সাজেদা কাশেম জ্যোতি
কিডনি রোগীর সংখ্যা আমাদের দেশে দিন দিন বাড়ছে।
ডায়াবেটিস, উচ্চরক্তচাপ, ঘন ঘন ইউরিন ইনফেকশন, অস্বাস্থ্যকর ও অনিয়ন্ত্রিত খাওয়া-দাওয়া, অতিরিক্ত ওজন ছাড়া আরও নানা কারণে কিডনি রোগ হতে দেখা যায়।
পরবর্তী সময়ে যা কিডনি বিকলও করে দিতে পারে। আগে থেকে সচেতন হলে এ সমস্যা থেকে অনেকটাই মুক্তি পাওয়া যায়।
আমরা প্রতিদিন যেসব খাবার খাই, শাকসবজি থেকে শুরু করে ফলমূলসহ সব খাবারেই রয়েছে ভেজাল ও বিষাক্ত রাসায়নিকের উপস্থিতি।
ভেজালের প্রক্রিয়ায় খাদ্যে বিষাক্ত রাসায়নিক, নিুমানের, ক্ষতিকর, অকেজো ও অপ্রয়োজনীয় বহির্জাত দ্রব্য সরাসরি মেশানো বা যোগ করা হয়।
এগুলো কিডনির কার্যক্ষমতা সরাসরি কমিয়ে দেয়, পাশাপাশি যকৃত, চোখ, হৃৎপিণ্ড ইত্যাদির ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলে। তাই বাজারের কেনা শাক সবজি ও ফলাদি কেনার ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন ও কেনার পর ভালো করে ধুয়ে রান্না করা উচিত এবং সঠিক খাদ্যাভ্যাস মেনে চলা উচিত।
কিডনি সুস্থ রাখতে করণীয়
পর্যাপ্ত পরিমাণ পানি পান করুন : প্রতিদিন অন্তত আট গ্লাস পানি বা তরল খাবার খাওয়া উচিত। তবে অতিরিক্ত ঘাম হলে পানি খাওয়ার পরিমাণ আরও বাড়াতে হবে। পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি খেলে কিডনিতে পাথর হয় না এবং এর স্বাভাবিক কার্যক্রম ঠিক থাকে।
লবণ কম খান : খাবারে অতিরিক্ত লবণ খাওয়া কিডনির স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। মানুষের শরীরে প্রতিদিন মাত্র এক চা চামচ লবণের চাহিদা থাকে।
প্রাণিজ প্রোটিন অতিরিক্ত খাওয়া থেকে বিরত থাকুন : গরুর মাংস, খাসির মাংস, শুকরের মাংস ইত্যাদি খেলে কিডনির ওপর অতিরিক্ত চাপ পড়ে।
খাবার তালিকায় অতিরিক্ত প্রোটিন থাকলে কিডনির ওপর চাপ পড়ে এবং কিডনির দুর্বল কোষগুলোর ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা থাকে। তাই অতিরিক্ত প্রাণিজ প্রোটিন এড়িয়ে মাছ বা ডাল জাতীয় প্রোটিন খাবার তালিকায় রাখুন।
রক্তচাপ স্বাভাবিক রাখুন : রক্তচাপ ১৪০/৯০ এর ওপরে থাকলে কিডনির সমস্যা হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়। তাই কিডনি ভালো রাখতে রক্তচাপ সব সময় ১৩০/৮০ অথবা এর কম রাখার চেষ্টা করুন।
রক্তচাপ কমিয়ে রাখতে নিয়মিত ব্যায়াম করা ও লবণ কম খাওয়া জরুরি। পনির, চিপস্, আচার, চানাচুর ইত্যাদি লবণ সমৃদ্ধ খাবার, বিভিন্ন ফ্লেভার মেশানো খাবার, মাখন, পনির, ক্রিম, চকলেট মিল্ক, সসেজ, চিপস, আচার, সয়াসস ইত্যাদি যে কোনো প্রোসেসড তৈরিকৃত খাবার অতিরিক্ত মাত্রায় গ্রহণ থেকে বিরত থাকুন।
ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখুন : ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে না রাখলে কিডনির রোগের ঝুঁকি বেড়ে যায়। তাই নিয়মিত রক্তের সুগারের পরিমাণ পরীক্ষা করান। সুগার বেশি থাকলে মিষ্টি জাতীয় খাবার এড়িয়ে চলুন।
ওষুধ খাওয়ার ক্ষেত্রে সাবধান : কম বেশি প্রায় সব ওষুধই কিডনির জন্য ক্ষতিকর। বিশেষ করে ব্যথানাশক ওষুধগুলো কিডনির জন্য একেবারেই ভালো নয়।
নিয়ম না জেনে নিজে নিজে ওষুধ কিনে খেলে আপনার অজান্তেই কিডনির বড় কোনো ক্ষতি হয়ে যাবে। তাই যে কোনো ওষুধ খাওয়ার আগে চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে নিন।
কোমল পানীয় ত্যাগ করুন : অনেকেই পানির বদলে কোমল পানীয় বা বিভিন্ন রকমের এনার্জি ড্রিঙ্কস খেয়ে থাকেন। এ ধরনের পানীয়গুলো কিডনির জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর।
ধূমপান ও মদ্যপান ত্যাগ করুন : ধূমপান ও মদ্যপানের কারণে ধীরে ধীরে কিডনিতে রক্ত চলাচল কমে যেতে থাকে এবং এর ফলে কিডনির কর্মক্ষমতাও হ্রাস পায়। ফলে ধূমপায়ী ও মদ্যপায়ী ব্যক্তি এক পর্যায়ে গিয়ে কিডনির রোগে আক্রান্ত হয়।
নিয়মিত কিডনির পরীক্ষা করান : উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, অতিরিক্ত ওজন অথবা পরিবারের কারও কিডনি সমস্যা থাকলে কিডনি রোগ হওয়ার ঝুঁকি বেশি থাকে। যাদের কিডনি রোগের ঝুঁকি আছে তাদের অবশ্যই নিয়মিত কিডনি পরীক্ষা করানো উচিত।
কিডনির স্বাস্থ্য পরীক্ষা : নিয়মিত কিডনির স্বাস্থ্য পরীক্ষা করুন, বিশেষত পরিবারে কারও যদি এ রোগের ইতিহাস থাকে তবে এ রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে।
* ডায়াবেটিস রোগীদের কিডনিতে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা অনেক বেশি থাকে। তাই ডায়াবেটিস রোগীদের এ বিষয়ে আরও সচেতন হতে হবে তাহলে ডায়াবেটিস এর কারণে সৃষ্ট বিভিন্ন কিডনিবিষয়ক জটিলতা থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব।
* অনিয়ন্ত্রিত উচ্চরক্তচাপ কিডনির স্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকিস্বরূপ, এটি কিডনিকে অকেজো করার পাশাপাশি শরীরের অন্যান্য সমস্যা যেমন- হার্ট ফেইলিউর, স্ট্রোক ইত্যাদি করে থাকে। তাই নিয়মিত ও নিয়মমাফিক রক্তচাপ পরীক্ষা জরুরি।
* ব্যায়াম না করা, উচ্চ ক্যালরি যুক্ত খাবার গ্রহণ, অস্বাস্থ্যকর খাবার গ্রহণ, অতিরিক্ত ওজন ইত্যাদি উচ্চরক্তচাপ ও ডায়াবেটিসের জন্য ঝুঁকি হিসেবে কাজ করে যা কিডনি রোগের জন্য মারাত্মক আকার হিসেবে দেখা দেয়।
* ধূমপান ফুসফুসের জন্য ক্ষতিকারক। এটি বিভিন্ন কিডনি রোগের ঝুঁকিও বাড়িয়ে দেয়।
* অপর্যাপ্ত পানি পান কিডনির ওপর চাপ ফেলে। নিয়মিত পর্যাপ্ত পানি পানে কিডনি থাকে সুস্থ ও সবল।
পরিবারের সব সদস্যের পাশাপাশি মেয়েদের ও গর্ভবতী মায়েদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কথা চিন্তা করে বুঝে শুনে ও দেখে খাদ্যাভ্যাস ও নিমকানুন মেনে চলা এখন সময়ের চাহিদা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই সুস্বাস্থ্য বজায় রাখতে সঠিক খাদ্যাভ্যাস মেনে চলুন প্রয়োজনে একজন অভিজ্ঞ পুষ্টিবিদের পরামর্শ গ্রহণ করুণ।
লেখক : পুষ্টিবিদ, গণস্বাস্থ্য ডায়ালাইসিস সেন্টার, নির্বাহী পরিচালক, বাংলাদেশ ডায়েটেটিক্সস অ্যান্ড নিউট্রিশন ট্রাস্ট