হকিকত জাহান হকি
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সম্ভাব্য প্রার্থীদের হলফনামার সম্পদের হিসাবে নজর থাকবে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক)। স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ ও বার্ষিক আয়-ব্যয়ের হিসাব তারা সঠিকভাবেই দেবেন বলে প্রত্যাশা করছেন দুদক চেয়ারম্যান।
দুদক সূত্র জানায়, সম্ভাব্য প্রার্থীদের হলফনামায় অর্থ-সম্পদের বৈধতা ও যথাযথ উৎস থাকতে হবে। আয়কর নথির হিসাবের সঙ্গে হলফনামার হিসাবের মিল থাকতে হবে। কোনো প্রার্থীর হলফনামার হিসাব অস্বাভাবিক ও সন্দেহজনক মনে হলে তা অনুসন্ধান করা হবে। প্রয়োজনে সংশ্নিষ্টদের আইনের আওতায় আনা হবে। এর আগেও দুদক একাধিক প্রতিমন্ত্রী-এমপির হলফনামার সম্পদ অনুসন্ধান করে আইনি ব্যবস্থা নিয়েছে। এবারও কমিশন হলফনামার অস্বাভাবিক সম্পদ অনুসন্ধানে নামবে।
দুদক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ সমকালকে বলেন, তার বিশ্বাস জনপ্রতিনিধি হতে ইচ্ছুক প্রত্যেকেই হলফনামায় সঠিকভাবে সম্পদের সব রকমের হিসাব দেবেন। অবশ্যই এ হিসাবকে আয়কর রিটার্নের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ থাকতে হবে। যদি কেউ সঠিক হিসাব না দেন তা হলে কী হবে- জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘যদির কথা তো এখন বলে লাভ নেই। আশা করি, তারা সঠিক হিসাব দেবেন।’
আগের কমিশনের মতো বর্তমান কমিশনও হলফনামা নিয়ে কাজ করবেন বলে জানান তিনি।
হলফনামায় যেসব সম্পদের কথা জানাতে হয় :নির্বাচন কমিশন (ইসি) সূত্রে জানা গেছে, হলফনামায় সংশ্নিষ্ট প্রার্থীর ও তার পরিবারের সদস্যদের আয়ের উৎস হিসেবে কৃষি, ব্যবসা, বাড়ি, অ্যাপার্টমেন্ট, দোকান, শেয়ার, সঞ্চয়পত্র, ব্যাংক আমানত, পেশা ও অন্যান্য তথ্য জানাতে হবে।
নিজের ও পরিবারের অন্য সদস্যদের অস্থাবর সম্পদ হিসেবে নগদ টাকা, বৈদেশিক মুদ্রা, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে জমানো অর্থ, বন্ড, ঋণপত্র, শেয়ার, পোস্টাল, সঞ্চয়পত্র, বাস, ট্রাক, প্রাইভেটকার, মোটরসাইকেল, স্বর্ণ, মূল্যবান ধাতু ও পাথরে নির্মিত অলঙ্কার, ইলেকট্রনিক সামগ্রী, আসবাব ও অন্যান্য সম্পদের তথ্য উল্লেখ করতে হবে।
হলফনামায় স্থাবর সম্পদ হিসেবে কৃষি, অকৃষি জমি, আবাসিক ও বাণিজ্যিক পাকা ভবন, বাড়ি, অ্যাপার্টমেন্ট, চা-বাগান, রাবার বাগান, মৎস্য খামারসহ অন্যান্য সম্পদের তথ্য থাকতে হবে। নিজে ও পরিবারের সদস্যরা কোনো ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা পর্ষদে চেয়ারম্যান, পরিচালক অথবা ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্বে থাকলে তাও উল্লেখ করতে হবে। একই সঙ্গে সংশ্নিষ্ট ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে নেওয়া ঋণের তথ্য ও বার্ষিক আয়-ব্যয়ের হিসাব থাকতে হবে। প্রতিটি হলফনামা এফিডেভিট, নোটারি পাবলিক ও ম্যাজিস্ট্রেট দ্বারা প্রত্যয়ন করতে হয়। প্রথমবার ঘোষণা দেওয়া তথ্য পরিবর্তন করা যায় না। এতে কোনোভাবেই অসত্য তথ্য দেওয়া যাবে না। কোনো ঘষামাজাও করা যাবে না।
ইসি আগামী ৩০ ডিসেম্বর নির্বাচন, ২৮ নভেম্বর সম্ভাব্য প্রার্থীদের মনোনয়নপত্র দাখিলের শেষ দিন ও ৩০ নভেম্বর মনোনয়নপত্র বাছাইয়ের শেষ দিন ঘোষণা করেছে। নিয়ম অনুযায়ী সম্ভাব্য প্রার্থীরা মনোনয়নপত্রের সঙ্গে যার যার হলফনামা রিটার্নিং অফিসারের কাছে জমা দেবেন। প্রত্যেক জেলা প্রশাসক রিটার্নিং অফিসারের দায়িত্বে আছেন। রিটার্নিং অফিসারের কার্যালয় থেকে মনোনয়নপত্র ও হলফনামা যাচাই-বাছাই করে প্রথমে খসড়া ও পরে চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশ করা হবে। চূড়ান্ত প্রার্থী তালিকা প্রকাশের পর সব দলের প্রার্থীদের হলফনামা ইসির ওয়েবসাইটে দেওয়ার কথা।
হলফনামার সম্পদ নিয়ে দুদকের অনুসন্ধান : দুদকের সাবেক চেয়ারম্যান মো. বদিউজ্জামানের নেতৃত্বাধীন কমিশন সাবেক প্রতিমন্ত্রী ও এমপিদের সর্বশেষ দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের হলফনামা অনুসন্ধান করেছে। একইভাবে ইকবাল মাহমুদের নেতৃত্বাধীন বর্তমান কমিশন কতিপয় এমপির হলফনামা অনুসন্ধান করছে। হলফনামায় মিথ্যা ও অসামঞ্জস্যপূর্ণ তথ্য থাকার ও অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে এর আগের কমিশন ওই সময়কার একাধিক প্রতিমন্ত্রী ও এমপির বিরুদ্ধে মামলা করেছিল। মামলাগুলোর চার্জশিটও দিয়েছিল।
বর্তমান কমিশন চলতি বছরের এপ্রিলে কতিপয় এমপির হলফনামার সম্পদ অনুসন্ধান শুরু করে। তাদের বিরুদ্ধে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগগুলোর অনুসন্ধান চলছে। এর মধ্যে ক্ষমতাসীন দলের একজন এমপিকে অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে।
এমপিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ : বর্তমান কমিশন যেসব চলতি ও সাবেক এমপির বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, মাদক ব্যবসা ও অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ অনুসন্ধান করছে তারা হলেন- আওয়ামী লীগের এমপি মিজানুর রহমান (খুলনা-২), স্বতন্ত্র এমপি কামরুল আশরাফ খান পোটন (নরসিংদী-২), বিএনপির সাবেক এমপি মো. শাহজাহান (নোয়াখালী-৪), আওয়ামী লীগের এমপি নজরুল ইসলাম বাবু (নারায়ণগঞ্জ-২) ও জাতীয় পার্টির এমপি সালাহ উদ্দিন আহম্মেদ মুক্তি (ময়মনসিংহ-৫ মুক্তাগাছা)। জাতীয় সংসদের হুইপ শেরপুর-১ আসনের এমপি আতিউর রহমান আতিককে অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হলেও অন্যদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান অব্যাহত আছে।
দুদক ইসিতে চাহিদাপত্র (রিকুইজিশন লেটার) পাঠিয়ে তাদের হলফনামা সংগ্রহ করেছে। একইভাবে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) থেকে তাদের আয়কর রিটার্নের নথি সংগ্রহ করা হয়েছে। অনুসন্ধান কর্মকর্তারা হলফনামা ও আয়কর নথিতে উল্লেখ করা সম্পদ মিলিয়ে দেখছেন। এছাড়া নানা দিক থেকে তাদের স্থাবর-অস্থাবর, নামে-বেনামের সম্পদ খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
আগের কমিশনের অনুসন্ধান : এর আগে মো. বদিউজ্জামানের নেতৃত্বাধীন কমিশন অবৈধ সম্পদের অভিযোগে ২০১৪ সালের ২১ আগস্ট পটুয়াখালী-৪ আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত আওয়ামী লীগের সাবেক এমপি ও সাবেক পানি সম্পদ প্রতিমন্ত্রী মাহবুবুর রহমান, সাবেক গৃহায়ন ও গণপূর্ত প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আবদুল মান্নান খান ও কক্সবাজার-৪ আসনের বিতর্কিত এমপি আবদুর রহমান বদির বিরুদ্ধে মামলা করে। পরে তাদের বিরুদ্ধে আদালতে চার্জশিটও দেওয়া হয়।
ওই সময় বিরোধী দল বিএনপিসহ বিভিন্ন মহল দুদকের বিরুদ্ধে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের মন্ত্রী-এমপিদের দুর্নীতি এড়িয়ে যাওয়ার অভিযোগ তুলেছিল। এমন পরিস্থিতিতে দুদক খোদ আওয়ামী লীগের তিন প্রভাবশালীর বিরুদ্ধে মামলা করে দুর্নীতি দমন অভিযানে নতুন অধ্যায় সৃষ্টি করে। এই অনুসন্ধানের পর সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী ও এমপি অধ্যাপক ডা. আ. ফ. ম. রুহুল হক (সাতক্ষীরা-৩), এমপি আসলামুল হক (ঢাকা-১৪) ও এমপি প্রকৌশলী এনামুল হককে (রাজশাহী-৪) অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছিল।