মির্জা মেহেদী তমাল
যুবকটি ভীষণ অস্থির। প্রেমিকাকে কাছে টেনে বার বার বলে যাচ্ছে, ‘চলো বিয়ে করি’। কিন্তু প্রেমিকার একই জবাব, আর কয়েকদিন পর। বাবা মা হজ্বে যাচ্ছেন। উনারা ফিরে আসলেই বিয়ে করব আমরা। কিন্তু কোনো কথাই শুনতে চাচ্ছে না যুবক। হঠাৎ যুবকটি তার প্রেমিকার হাত চেপে ধরল। তাকে নিয়ে গেল একটি মসজিদের সামনে। প্রেমিকা কিছুৃই বুঝতে পারছিল না। কী করতে চাচ্ছে সে! যুবকটি হঠাৎ মসজিদের দেওয়াল ছুঁয়ে বলতে লাগল, ‘মসজিদ ছুঁয়ে শপথ করছি, তোমাকে কোনো দিন ছেড়ে যাব না। তোমাকে ছাড়া আমার জীবন বৃথা। তোমাকে না পেলে আমি আজ এখনই আত্মহত্যা করব। তোমার সামনে রাস্তায় গাড়ির নিচে ঝাঁপিয়ে পড়ব। তখন আর আমাকে খুঁজেও পাবে না।’ যুবকটির এমন সরল স্বীকারোক্তি আর চোখে মুখে ভেসে ওঠা পাওয়ার আকুলতায় মেয়েটির চোখে পানি চলে আসে। তাকে এতটাই ভালোবাসে-এমন ভাবনায় মেয়েটি ছেলেটির হাত ধরে বলে, ‘চলো বিয়ে করি, আজ এখনই’। মুহূর্তেই যুবকটির চোখে মুখে খুশির ঝিলিক। রাস্তাতেই জড়িয়ে ধরতে চায় প্রেমিকাকে। কিন্তু নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে ভালোবাসার মানুষটিকে নিয়ে ছুটতে থাকে নতুন জীবন গড়তে।
ঠিক এভাবেই রাজধানীর উত্তরা থেকে জাকির হোসেন বেপারি তার তরুণী প্রেমিকাকে বিয়ে করতে নিয়ে যায় গাজীপুরে তার এক আত্মীয়ের বাসায়। সেখানেই আগে থেকে প্রস্তুত ছিল কাজী। প্রস্তুত ছিল বিয়ের সাক্ষী হিসেবে আরও দুই নারী-পুরুষ। বিয়ের কাজ ঠিকঠাকভাবেই শেষ হয়। বিয়ের কাজ শেষ হতেই জাকির তার সদ্য বিবাহিত স্ত্রীর কাছে টাকা চায়। তার এটিএম কার্ড ব্লক হওয়ায় টাকা তুলতে পারেনি সে। এ কথা শুনে মেয়েটির একটু খটকা লাগলেও মনের ভুল বলে মেনে নেয়। তার কাছে ছিল ১১ হাজার টাকা। সেই টাকা দেওয়ার পর কাজীর বিল পরিশোধ করে জাকির।
উত্তরা এলাকার একটি ভালো প্রতিষ্ঠানে বড় পদে চাকরি করতেন এই তরুণী। একই এলাকায় চলাফেরা করার সুবাদে রাস্তায় মাঝেমধ্যে জাকিরের সঙ্গে তার দেখা হতো। এরপর ২০১৭ সালের আগস্ট মাসের দিকে জাকির একদিন তার কাছে গিয়ে মোবাইল নম্বর চেয়ে নেন। জাকির তখন নিজেকে একটি বড় প্রতিষ্ঠানের জিএম হিসেবে পরিচয় দেন। মোবাইলে কথা বলার সুবাদে তাদের মধ্যে গড়ে ওঠে প্রেমের সম্পর্ক। এরপর মসজিদ ছুঁয়ে কসম কেটে বিয়েতে রাজি করানো। পরের ইতিহাস একজন ভয়ঙ্কর প্রতারকের। বিয়ের পরের কয়েক মাসে জাকির ওই তরুণীর কাছ থেকে নানা অজুহাতে প্রায় তিন লাখ টাকা হাতিয়ে নেয় এবং সর্বশেষ তার দুটি মোবাইল ও একটি ল্যাপটপ নিয়ে জাকির এখন চম্পট। ওই তরুণী বুঝতে পারে সে প্রতারণার ফাঁদে পড়েছে। খবর নিয়ে জানতে পারে বিয়ের কাজীও ছিল ভুয়া। আর সাক্ষীদেরও কোনো সন্ধান নেই।
জাকির হোসেন বেপারির গ্রামের বাড়ি লালমনিরহাট জেলার আদিতমারী উপজেলায়। জাকির গত ৮ নভেম্বর রাজধানীর মিরপুরের পাইকপাড়া এলাকার এক নারীর সঙ্গে প্রতারণা করতে গিয়ে ধরা পড়েন। তাকে আটকের পরে ওই নারীর মাধ্যমে যোগাযোগ করে প্রতারণার শিকার আরও চার নারী মিলে জাকিরকে প্রকাশ্যে মারধর করে পুলিশে সোপর্দ করেছেন। এরপর ওই দিনই এক নারীর দায়ের করা ধর্ষণ মামলায় জাকিরকে গ্রেফতার করে মিরপুর মডেল থানা পুলিশ।
পুলিশ জাকিরকে জেরা করে। তার ব্যাপারে খোঁজখবর নিতে শুরু করে। পুলিশ তার বিষয়ে যা জানতে পারে, তাতে করে পুলিশ হতবাক। সিনিয়র পুলিশ কর্মকর্তারা বলেছেন, তাদের চাকরি জীবনে জাকিরের মতো এমন ভয়ঙ্কর বিয়ে প্রতারক আর দ্বিতীয়টি দেখেননি। জাকিরের দেওয়া তথ্যে সে প্রতারণার মাধ্যমে ২৮৬টি বিয়ে করেছে। শুধু জাকির নয়, তাদের একটি চক্র রয়েছে, মিষ্টি মিষ্টি কথার মোহে ভুলিয়ে অনেক নারীর সঙ্গে বন্ধুত্ব করে প্রথমে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে তোলেন, এরপর তাদের বিয়ের নাম করে ধর্ষণ করতেন। ধর্ষণ করে টাকা-পয়সা হাতিয়ে নিয়ে পালিয়ে যেতেন। তার গ্রেফতারের পর পুলিশের কাছে অসংখ্য মেয়ে অভিযোগ করেছে তার বিরুদ্ধে। পুলিশ জানতে পেরেছে বিয়ে প্রতারণার ভয়ঙ্কর সব ঘটনা। পুলিশ জানায়, সুদর্শন চেহারার অধিকারী হওয়ায় খুব সহজেই নাকি জাকির এসব কথা বলে সুন্দরী, উচ্চশিক্ষিত ও চাকরিজীবী নারীদের প্রেমের ফাঁদে ফেলতেন। অবশ্য তার প্রেমে পড়া অধিকাংশ নারীর দাবি, এই ব্যক্তি নাকি কোনো সম্মোহনি শক্তি বা ম্যাজিক জানতেন, যার ফলে তার ছুড়ে দেওয়া প্রেমের আবেদন কোনো নারীই প্রত্যাখ্যান করতে পারতেন না। ফলে অধিকাংশ নারীই তার সঙ্গে সারা জীবন কাটাতে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হতেন। কিন্তু সেই বিয়ের প্রক্রিয়াটা ছিল পুরোটাই ভুয়া। অর্থাৎ বিয়েতে কাজী, মৌলভি, বাবা-মা, ভাই-বোন সবাই উপস্থিত থাকতেন। তবে তারা কেউই আসল নন।
পুলিশ জানায়, জাকিরের প্রতারণার শিকার টাঙ্গাইলের ভুঞাপুরের এক নারী। তিনি পুলিশকে জানিয়েছেন, চাকরি চাইতে গিয়ে তিনি জাকিরের খপ্পরে পড়েন। জাকির বিভিন্নভাবে তার সঙ্গে যোগাযোগ করত। তার সঙ্গে ওই পরিচয়ের সূত্র ধরেই প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। আর সম্পর্কের মাত্র এক মাস পরেই স্থানীয় এক কাজীর মাধ্যমে তাদের বিয়ে হয়। ওই নারী আরও বলেন, ‘উনি (জাকির) আমাকে বলেছিল তার নাকি হাউস লোন আছে।
তারা টাকার জন্য চাপ দিচ্ছে, এই বলে আমার কাছ থেকে দফায় দফায় পাঁচ লাখ টাকা নিয়েছে। এরপর আরও পাঁচ লাখ টাকা চেয়েছিল। কিন্তু সেটা দিতে পারিনি বলেই তো আমাকে ছেড়ে চলে গেছে। আমার কাছ থেকে সে প্রায় এক বছর আগে চলে গেছে। আমি তাকে বলেছিলাম আমি তোমাকে জেলের ভাত খাওয়াব। তখন সে আমাকে বলে, ‘আমার কিছুই করতে পারবি না, আমি কাঁচা খেলোয়াড় না। এ পর্যন্ত তোর মতো ২৮৬টা মেয়ের সঙ্গে এ রকম হয়েছে।’ পুলিশ জানতে পারে, নারীদের সঙ্গে প্রতারণা করতে নানা ধরনের মাধ্যম ব্যবহার করতেন জাকির, যার মধ্যে একটি ছিল সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ফেসবুক। এই ফেসবুকের মাধ্যমে জাকির অনেক নারীর সঙ্গে পরিচিত হয়ে তাদের সর্বনাশ করতেন। কিন্তু সম্প্রতি ফেসবুকে পাতানো এক প্রতারণার ফাঁদেই ধরা খেয়েছেন তিনি। কারণ তার দ্বারা প্রতারণার শিকার কয়েকজন নারী ফেসবুকের মাধ্যমে একে অপরের সঙ্গে যোগাযোগ করে একত্রিত হয়েছিলেন। তারা জাকিরকে যেকোনো মূল্যে পুলিশের হাতে তুলে দিতে আপ্রাণ চেষ্টা শুরু করেন। অবশেষে ৮ নভেম্বর ভুক্তভোগী কয়েকজন নারী এক হয়ে জাকিরকে গণপিটুনি দিয়ে পুলিশের হাতে তুলে দেন। আর সর্বশেষে মিরপুর পাইকপাড়া এলাকার যে নারীর সঙ্গে জাকির প্রতারণা করেছিলেন, সেই নারীই বাদী হয়ে থানায় ধর্ষণ মামলা দায়ের করেছেন।
পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, ভালোভাবে খোঁজখবর না নিয়েই মিষ্টি কথার বিষ পান করে সহজ সরল নারীরা বিপদে পড়ে সর্বস্ব হারাচ্ছে। তাই ভালোভাবে খোঁজখবর না নিয়ে কোনো ধরনের সম্পর্কে জড়ানোটা ঠিক নয়।