জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মনোনয়ন পেতে শেষ মুহূর্তের দৌড়ঝাঁপ

আনোয়ার আলদীন ও মেহেদী হাসান

আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ-বিএনপিসহ বড় রাজনৈতিক দলগুলোর মনোনয়ন পেতে সম্ভাব্য প্রার্থীদের ঘুম হারাম হয়ে গেছে। শেষ মুহূর্তে এসে এখন প্রার্থিতা নিশ্চিত করতে লবিং-তদবির-দৌড়ঝাঁপ-দেনদরবারে ব্যস্ত তারা। প্রভাবশালী নেতাদের বাসা-বাড়িতে এখন রীতিমত উপচে পড়া ভিড়। আওয়ামী লীগ ও বিএনপির কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ নেতাকে ‘তুষ্ট’ করার জন্য হেন চেষ্টা নেই, যা তারা করছেন না। শনিবার রাতে বিএনপির এক প্রভাবশালী নেতার গুলশানের বাসায় গিয়ে দেখা যায় সেখানে জনসমাবেশের মতো অবস্থা। বাসা ছাড়িয়ে বাইরের রাস্তায়ও প্রার্থী আর তাদের সমর্থকদের জনারণ্য। দুই দলের মনোনয়ন বোর্ডের সদস্যরা যেখানে যাচ্ছেন প্রার্থীরা যাচ্ছেন পিছু পিছু। আওয়ামী লীগের মনোনয়ন প্রার্থীদের সাক্ষাত্কার শেষ করে এখন অপেক্ষা চলছে চূড়ান্ত তালিকা ঘোষণার। ফলে তাদের সম্ভাব্য প্রার্থীরা মরিয়া হয়ে তদবিরে নেমেছেন। সংসদীয় বোর্ডের প্রভাবশালী যারা তাদেরকে সর্বউপায়ে পক্ষে রাখার জোরালো চেষ্টা চালাচ্ছেন। যেভাবেই হোক-চাই মনোনয়ন।
বিএনপির একজন স্থায়ী কমিটির সদস্য বলেন, এক যুগ ধরে দল ক্ষমতায় নেই। অনেক নেতাকর্মী মামলা-মোকদ্দমা, জেল-জরিমানায় হয়রান হয়েছেন। নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। এখন তারা তাদের ত্যাগের মূল্যায়ন চাইছেন।হাসান

আওয়ামী লীগে চার হাজারের বেশি

মনোনয়ন প্রত্যাশী

এবার নৌকা পাওয়ার আশায় ফরম নিয়েছেন চার হাজার ২৩ জন নেতা। গড়ে প্রতিটি আসনে মনোনয়ন চাইছেন ১৩ দশমিক ৪১ জন নেতা। জানা গেছে, প্রার্থী চূড়ান্ত হলেও ঘোষণা না হওয়ায় আওয়ামী লীগের মনোনয়ন প্রত্যাশীরা চালাচ্ছেন শেষ মুহূর্তের তদবির। সিলেট বিভাগের একটি জেলা থেকে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন প্রত্যাশী এক নেতা দলের জরিপে প্রথম স্থানে আছেন। এই তথ্য তিনি দলের সাংগঠনিক সম্পাদকসহ নানা সূত্র থেকে জেনেছেন। আর দলীয় প্রধান শেখ হাসিনা ঘোষণা করেছেন, এগিয়ে থাকারাই মনোনয়ন পাবেন। তবে মনোনয়ন কে পাচ্ছেন, এই তথ্য জানার জন্য চেষ্টার কমতি নেই। ওই নেতা দলের মনোনয়ন বোর্ডের দুজন সদস্যের সঙ্গে দেখা করেছেন, কথা বলেছেন দুজন সাংগঠনিক সম্পাদকের সঙ্গে। সেখান থেকেও নিশ্চিত তথ্য না পেয়ে গেছেন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের একজন কর্মকর্তার কাছে। কিন্তু সেখানেও পাননি নিশ্চিত তথ্য। এখন মনোনয়ন বোর্ডের সদস্যদের কাছে নিয়মিত ধরনা দেওয়া অব্যাহত রাখছেন। এদিকে দলের সংসদীয় বোর্ডের প্রভাবশালী সদস্যরা যেদিকে যাচ্ছেন, সেদিকেই পিছু নিচ্ছেন হাজারো নেতা। এছাড়া গণভবন, ধানমন্ডিস্থ আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর রাজনৈতিক কার্যালয়, সংসদীয় বোর্ডের সদস্যদের বাসা-অফিসে নিয়মিত যাতায়াত করছেন অনেক মনোনয়ন প্রত্যাশী।

সিলেট বিভাগের ওই নেতার মতো ২৯৩টি আসনেই ঘটছে একই ধরনের ঘটনা। সাতটি আসনে একজন করে প্রার্থী মনোনয়নের জন্য আবেদন করেছেন। এই সাতটি আসন বাদে যেসব এলাকায় দলের অবস্থান শক্তিশালী, সেসব এলাকায় তো বটেই, এমনকি যেসব এলাকায় অবস্থান দুর্বল, সেসব এলাকাতেও মনোনয়ন প্রত্যাশীদের ঘুম যেন হারাম হয়ে গেছে। চেষ্টা-তদবির, দেনদরবারে মনোনয়ন নিশ্চিত করার হেন চেষ্টা নেই, যা তারা করছেন না। মনোনয়ন প্রত্যাশী ও তাদের কর্মী-সমর্থকরা এভাবেই রাজধানীতে ব্যস্ত সময় অতিবাহিত করছেন।

তবে এবার এত বেশি মনোনয়ন ফরম বিক্রি হওয়ায় বিরক্ত হয়েছেন দলীয় সভানেত্রী শেখ হাসিনা। জানা গেছে, ফরম বিক্রি শুরুর আগেই অধিকাংশ আসনে প্রাথমিকভাবে প্রার্থী বাছাই করা হয়। কিন্তু জরিপ রিপোর্টগুলো গত চার দিন ধরে বিশ্লেষণ করে শনিবার রাতে ২৩০টি আসনে একক প্রার্থী চূড়ান্ত করা হয়েছে। এখন আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করা বাকি। তবে এসব মানতে নারাজ মনোনয়ন প্রত্যাশীরা। শেষ মুহূর্তে মনোনয়ন প্রত্যাশীরা তাদের পক্ষে সিদ্ধান্ত নিয়ে আসার চেষ্টা করছেন। কেন্দ্রীয় শীর্ষ নেতাদের পাশাপাশি দপ্তরে খোঁজ-খবর রাখেন এমন কর্মীদের ধরছেন তারা। অবশ্য কেউ কেউ নিশ্চিত না হয়েই এলাকায় ঘোষণা দিয়ে বেড়াচ্ছেন, তিনি পেয়ে গেছেন মনোনয়ন। গত চারদিন ধরে বিভিন্ন আসনে মিষ্টি বিতরণের ঘটনাও ঘটেছে।

ধানমন্ডিস্থ আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর রাজনৈতিক কার্যালয়ে ৯-১২ নভেম্বর দলীয় মনোনয়ন ফরম বিতরণ ও জমাদান কার্যক্রম চালিয়েছে আওয়ামী লীগ। মনোনয়ন প্রত্যাশীদের সাক্ষাত্কার হয়ে গেছে ১৪ নভেম্বর। কিন্তু এখনো কেউ জানেননি মনোনয়ন মিলেছে কি না। কিন্তু তর সইছে না। তারা দলের সংসদীয় বোর্ডের সদস্যদের কাছে ধরনা দিচ্ছেন। নিজের জন্য তদবির করছেন। শেষ মুহূর্তে শেখ হাসিনার দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য প্রধানমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠজনদের কাছেও মনোনয়ন প্রত্যাশীদের ভিড় বাড়ছে। অনেকে দেন-দরবারও সেরে ফেলেছেন। শেখ হাসিনা বারবার বলেছেন, এবার তিনি জরিপ প্রতিবেদনকে গুরুত্ব দেবেন। জনপ্রিয়তা দেখে মনোনয়ন দেবেন। এখানে চেষ্টা-তদবির বা দলের বড় নেতা-ছোট নেতা দেখা হবে না। তারপরও সংসদীয় বোর্ডের সদস্যদের কারো কারো কাছে অনেক মনোনয়ন প্রত্যাশী হাজির হচ্ছেন। চালাচ্ছেন চেষ্টা-তদবির। মনোনয়ন প্রত্যাশী ও তাদের বিপুল সংখ্যক কর্মী-সমর্থক এখনও ঢাকায় অবস্থান করছেন। কেউই একক প্রার্থী না দেখে এলাকায় যেতে চাইছেন না। মনোনয়ন চূড়ান্ত হলেই তারা ঢাকা ছাড়বেন বলে জানা গেছে।

বিএনপির মনোনয়ন প্রত্যাশী আরো বেশি

বিএনপির মনোনয়ন ফরম বিক্রি হয়েছে আরও বেশি—চার হাজার ৫৮০টি। অর্থাত্ সেখানে আগ্রহী প্রার্থী প্রতি আসনে ১৫ দশমিক ২৬ জন। দলটি গতকাল থেকে তাদের প্রার্থীদের সাক্ষাত্কার গ্রহণ শুরু করেছে। শেষ হবে ২১ নভেম্বর। বিএনপির চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া কারাগারে থাকায় তার সঙ্গে প্রার্থীরা যোগাযোগ বা তদবির করতে পারছেন না। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান সূদূর লন্ডনে। অধিকাংশ প্রার্থীর পক্ষে সম্ভব নয় লন্ডনে যাওয়া বা তার সাথে অনায়াস যোগাযোগ করা। ফলে দলের হাতে গোনা কয়েকজন প্রভাবশালী নেতার কাছেই ছুটছেন সব মনোনয়ন প্রত্যাশী।

বিএনপি গত দশ বছর নির্বাচনের বাইরে থাকায় এবার মনোনয়ন প্রত্যাশীর সংখ্যাটা বেশি। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, প্রতিবার ভোটের আগে মনোনয়ন প্রত্যাশীরা আমাদের দোয়া নিতে আসেন। এবারও এসেছেন। স্থানীয় পর্যায়ে জনপ্রিয়তায় কে এগিয়ে আছেন, তার ভিত্তিতেই মনোনয়ন দেব। জানা গেছে, মনোনয়ন নিয়ে যাতে দলে কোনো বিদ্রোহ না হয়, সেজন্য বেশ কয়েকটি কৌশল নিয়েছে বিএনপি। আর সেগুলো হলো:একটি আসনের সব মনোনয়ন প্রত্যাশীকে ডেকে একসঙ্গে কথা বলে মনোনয়ন চূড়ান্ত করা। নির্বাচনকে দলের সংকট উত্তরণের একটি উপায় হিসেবে তুলে ধরা। স্থানীয় জরিপে কার কী অবস্থান তা তুলে ধরা এবং দলের চেয়ারপার্সন এবং ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপার্সনের ঐক্যবদ্ধভাবে নির্বাচন করার নির্দেশ জানিয়ে দেয়া।

জাতীয় শীর্ষ সংবাদ