নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন প্রদান নিয়ে বিএনপি’র বিরুদ্ধে বাণিজ্যের অভিযোগ তুলে আওয়ামী লীগ সভাপতি এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, তারা এখন নির্বাচনে হয় কারচুপি না হয় বানচালের ষড়যন্ত্র করছে।
তিনি বলেন, তারা (বিএনপি) এক একটি আসনে ৩ থেকে ৪ জন প্রার্থীকে মনোনয়ন দিয়েছে এবং এসব আসন তারা অকশনে দিয়ে দিয়েছে। এর মানে হচ্ছে যে যত বেশি টাকা দেবে সে মনোনয়ন পাবে।
শেখ হাসিনা বলেন, বিএনপি নির্বাচনে অবৈধ টাকা ওড়াচ্ছে, এটাই তাদের চরিত্র। তারা নির্বাচনকে হয় বানচাল না হয় ভোট কারচুপির চক্রান্ত করছে।
‘দেশবাসীকে বলবো তারা জনগণের অর্থ আত্মসাৎ করেছে তাই জনগণের অর্থ জনগণের কাছে পৌঁছাক তাদের অর্থ নেন, আর নৌকা মার্কায় ভোট দেন,’-যোগ করেন তিনি।
আজ অপরাহ্নে রাজধানীর ধানমন্ডির সুধাসদনের বাসভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে শেখ হাসিনা রাজশাহী, নড়াইল, জয়পুরহাট ও গাইবান্ধার নির্বাচনী সমাবেশে এ কথা বলেন।
আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখা এবং আবারো জনগণের সেবা করার সুযোগ দিতে তার দলকে পুনঃনির্বাচিত করতে দেশবাসীর প্রতি আহবান জানান।
তিনি বলেন, ‘আমরা ইতোমধ্যে দেশে অনেক প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছি। এছাড়া অনেক মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নাধীন রয়েছে। এজন্য আমি আওয়ামী লীগের নির্বাচনী প্রতীক নৌকা মার্কায় ভোট দিয়ে উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখা এবং জনগণকে আবারো সেবা করার সুযোগ দিতে দেশবাসীর প্রতি আহবান জানাই।’
জনসভায় শেখ হাসিনা নৌকার এবং মহাজোটের প্রার্থীদের সঙ্গে জনগণের পরিচয় করিয়ে দেন এবং স্থানীয় নেতৃবৃন্দের সঙ্গে মত বিনিময় করেন।
আওয়ামী লীগ সভাপতি তাঁর দলের মনোনয়ন প্রদানের প্রসঙ্গ তুলে সংগঠনের মাঠ পর্যায়ের জরিপ এবং স্থানীয় জনপ্রিয়তার প্রতি গুরুত্ব প্রদানের ইঙ্গিত করে বলেন, অনেকেই প্রার্থী হতে চেয়েছিলেন কিন্তু সকলকে আমরা মনোনয়ন দিতে পারিনি। তবে, বিগত নির্বাচনগুলোতে আমরা দেখেছি কিভাবে নির্বাচনে জয়ী হওয়া যায় সেভাবেই সে ধরনের প্রার্থী আমরা দিয়েছি।
তিনি বিএনপি’র ষড়যন্ত্র সম্পর্কে জনগণকে সচেতন করে দিয়ে বলেন, ‘আমি আরেকটি কথা শুনতে পাচ্ছি নির্বাচনের সময় তারা মুজিব কোর্ট পরে, নৌকার ব্যাজ লাগিয়ে ভোটকেন্দ্রে গিয়ে গোলমাল করবে, ভোট কারচুপি করবে এবং আওয়ামী লীগের ওপর দোষ চাপাবে।’
কারণ, হিসেবে তিনি যুক্তি তুলে ধরেন, ‘তারা (বিএনপি) একেক জন অগাধ সম্পত্তির মালিক। মানি লন্ডারিং, অস্ত্র চোরাকারবারী, এতিমের অর্থ আত্মস্যাৎ- বিভিন্ন পন্থায় তারা এতটাকা কামাই করেছে, বিএনপি-জামায়াত জোটের টাকার কোন অভাব নেই।’
তিনি বলেন, ‘একটা জিনিস লক্ষ্য করবেন নির্বাচনের স্বাভাবিক প্রচার-প্রচারণায় তারা নেই। কারণ, তারা এখন চক্রান্তে ব্যস্ত, ষড়যন্ত্রে ব্যস্ত। নেতারা প্রতিদিন নির্বাচন কমিশনে নালিশ করে, অন্যদিকে তারা নির্বাচন বানচালের চক্রান্ত করে।’
‘আমি আরেকটি জিনিস শুনলাম তারা ভুয়া ব্যালট পেপার ছাপাচ্ছে। তারা এইভাবে দুর্নীতি, চক্রান্ত করার চেষ্টা করছে। তাদের এই চক্রান্ত থেকে জনগণের ভোটের অধিকারকে রক্ষা করতে হবে, ’যোগ করেন প্রধানমন্ত্রী।
শেখ হাসিনা বলেন, তারা একটা জিনিসই পারে প্রতিপক্ষের ওপর দোষ চাপাতে। ইতোমধ্যে আমাদের অনেকগুলো নির্বাচনী অফিস তারা আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছে। আমাদের কর্মীদেরকেও হত্যা করেছে।
নেতা-কর্মী ও দেশবাসীর উদ্দেশ্যে বঙ্গবন্ধু কন্যা বলেন, যারা অর্থশালী তাদের অর্থ নেন আর নৌকা মার্কায় ভোট দেন। কেননা, নৌকা মার্কায় ভোট না দিলে দেশে শান্তি থাকবে না, গণতন্ত্র থাকবে না, দেশ উন্নতও হবে না। আর কোথায় চক্রান্ত হচ্ছে এটা খুঁজে বের করতে হবে। আমার কাছে তাদের চক্রান্তের এ রকম অনেক তথ্য রয়েছে ।
তারা (বিএনপি-জামাযাত) নৌকার ব্যাজ লাগিয়ে ধানের শীষে ভোট প্রদান এবং ভোটকেন্দ্রে গোলমালের মত ঘটনা এর আগের বিভিন্ন নির্বাচনেও (পৌরসভা, সিটি কর্পোরেশ, উপনির্বাচনসহ বিভিন্ন স্থানীয় সরকার নির্বাচনে) ঘটিয়েছে। তারা সিল মেরে আওয়ামী লীগের নাম দিয়েছে, অভিযোগ করেন প্রধানমন্ত্রী।
শেখ হাসিনা বলেন, আওয়ামী লীগ জানে, আজকে সারা বাংলাদেশে নৌকার পক্ষে জোয়ার। প্রত্যেকটি মানুষ নৌকার পক্ষে ভোট দিতে উদগ্রীব, আমার মা-বোনেরা আজ ব্যাপকভাবে রাস্তায় নেমে এসেছে, তরুণ সমাজ নেমে এসেছে। এই তরুণ সমাজের জন্যই আমরা বিভিন্ন কর্মসূচি হাতে নিয়েছি। আমাদের নির্বাচনী ইশতেহারেও সে কথা উল্লেখ করেছি।
তিনি এ সময় যে সব আসনে মহাজোট এবং নৌকার উভয়েরই প্রার্থী রয়েছে এমন আসনগুলোতেও বিএনপি যেন জিততে না পারে সেজন্য নৌকা সমর্থকদের সতর্ক করে দেন এবং সকলকে একযোগে কাজ করার আহবান জানান।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আওয়ামী লীগ সুষম উন্নয়নে বিশ্বাস করে। আগামী নির্বাচনে জয়ী হলে আমরা কী কী কাজ করব তা আমাদের ইশতেহারে বলে দিয়েছি। মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনে আমরা কী কী কাজ করব সেটাও বলে দেয়া হয়েছে। সার্বিকভাবে দেশের উন্নয়ন প্রক্রিয়াকে অব্যাহত রাখব, সেই লক্ষ্য নিয়েই দেশের জনগণের কাছে উপস্থিত হয়েছি।
আগামীতে আওয়ামী লীগ যদি সরকারে আসতে পারে তাহলে দেশের চলমান উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা যেন দারিদ্র্যমুক্ত এবং ক্ষুধামুক্ত হয় আমরা সে বিষয়টি লক্ষ্য নিয়ে কাজ করে যাচ্ছি।
তিনি বলেন, ২০২০ সালে আমরা জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকী পালন করব এবং ২০২১ সালে স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী পালন করব। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী এবং জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্ম শতবার্ষিকী অর্থাৎ ২০২০ সালের মার্চ থেকে ২০২১ সালের মার্চ পর্যন্ত আমরা ‘মুজিব বর্ষ’ হিসেবে ঘোষণা করেছি।
আওয়ামী লীগ সভাপতি বলেন, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থেকে বঙ্গবন্ধুর জন্ম শতবার্ষিকী এবং স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী যেন সাড়ম্বরে পালন করতে পারে, নৌকা মার্কায় ভোট দিয়ে সে সুযোগটাই যেন জনগণ করে দেন।
প্রধানমন্ত্রী রাজশাহী সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মেয়র পদে আওয়ামী লীগ প্রার্থীকে নির্বাচিত করার জন্য রাজশাহীর মানুষের প্রতি কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ জানান।
তিনি বলেন, রাজশাহীর মানুষের উন্নয়নের জন্য আমরা নানা পদক্ষেপ এরই মধ্যে নিয়েছি। রাজশাহী শহররক্ষা বাঁধ নির্মাণ থেকে শুরু করে রাস্তাঘাট নির্মাণ, রাজশাহী মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাসহ নানা প্রকল্প বাস্তবায়ন হয়েছে। আগামীতেও রাজশাহীর উন্নয়ন হবে। রাজশাহীতে আন্তার্জাতিক টেস্ট ক্রিকেট ভেন্যুও করা হবে।
আগামীতে আরো উন্নয়নের জন্য রাজশাহীর ছয়টি আসনেই নৌকা ও মহাজোটের প্রর্থীদের বিজয়ী করার আহবান জানান তিনি।
শেখ হাসিনা বলেন, এই রাজশাহীতে বাংলা ভাইয়ের জঙ্গিবাদের উত্থান হয়েছিল। তারা প্রকাশ্যে মানুষ খুন করেছে। আওয়ামী লীগের অনেক নেতাকর্মীকে প্রকাশ্যে হত্যা করেছে নির্যাতন করেছে। কিন্তু এই রাজশাহীতে এখন শান্তি বিরাজ করছে। আমরা এই রাজশাহীর উন্নয়ন করেছি।
তিনি বলেন, রাজশাহীতে কর্মসংস্থান, ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসারে দৃষ্টি রাখা হয়েছে। রাজশাহীর এয়ারপোর্ট বন্ধ ছিল। আমরা তা চালু করেছি। ২০০৮ সাল থেকে দেশ ও জনগণের সেবা করে যাচ্ছি। তা অব্যাহত থাকবে। কারণ, বাজেট প্রণয়নের সময় আমরা ইশতেহারকে সামনে রখেই কাজ করি।
তিনি বলেন, এজন্য আমি আপনাদের কাছে চাই যে রাজশাহী সিটি করপোরেশন নির্বাচনে যেভাবে আমাদের প্রার্থীকে নির্বাচিত করেছেন একইভাবে আসন্ন সাধারণ নির্বাচনেও আওয়ামী লীগ ও মহাজোট প্রার্থীকে বিজয়ী করবেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ক্ষমতায় আসতে হলে আমাদের নেতা-কর্মীদের ঐকবদ্ধ হয়ে কাজ করতে হবে এবং নৌকাকে জিতাতে হবে।
নড়াইল-২ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী জাতীয় ওয়ান ডে ক্রিকেট দলের অধিনায়ক মাশরাফি বিন মর্তুজাকে ‘হীরার টুকরা’ আখ্যায়িত করে ভাষণে তাঁর জন্য ভোট প্রত্যাশা করেন শেখ হাসিনা।
তিনি বলেন, মাশরাফি হীরার টুকরা, সোনার ছেলে, ক্রিকেট খেলোয়াড়। তার নেতৃত্বে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে আমরা হারিয়েছি। আপনারা মাশরাফিকে ভোট দেবেন। মাশরাফি তার পায়ের ব্যথার জন্য নড়াইলে যেতে পারেনি। তাকে আমার কাছে রেখেছি।
শেখ হাসিনা বলেন, এর আগে নড়াইলের দু’টি আসন থেকে আমি নির্বাচন করেছিলাম। এবার নড়াইল-১ আসনে বিএম কবিরুল হক মুক্তিকে ও নড়াইল-২ আসনে মাশরাফিকে দিয়ে নির্বাচন করাচ্ছি। আপনারা উন্নয়ন অব্যাহত রাখতে নৌকা মার্কায় ভোট দেবেন। নড়াইল দু’টি সিটই আমাকে উপহার দেবেন। তিনি বলেন, যারা মনোনয়ন পাননি তারাও নৌকাকে বিজয়ী করার জন্য কাজ করবেন।
ভিডিও কনফারেন্সে মাশরাফি নড়াইলবাসীর উদ্দেশ্যে বলেন, ‘আমাকে নৌকা মার্কায় মনোনয়ন দেয়ায় প্রধানমন্ত্রীর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাই। হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি গভীর সম্মান ও সমবেদনা প্রদর্শন করি। আমার পায়ের ব্যথার জন্য নড়াইলে আসতে দেরি হচ্ছে। আমি অচিরেই এসে সবার সঙ্গে যোগাযোগ করে নৌকায় ভোট চাইবো।’
তিনি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে নড়াইলবাসীর উদ্দেশ্যে বলেন, ‘নড়াইলবাসী আমার জন্য নির্বাচনী প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছেন। আমি সবার প্রতি কৃতজ্ঞ।’
শেখ হাসিনা গাইবান্ধা এবং জয়পুরহাটের উন্নয়ন চিত্র তুলে ধরে তাঁর পৃথক ভাষণে নিজেদের মধ্যকার সকল ভেদাভেদ ভুলে নৌকা এবং মহাজোটের প্রার্থীদের বিজয়ী করার জন্য সকলকে একযোগে কাজ করার আহবান জানান।
পাশাপাশি তাঁর সরকারের উন্নয়ন কর্মকান্ড এবং ভবিষ্যত পরিকল্পনা বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভোটারদের কাছে তুলে ধরারও আহবান জানান তিনি।
তিনি দৃঢ় আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেন, ‘তারুণ্যের শক্তিকে কাজে লাগিয়েই আমরা দেশকে উন্নত করবো, দেশ সমৃদ্ধশালী হবে, দেশ জাতির পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ হিসেবে গড়ে উঠবে।’
বঙ্গবন্ধু কন্যা বলেন, ‘যে সমস্ত মেগা প্রজেক্ট আমরা নিয়েছি সেগুলো বাস্তবায়ন করে আমরা আর্থসামাজিক উন্নয়ন করবো। সেই লক্ষ্য নিয়েই আমাদের এই নির্বাচনী প্রচারণা।’