে কোন কোন মহলের দেশে অরাজকতা সৃষ্টির অপচেষ্টা সংক্রান্ত অপর এক প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী জনগণের ক্ষমতার ওপর তাঁর আস্থা পুণর্ব্যাক্ত করে তাঁদের সহযোগিতায় জঙ্গিবাদ মোকাবেলার উদ্যোগ তুলে ধরে বলেন, আজকে যে পূজো হয়ে গেলো-আল্লাহর রহমতে কোন একটা দুর্ঘটনা ঘটতে পারে নাই। তিনি বলেন, এখানে যেমন আমাদের গোয়েন্দা এবং আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারি সংস্থা তারা যেমন সবসময় সচেতন থেকে সবরকমের ব্যবস্থা নিয়েছে সেই সাথে সাথে আমার দেশের মানুষ, তারাও কিন্তু সচেতন ছিল। আর সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টার ফলে আমরা এটায় সফল হতে পেরেছি। তিনি একটি সুস্থ্য পরিবেশে প্রতিটি মন্ডপে সুষ্ঠুভাবে দুর্গাপূজো সম্পন্ন হওয়ায় গোয়েন্দা এবং কর্তব্যরত আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতিটি সদস্যকে ধন্যবাদ জানান।
তারপরেও বাংলাদেশে অতীতে অনেক অনভিপ্রেত ঘটনা ঘটেছে, দুর্ঘটনা ঘটেছে, এমন একটি বিয়োগান্তক ঘটনার শিকার হয়ে তিনি পুরো পরিবারকেই হারিয়েছেন উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, যেকোন ঘটনা ঘটতে পারে তবে, আমি এটুকু বলতে পারি যতক্ষণ বেঁচে আছি, বাংলাদেশের মানুষকে নিয়ে আর কাউকে এই জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করবে, পুড়িয়ে মারবে, এ ধরনের ঘটনা আর যাতে না ঘটে, সেজন্য যা যা করণীয় সেটা করবো। শেখ হাসিনা বলেন, ‘মানুষ যেন শান্তি ও নির্বিঘ্নে বসবাস করতে পারে এর জন্য যে কাজ করা দরকার আমরা তা করবো-এইটুকুর নিশ্চয়তা দিতে পারি।’বাসস