আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, স্বাধীনতাবিরোধীরা রাষ্ট্র ক্ষমতায় থাকলে তা হবে মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধারণকারীদের জন্য গ্লানিকর। তাই ছোটখাটো ভুলত্রুটি থাকলে তা ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখে আগামী ৩০ ডিসেম্বর নির্বাচনে নৌকা মার্কায় ভোট দিতে তিনি দেশবাসীর প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানান।
আজ মঙ্গলবার সকালে প্যান প্যাসিফিক হোটেল সোনারগাঁওয়ে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহার ঘোষণাকালে শেখ হাসিনা এসব কথা বলেন। ‘সমৃদ্ধির অগ্রযাত্রায় বাংলাদেশ ’ শিরোনামে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ইশতেহার ঘোষণা করেছে আওয়ামী লীগ। ২০০৮ সালের ‘দিনবদলের সনদ’, ২০১৪ সালের ‘এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ’ এরপর আসন্ন ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ইশতেহারের শিরোনাম দেওয়া হয়েছে ‘সমৃদ্ধির অগ্রযাত্রায় বাংলাদেশ’।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, মানুষ মাত্রই ভুল হয়। কাজ করতে গিয়ে আমার ও আমার সহকর্মীদের ভুল হতে পারে। যদি কোনো ভুল হয়ে থাকে তা ক্ষমা-সুন্দর দৃষ্টিতে দেখতে দেশবাসীর প্রতি অনুরোধ জানান প্রধানমন্ত্রী।
তিনি বলেন, আমার কোনো ব্যক্তিগত চাওয়া-পাওয়ার কিছু নেই। বাবা, মা ভাই-বোনকে হারিয়ে রাজনীতি করছি শুধু মানুষের কল্যাণের জন্য। আওয়ামী লীগই পারবে দেশকে সামনে দিকে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে।
প্রতিটি ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের দলীয় অবস্থান, গত ১০ বছরের অর্জন এবং আগামী দিনের লক্ষ্য ও পরিকল্পনা ধরে সাজানো হয়েছে ৮০ পৃষ্ঠার এই ইশতেহার। লিখিত ইশতেহারে বলা হয়, ‘আমরা বিভেদ, হানাহানি, জ্বালাও-পোড়াও, অগ্নিসন্ত্রাস, অবরোধ বিশৃঙ্খলার রাজনীতি চাই না। চাই গণতান্ত্রিক পরিবেশে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন। এ নির্বাচনে আমরা জাতীয় ঐক্যমতের ভিত্তিতে সবার অংশগ্রহণ নিশ্চিত করেছি।’ আওয়ামী লীগ বলছে, জনগণের রায়ে আবার ক্ষমতায় যেতে পারলে দেশ থেকে সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ, মাদক, সাম্প্রদায়িকতা ও দুর্নীতি নির্মূল করে গণতন্ত্র ও আইনের শাসনকে সুসংহত করবে। সমাজের সকল পর্যায়ে নারীর প্রতিনিধিত্ব ও ক্ষমতায়নে তারা বদ্ধপরিকর। সেবামুখী দক্ষ জনপ্রশাসন ও জনহিতৈষী আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী গড়ে তুলে দুর্নীতিমুক্ত সুশাসন-ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে জনগণের জন্য শান্তিশৃঙ্খলা ও সমৃদ্ধির নিশ্চয়তা বিধান করারও প্রতিশ্রুতি দিয়েছে আওয়ামী লীগ।
ইশতেহারে বলা হয়েছে, ‘আসুন আমরা সবাই মিলে এমন এক বাংলাদেশ গড়ে তুলি যেখানে মানুষের মৌলিক সব চাহিদা পূরণ নিশ্চিত হবে, গড়ে উঠবে সহিষ্ণু গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা, নিশ্চিত হবে সামাজিক ন্যায়বিচার, যার যার ধর্ম পালনে স্বাধীনতা ও সম-অধিকার, নারীর অধিকার ও সুযোগের সমতা, তরুণদের শ্রম ও মেধার সৃজনশীল বিকাশ, আইনের শাসন, মানবাধিকার, সুশাসন, শহর ও গ্রামের বৈষম্য দূরীকরণ, দূষণমুক্ত পরিবেশ। গড়ে উঠবে এক অসাম্প্রদায়িক প্রগতিশীল বিজ্ঞানমনস্ক উদার গণতান্ত্রিক কল্যাণ-রাষ্ট্র।
ইশতেহার ঘোষণা অনুষ্ঠানের শুরু হয় জাতীয় সঙ্গীতের মাধ্যমে। পরে আওয়ামী লীগের শাসনমালের উন্নয়নের বিবরণ তুলে ধরা হয় তথ্যচিত্রের মাধ্যমে। আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহার প্রণয়ন উপ-কমিটির আহ্বায়ক ও দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য ড. আব্দুর রাজ্জাকের স্বাগত বক্তব্যের পর সংক্ষিপ্ত বক্তব্য দেন দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। তারপর মঞ্চে এসে ইশতেহার ঘোষণা শুরু করেন দলীয় সভানেত্রী শেখ হাসিনা। মন্ত্রিসভার সদস্যবৃন্দ, কূটনীতিক ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন।
২১ বিশেষ অঙ্গীকারে যা আছে
‘আমার গ্রাম, আমার শহর’ শিরোনামে গ্রামভিত্তিক উন্নয়ন তথা গ্রামে আধুনিক সুবিধার উপস্থিতি, শিল্প উন্নয়ন, স্থানীয় সরকার, স্বাস্থ্য, যোগাযোগ, জলবায়ু পরিবর্তন ও সুরক্ষা, মুক্তিযোদ্ধাদের কল্যাণ, ক্রীড়া, সংস্কৃতি, প্রতিরক্ষাসহ অন্যান্য খাতে থাকছে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা। ইশতেহারে ২১টি অঙ্গীকার উল্লেখ করা হয়েছে। এগুলো হলো-১. আমার গ্রাম, আমার শহর- গ্রতিটি গ্রামে আধুনিক নগর সুবিধা সম্প্রসারণ। ২. তারুণ্যের শক্তি-বাংলাদেশের সমৃদ্ধি: তরুণ যুব সমাজকে দক্ষ জনশক্তিকে রূপান্তরিত করা এবং কর্মসংস্থানের নিশ্চয়তা। ৩. দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ। ৪. নারীর ক্ষমতায়ন, লিঙ্গ সমতা ও শিশুকল্যাণ। ৫. পুষ্টিসম্মত ও নিরাপদ খাদ্যের নিশ্চয়তা। ৬. সন্ত্রাস-সাম্প্রদায়িকতা-জঙ্গিবাদ ও মাদক নির্মূল। ৭. মেগা প্রজেক্টগুলোর দ্রুত ও মানসম্মত বাস্তবায়ন। ৮. গণতন্ত্র ও আইনের শাসন সুদৃঢ় করা। ৯. দারিদ্র্য নির্মূল। ১০ সকল স্তরে শিক্ষার মান বৃদ্ধি। ১১. সকলের জন্য মানসম্মত স্বাস্থ্যসেবার নিশ্চয়তা। ১২. সার্বিক উন্নয়নে ডিজিটাল প্রযুক্তির অধিকতর ব্যবহার। ১৩. বিদ্যুত্ ও জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চয়তা। ১৪. আধুনিক কৃষি ব্যবস্থা- লক্ষ্য যান্ত্রিকিকরণ। ১৫. দক্ষ ও সেবামুখী জনপ্রশাসন। ১৬. জনবান্ধব আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা। ১৭ ব্লু ইকোনোমি- সমুদ্র সম্পদ উন্নয়ন। ১৮. নিরাপদ সড়কের নিশ্চয়তা। ১৯ . প্রবীণ, প্রতিবন্ধী ও অটিজম কল্যাণ। ২০. টেকসই উন্নয়ন ও অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ। ২১. সরকারি ও বেসরকারি বিনিয়োগ বৃদ্ধি। এদিকে ইশতেহারে জাতীয় প্রেসক্লাবের বহুতল ভবন করার অঙ্গীকার করা হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জয়ী হয়ে দায়িত্ব পেলে আগামী ৫ বছরে জিডিপি ১০ শতাংশে উন্নীত করা হবে। ২০২১ সালে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পালনকালে বাংলাদেশ হবে মধ্যম আয়ের দেশ। ২০৩০ সালে বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু আয় দাঁড়াবে ৫ হাজার ৪৭৯ ডলারেরও বেশি। ২০৪১ সালে উন্নত দেশ হিসেবে বিশ্বের বুকে মাথা তুলে দাঁড়াবে বাংলাদেশ। দারিদ্র্যের হার নেমে আসবে শূন্যের কোঠায়।