মির্জা মেহেদী তমাল
রাজধানীর একটি পাঁচ তারকা হোটেলের লবিতে বসে আছেন ব্যবসায়ী মেরাজউদ্দিন (ছদ্মনাম)। আজ তার জীবনের একটা টার্নিং পয়েন্ট বলে মনে করছেন এই ব্যবসায়ী। ব্যবসা বড় হওয়ার কাজ শুরু হয়ে যাবে এদিন। অল্প কিছুদিন হলো কাস্টমসের একজন বড় কর্মকর্তার সঙ্গে তার পরিচয় হয়েছে। সেই কর্মকর্তাই তার ব্যবসার প্রসার ঘটাতে হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। মেরাজ সাহেব ভাবছিলেন, কারও আশীর্বাদ ছাড়া ব্যবসাপাতি বড় করা খুব কঠিন। তার এক বন্ধুও সঙ্গে রয়েছেন। তার সঙ্গে এসব নিয়ে কথাও বলছিলেন। মনে মনে একটু অস্থিরতাও ছিল। কারণ, সেই কর্মকর্তা এখনো এসে পৌঁছেননি। মেরাজ তার বন্ধুকে নিয়ে হোটেলের লবি থেকে গেটের সামনে এগিয়ে যাচ্ছেন। এ সময় তারা দেখতে পান, কালো রঙের একটি প্রাডো গাড়ি এসে থামল তাদের সামনেই। চালকের পাশের সিটে বসা একজন ভদ্রলোক দ্রুত গাড়ি থেকে নেমে পেছনের দরজা খুলে দাঁড়ালেন। ভিতর থেকে বেরিয়ে এলেন তাদের কাক্সিক্ষত সেই ব্যক্তি। স্যুটেড ব্যুটেড। তিনি কাস্টমস কমিশনার। গাড়ি থেকে নেমেই হোটেলের ভিতরে ঢুকে পড়লেন। হাত বাড়িয়ে দিলেন ব্যবসায়ী মেরাজ। কুশল বিনিময়ের পর তারা হোটেলের রেষ্টুরেন্টে গিয়ে বসলেন। সেখানেই তাদের কথা পাক্কা হলো। কাস্টমস হাউসে রাখা জব্দ করা স্বর্ণ অল্প দামে নিলামের ব্যবস্থা করে দেবেন এই কর্মকর্তা। সব ঠিকঠাক থাকলে ব্যবসায়ী মেরাজের ব্যবসা ফুলে ফেঁপে যাবে। সম্পদ বাড়বে কয়েকগুণ। তাই দেরি করতে চান না মেরাজ। কাস্টমসের এই কর্মকর্তার সঙ্গে তাদের কথাবার্তা পাকা করতে চান। কর্মকর্তার চাহিদা মতো মোটা অঙ্কের টাকা ঘুষ দেন সেদিনই। ঘুষের টাকা নিয়ে সেই কর্মকর্তা চলে যান। সেটাই ছিল তার শেষ চলে যাওয়া। ব্যবসায়ী বিপুল অঙ্কের টাকা হাতিয়ে দিশেহারা। তিনি বুঝতে পারেন, প্রতারণার শিকার তিনি। সেই লোকটি ভুয়া কাস্টমস কর্মকর্তা। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সূত্র জানায়, এমন প্রতারকের সংখ্যা অসংখ্য। এরা এতটাই চতুর, বাঘা বাঘা ব্যবসায়ীরাও তাদের কাছে খেই হারিয়ে ফেলেন। অতি লাভের লোভে পড়ে প্রতারককে বিশ্বাস করে ফেলেন। তুলে দেন মোটা অঙ্কের টাকা। কিন্তু টাকা নিয়ে যখন লাপাত্তা বনে যান সেই প্রতারক, তখনই তাদের হুঁশ হয়। কে কাস্টমস কর্মকর্তা বা বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তা তা যাচাই-বাছাই করা উচিত। তাছাড়া এমন অনৈতিক সুবিধা আদায় থেকেও বিরত থাকা উচিত। অন্যথায় প্রতারণার শিকার হলে কারও কিছু করার থাকবে না। প্রত্যেক মানুষকেই সচেতন থাকতে হবে। সিআইডির হাতে গ্রেফতার হয়েছেন এমন ভুয়া কাস্টমস কর্মকর্তা প্রতারক খন্দকার মো. ফারুক ওরফে ওমর মবিন (৫২) ও তার দুই পিএস ইলিয়াস ওরফে নূর ইসলাম সরকার (৩৮) ও সাইফুল ইসলাম (৩০)। মানুষকে প্রতারণার ফাঁদে ফেলার জন্য বিলাসী জীবন যাপন শুরু করে মবিন। চড়তেন প্রাডো গাড়িতে, পরতেন কোট টাই। সঙ্গে দুই পারসোনাল সেক্রেটারি। তারা অভিজাত হোটেলে বসতো ক্লায়েন্ট ধরার জন্য। সেখানেই ক্লায়েন্টদের সঙ্গে আলোচনা করত আর দামি খাবার খেত। বিলাসী জীবনযাপনের লক্ষ্য ছিল ক্লায়েন্টকে কনভিন্স করা। নিজেকে কখনো কাস্টমস কমিশনার আবার কখনো বাংলাদেশ ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা পরিচয় দিয়ে কাস্টমস হাউসের জব্দকৃত স্বর্ণের বার নিলামের মাধ্যমে কম টাকায় কিনে দেওয়ার কথা বলে বিভিন্ন মানুষের কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেয় এই প্রতারক ও তার দুই পিএস। গত ৯ জানুযারি রাতে রাজধানীর রমনা থানাধীন বেইলি রোডের নবাবী ভোজ রেস্টুরেন্টের সামনে থেকে প্রতারক এই চক্রের তিন সদস্যকে গ্রেফতার করেছে সিআইডি। সিআইডির এক কর্মকর্তা বলেন, ‘কাস্টমস হাউসের জব্দ স্বর্ণের বার নিলামের কথা বলে বিভিন্ন মানুষের কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করার অভিযোগ পেয়ে তদন্ত করা হয়। প্রতারকদের মধ্যে খন্দকার ফারুক ওরফে ওমর মবিন নিজেকে কাস্টমস কমিশনার বলে পরিচয় দিতেন আর তার দুই সহযোগী ইলিয়াস ও সাইফুল কমিশনারের পিএস হিসেবে পরিচয় দিতেন। তারা বিভিন্ন মানুষকে টার্গেট করে প্রথমে পিএসদের পাঠাতেন এবং কাস্টমস হাউসের জব্দ সোনার বার নিলামে দেওয়ার কথা বলে কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়। ইতিমধ্যেই বেশ কজন ভুক্তভোগীর বক্তব্যও আমরা পেয়েছি। যারা মোটা অঙ্কের টাকা দিয়েও স্বর্ণের দেখা পাননি।’