ডিজিটাল ডিভাইসে আসক্তি বাড়ছে শিশুদের

দেড় বছরের রাফিদকে (ছদ্ম নাম) খাওয়ানো কিংবা কান্না থামাতে বাবা-মা হাতে মোবাইল তুলে দিত। আস্তে আস্তে টিভি, ল্যাপটপ, মোবাইল, ভিডিওগেমস হয়ে ওঠে রাফিদের সব সময়ের সঙ্গী। ডিজিটাল স্ক্রিনে তাকিয়ে সে তার চারপাশের জগৎ ভুলে যায়। বয়স চার পার হলেও বাবা-মাকে ডাকতে পারে না সে। কথা বলার কোনো ইচ্ছাও নেই তার। উল্টো কার্টুন দেখা বা গেমস খেলার সময় ডাকলে উত্তেজিত হয়ে ভেঙে ফেলে কিংবা ছুড়ে ফেলে দেয় হাতের কাছের তৈজসপত্র।

তার বাবা তৌহিদুর রহমান বলেন, রাফিদের আড়াই বছর পার হওয়ার পর থেকে এরকম উপসর্গ দেখা দেয়। আস্তে আস্তে পরিস্থিতি আরও গুরুতর হলে আমরা চিকিৎসকের শরণাপন্ন হই। তিনি এটাকে হাইপার অ্যাকটিভ সমস্যা বলে আমাদের জানান। চিকিৎসকের পরামর্শে ওর হাতে কোনো ধরনের ডিভাইস না দিয়ে বাইরে খেলতে কিংবা কারও বাসায় বেড়াতে নিয়ে যাই। সামাজিক পরিবেশে মিশে এখন অনেকটা স্বাভাবিক হয়ে উঠেছে রাফিদ। এখন সবাইকে ডাকার পাশাপাশি অন্য শিশুদের সঙ্গে খেলাধুলাও করে। হাইপার অ্যাকটিভ সমস্যাও অনেকটাই কমে গেছে। শুধু রাফিদই নয়, নগরজীবনে অভ্যস্ত অধিকাংশ শিশুরই ডিজিটাল স্ক্রিনে আসক্তি বাড়ছে। মাত্রাতিরিক্ত এ স্ক্রিন আসক্তিতে বাড়ছে অন্ধত্বের ঝুঁকি। মায়োপিয়া বা ক্ষীণদৃষ্টি নিয়ে বেড়ে উঠছে দেশের শিশুদের উল্লেখযোগ্য অংশ।

ইস্পাহানি ইসলামিয়া আই ইনস্টিটিউট অ্যান্ড হসপিটালের রেটিনা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. মমিনুল ইসলাম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, শিশুর যখন দূরের দৃষ্টি তৈরি হওয়ার সময় তখন তারা স্মার্টফোন, ট্যাব কিংবা কম্পিউটারে সময় কাটাচ্ছে। এর ফলে তাদের বাইরের দৃষ্টি তৈরি হচ্ছে না। অতিমাত্রার স্ক্রিননির্ভরতা বড়দের চেয়ে শিশুদের চোখে পাঁচগুণ বেশি ক্ষতি করায় মায়োপিয়াসহ নানা ধরনের চোখের সমস্যা দেখা দিচ্ছে।

তিনি আরও বলেন, ডিজিটাল ডিভাইসে বেশি সময় কাটানোয় শিশুরা স্বাভাবিকভাবে কথা বলতে এবং মিশতে শিখছে না। একটা সময় তাদের মধ্যে হাইপার অ্যাকটিভ প্রবণতা তৈরি হচ্ছে। কিছু গবেষণায় দেখা গেছে, ডিজিটাল ডিভাইস থেকে ছড়ানো তেজস্ক্রিয়তায় বিভিন্নভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে শিশুরা। সাধারণত বয়স ৫০ পার হলে মানুষের চোখে ছানি পড়ে; কিন্তু অতিরিক্ত ডিজিটাল ডিভাইস ব্যবহারকারীদের ৩০ বছরে ছানি পড়ার প্রবণতা লক্ষ করা যাচ্ছে। শুধু তাই নয়, ব্রেনে টিউমার এবং নিদ্রাহীনতার জন্যও ডিজিটাল ডিভাইসের তেজস্ক্রিয়তা অনুঘটক হিসেবে কাজ করে।

শিশুদের মধ্যে ভিডিওগেমস এবং কম্পিউটারে গেমস খেলার প্রবণতা সবচেয়ে বেশি। কম্পিউটারে গেম খেলার নেশাকে মানসিক রোগ হিসেবে তালিকাভুক্ত করতে যাচ্ছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। ১১তম ইন্টারন্যাশনাল ক্লাসিফিকেশন অব ডিজিজেস বা আইসিডিতে এটিকে গেমিং ডিজঅর্ডার হিসেবে উল্লেখ করা হচ্ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এ সংক্রান্ত খসড়া দলিলে এই গেমিং আসক্তিকে বর্ণনা করা হয়েছে এমন এক ধরনের আচরণ হিসেবে, যা জীবনের আর সব কিছুর আকর্ষণ থেকে একজনকে দূরে সরিয়ে নেয়। বিশ্বের কিছু দেশে গেমিং আসক্তিকে ইতিমধ্যে একটি প্রধান জনস্বাস্থ্য সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। মোবাইল কিংবা গেমসে বেশি সময় ব্যয় করার প্রভাব পড়ছে শিশুদের পড়াশোনা এবং ফলাফলেও। আয়ারল্যান্ডের ন্যাশনাল ব্যুরো অব চিলড্রেন (এনবিসি) ২০১৫ সালে ‘আইসিটি অ্যান্ড মি’ নামের একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। দেশটির শিক্ষক ও অভিভাবকদের অনুরোধে প্রায় এক হাজার শিশুর ওপর ২০১২-১৪ সাল পর্যন্ত গবেষণাটি পরিচালিত হয়। ওই প্রতিবেদন বলছে, তিন ঘণ্টার বেশি গেমস খেলে এমন শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৪১ শতাংশ পাঁচটি বিষয়ে ‘এ স্টার’ থেকে ‘মাইনাস সি’ গ্রেড পর্যন্ত পেয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভিডিও গেমসে আসক্ত শিশুদের ব্যাপারে স্কুলশিক্ষক ও অভিভাবকদের অভিযোগ ছিল, তারা স্কুলে নিয়মিত যাচ্ছে না, গেলেও সময়মতো যাচ্ছে না এবং ক্লাসে মনোযোগ দিচ্ছে না।

মনোরোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. মোহিত কামাল বলেন, অতিমাত্রায় ডিভাইস ব্যবহারের কারণে শিশুদের মনোজগতে পরিবর্তন ঘটে যাচ্ছে। মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হওয়ায় শিশুদের আচরণে বিভিন্ন রকমের অস্বাভাবিকতা ফুটে উঠছে। ভিডিও গেমস বা কম্পিউটারের পর্দা থেকে চোখ সরিয়ে শিশুদের খেলার মাঠে পাঠাতে হবে। সামাজিক পরিবেশে বিভিন্ন বয়সী মানুষের সঙ্গে মিশলে শিশুর বিকাশের ধারা গতিশীল হবে। শিশুর ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে অভিভাবকদের ডিজিটাল ডিভাইসের ব্যবহার কমাতে সচেতন হতে হবে।

Others শিক্ষা শীর্ষ সংবাদ