ব্যবসার পরিবেশ উন্নতিতে আগামী এক দশকে বাংলাদেশের জন্য বড় বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে উচ্চ মূল্যের জ্বালানি। এর পরেই বড় বাধা হলো সুশাসনের অভাব, সাইবার হামলা, আঞ্চলিক সুশাসনে ব্যর্থতা ও দেশের বেকারত্ব। ওয়ার্ল্ড ইকনমিক ফোরাম (ডব্লিউইএফ) প্রকাশিত ‘রিজিওনাল রিস্ক অব ডুইং বিজনেস-২০১৯’ রিপোর্টে এমনটি উল্লেখ করা হয়েছে।
২০০৬ সাল থেকে ওয়ার্ল্ড ইকনমিক ফোরাম ধারাবাহিকভাবে গ্লোবাল রিস্ক রিপোর্ট প্রকাশ করে আসছে। এবারের প্রতিবেদেন দেশ ভিত্তিক পাঁচটি প্রধান ঝুঁকি চিহ্নিত করে বিশ্লেষণ করা হয়েছে। গতকাল প্রকাশিত এই প্রতিবেদনে মূলত দেশগুলোর ব্যবসা করার পরিবেশ সহজ করতে প্রধান বাঁধাগুলো তুলে ধরা হয়েছে। এজন্য বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নির্বাহীদের সাক্ষাত্কারের ভিত্তিতে জরিপ করা হয়। তাদেরকে ব্যবসায়ীক পরিবেশ উন্নতিতে আগামী দশ বছরে প্রধান পাঁচটি বাধা কী হতে পারে এমন প্রশ্ন করা হয়েছিল। দীর্ঘ মেয়াদে তারা ব্যবসার জন্য কী ধরনের সমস্যা দেখছেন এমন ত্রিশটি বিষয় প্রতিবেদনে উঠে আসে।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, মানুষের জীবন যাত্রার অনেক উন্নতি হলেও অর্থনীতির ঝুঁকিগুলো সময়ের সাথে সাথে বাড়ছে। বিশ্বে ক্ষমতার পালাবদলের কারণেই নয়, তাদের মূল্যবোধের পরিবর্তনও অর্থনীতিকে প্রভাবিত করছে। তাছাড়া ভূ-রাজনৈতিক পরিবর্তন আঞ্চলিক উন্নয়নকেও প্রভাবিত করছে। প্রতিবেদন অনুযায়ী ভারতের অর্থনীতির জন্য সাইবার হামলাকে বড় ঝুঁকি হিসেবে দেখা হচ্ছে। নেপালের জন্য বড় ঝুঁকি হল বেকারত্ব আর পাকিস্তানের প্রধান বাধা হলো পানির সংকট।
প্রতিবেদনের বিষয়ে মন্তব্য জানতে চাইলে সেন্টার ফর পলিসি ডয়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম ইত্তেফাককে বলেন, এই ঝুঁকিগুলো খুবই যৌক্তিক। কেননা, বাংলাদেশ যেভাবে এগিয়ে যাচ্ছে তাতে উত্পাদনশীল খাতের জন্য জ্বালানির দাম স্থিতিশীল থাকা খুবই প্রয়োজন। কিন্তু এ বিষয়ে ব্যবসায়ীরা চিন্তিত। গ্যাস সংকটের ফলে উচ্চ মূল্যের এলএনজি আমদানি করা হচ্ছে। বিনিয়োগকারীরা দীর্ঘমেয়াদে এর দামের স্থিতিশীলতা চান। সেই নিশ্চয়তা সরকারের কাছ থেকে পাওয়া যাচ্ছে না। অন্যদিকে ওয়ার্ল্ভ্র ইকনমিক ফোরামের প্রতিযোগিতা সক্ষমতা প্রতিবেদেনে উঠে এসেছে যে দেশের ব্যবসায়ীরা দুর্নীতিকে বড় বাধা হিসেবে দেখছেন। এজন্য এবারের রিস্ক রিপোর্টের ঝুঁকিগুলোর মধ্যে জ্বলানির দামের পরেই সুশাসন বিষয়টিকে দীর্ঘ মেয়াদে বাধা মনে করা হচ্ছে। এর বড় কারণ হলো দুর্বল আমলাতন্ত্র ও দুর্বল বাস্তবায়ন সক্ষমতা। রাজনৈতিক কারণেও অনেক সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে বিলম্বিত হচ্ছে। তিনি বলেন, বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে সময় উপযোগী কর্মসংস্থান করাটাও চ্যালেঞ্জ। কারণ দেশের ১৫ থেকে ৩০ বছর বয়সীদের মধ্যে ৩০ ভাগের কোনো শিক্ষা, প্রশিক্ষণ ও কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা নেই। প্রযুক্তির প্রসারের ফলে দেশে দক্ষ জনশক্তির চাহিদা বাড়ছে। এজন্য একদিকে বিদেশ থেকে দক্ষ জনশক্তি আমদানি বাড়াতে হচ্ছে অন্যদিকে একটি বৃহত্ জনগোষ্ঠীর কোনো কর্মসংস্থান হচ্ছে না। এজন্য বেকারত্ব বা উপযোগী কর্মসংস্থান তৈরি আগামী দিনের জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, জাতীয় পর্যায়ে সুশাসনের ঘাটতি দক্ষিণ এশিয়ার জন্য প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বছরের একটি নির্দিষ্ট সময় নির্বাচনকে ঘিরে উত্তাপ ছড়ায়। যার ফলে ব্যবসায়ীরা উদ্বেগের মধ্যে থাকে। নির্বাচনকে ঘিরে সহিংসতা এবং অনিশ্চয়তা তৈরি হয়। অনিয়ন্ত্রিত মূল্যস্ফীতি দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর জন্য দ্বিতীয় বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ভারত পাকিস্তান দুই দেশেই সন্ত্রাসী হামলাকে যথাক্রমে দ্বিতীয় ও তৃতীয় বাধা বলে মনে করে ব্যবসায়ীরা।
প্রতিবেদনে সাইবার হামলার বিষয়টি বড় হয়ে এসেছে। সাইবার নিরাপত্তা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান সিমেনটিকের তথ্যানুযায়ী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের পরেই সাইবার হামলার সবচেয়ে বড় ঝুঁকিতে রয়েছে ভারত। দক্ষিণ এশিয়ার প্রধান পাঁচটি ঝুঁকির মধ্যে সাইবার হামলার বিষয়টি অন্যতম। বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ হ্যাকের বিষয়টিও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক সুশাসনের ব্যর্থতাকে বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য চতুর্থ বড় কারণ হিসাবে দেখা হচ্ছে। এর বড় উদাহরণ হলো মিয়ানমারের বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গারা।