ভূমিকম্প ঝুঁকিতে দেশ: ৮ মাত্রার কম্পন হলে ধ্বংসস্তূপ হবে রাজধানী

হাসান মাহমুদ রিপন দেশে বেশ কয়েক বছর ধরে ঘন ঘন মৃদু, হালকা ও মাঝারি ভূকম্পন অনুভূত হচ্ছে। এগুলোর কোনোটির উত্স বাংলাদেশের কাছে-কিনারে; আবার কোনোটি বহু দূরে। ভূকম্পনের কারণে এ অঞ্চলের ভূ-ফাটল লাইনগুলো নাজুক ও শিথিল হয়ে পড়ছে। বাংলাদেশেই রয়েছে ১২টি ফাটল। টাঙ্গাইলের ফাটলটি খুবই বিপদজনক। ফলে জোরালো ভূমিকম্পের কারণ তৈরি হচ্ছে। রিখটার স্কেলে ৮ কিংবা এর বেশি মাত্রার ভূমিকম্প আঘাত হানলে নেমে আসতে পারে মহাবিপর্যয়। মুহূর্তেই রাজধানী ঢাকা অথবা কোনো একটি জনপদ ধ্বংস স্তূপে পরিণত হতে পারে। জানা গেছে, ভৌগলিক অবস্থানের কারণে রাজধানী ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট ও ময়মনসিংহের মতো জনবহুল শহরগুলো বেশি ঝুঁকিতে আছে। এসব শহরে আকস্মিক আঘাত হানা ভূমিকম্পে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ অন্য প্রাকৃতিক দুর্যোগের তুলনায় বেশি হতে পারে।

ভূতত্ত্ব বিশেষজ্ঞদের মতে, সাম্প্রতিককালে ভূকম্পন প্রবণতা বেড়ে গেছে। এ ধরনের ঘন ঘন মৃদু, হালকা কিংবা মাঝারি মাত্রার ভূকম্পন অদূর ভবিষ্যতে বড় আকারের ভূমিকম্পের অশনি সংকেত। বাংলাদেশ এবং এর সংলগ্ন ভারত ও মিয়ানমারের অবস্থান ভূমিকম্পের বলয়ে (জোন)। এ অঞ্চলে শক্তিশালী ভূমিকম্প আঘাত হানতে পারে যে কোনো সময়ই। অথচ ভূমিকম্প নিয়ে ভয়-আতঙ্ক থাকলেও উপযুক্ত সতর্কতা ও পূর্বপ্রস্তুতির দিক থেকে বাংলাদেশ অনেক পেছনে পড়ে আছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ও ইউএনডিপির দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ এ কে এম মাকসুদ কামাল বলেন, বাংলাদেশের অভ্যন্তরেই ১২টি ভূমিকম্প ফাটল আছে। এ সব জায়গায় ৭.৫ মাত্রার ভূমিকম্প হতে পারে। ঢাকার অদূরে মধুপুর ফাটল খুব বিপজ্জনক। প্রতি ১শ’ বছর পর পর ফাটল থেকে বড় আকারের ভূমিকম্প হয়। ১৮২২ এবং ১৯১৮ সালে বাংলাদেশে বড় ভূমিকম্প হয়েছে। তাই আরেকটি বড় ভূমিকম্পের দ্বারপ্রান্তে আছি আমরা। অথচ ভূমিকম্প নিয়ে উপযুক্ত সতর্কতা ও পূর্বপ্রস্তুতির দিক থেকে ভারত-নেপালের চেয়েও বাংলাদেশ অনেক পেছনে পড়ে আছে। তিনি জানান, ২০০৯ সালে ঢাকা সিটি কর্পোরেশন এলাকার ভবনগুলো নিয়ে জরিপ করা হয়। তাতে দেখা যায় যে, আগামীতে যদি ৭.৫ মাত্রার ভূমিকম্প হয় তাহলে তিন লাখ ২৬ হাজার ভবনের মধ্যে ৭২ হাজার ভবন তাত্ক্ষণিকভাবে ধসে পড়বে। একেবারে অক্ষত থাকবে খুব কম সংখ্যক ভবন। এ ছাড়া গ্যাস, বিদ্যুত্ ও পানির লাইনে বিস্ফোরণ ঘটে এক ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে। ঘটবে মানবিক বিপর্যয়ও? তিনি আরো বলেন, এই দুর্যোগের জন্য আমাদের প্রস্তুতি পর্যাপ্ত নয়। প্রথমত, ভূমিকম্পে যারা গৃহহীন হবেন তাদের আশ্রয় দেয়ার মতো খালি জায়গা নেই ঢাকায়। উদ্ধার কাজের জন্য দক্ষ জনবল এবং যন্ত্রপাতি নেই। নেই পর্যাপ্ত চিকিত্সা সুবিধা। তাছাড়া সাধারণ মানুষের মধ্যে সচেতনতাও নেই। তাই ভূমিকম্পের সময় কী কী করণীয় সে সম্পর্কে অনেকেই জানেন না। ফলে পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ হবে।

মাকসুদ কামাল বলেন, আমাদের এখনই প্রস্তুতি নেয়া উচিত? উচিত বিল্ডিং কোড মেনে ভবন তৈরি করা। পাশাপাশি ঝুঁকিপূর্ণ ভবন সম্পর্কেও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের এখনই সিদ্ধান্ত নেয়া উচিত।
অপরদিকে ন্যাচার জিওসায়েন্সে প্রকাশিত এক জার্নাল থেকে জানা গেছে, বাংলাদেশের ভূপৃষ্ঠের নিচে সম্ভবত বড় ধরনের ভূমিকম্প দানা বাঁধছে। ভূমিকম্পটি খুব দ্রুত ঘটার আশঙ্কা না থাকলেও সেটা অবশ্যম্ভাবী। বাংলাদেশের বিষয়ে বিশেষভাবে উল্লেখ করতে গিয়ে বলা হয়েছে যে, সস্তা নির্মাণ সামগ্রী দিয়ে তৈরি অপরিকল্পিত ভবনসহ ভারি শিল্প, বিদ্যুেকন্দ্র এবং প্রাকৃতিক গ্যাসক্ষেত্র ভূমিকম্পে ধ্বংস হয়ে যেতে পারে?

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়য়ের অতিরিক্ত সচিব (দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা) মো. মোহসীন বলেন, ভূমিকম্পকে অনেক গুরুত্ব দিয়ে আমরা এসওডি সংশোধন করছি। পাশাপাশি প্রতিটি স্কুলে বছরে দুইবার ভূমিকম্পের মহড়া করা হচ্ছে। ধারণা করা হয় বড় একটা ভূমিকম্পের জন্য শক্তি সঞ্চয় করতে ১শ’ বছরের মতো লাগে। নেপালে যখন ২০১৫ সালে ভূমিকম্প হলো সেটা ছিল আমাদের জন্য ওয়েকআপ কল। ১৮৯৭ সালে দ্য গ্রেট ইন্ডিয়ান আর্থকোয়েক হয়েছিল। এ সবকিছু চিন্তা করে মেগা ডিজাস্টার হিসেবে আমরা ভূমিকম্প নিয়ে অনেক কাজ করছি। তিনি বলেন, ভূমিকম্পের প্রস্তুতি মূলত দুই রকমের— সফট অ্যান্ড হার্ড। হার্ড হচ্ছে কনস্ট্রাকশন ভূমিকম্প সহনীয় করাসহ এ সংক্রান্ত বিষয়, আর সফট হচ্ছে ভূমিকম্পের বিষয়ে মানুষকে সচেতন করা। ভূমিকম্প হলে তা সামাল দিতে আমরা গত কয়েক বছরে বিপুল পরিমাণ যন্ত্রপাতি এনেছি। ভূমিকম্প নিয়ে আমাদের ট্রেনিং প্রোগ্রাম হচ্ছে। ভূমিকম্পের সেভাবে কোনো পূর্বাভাস নেই, তাই ভূমিকম্প হয়ে গেলে সেটা কীভাবে সামাল দেব সেই প্রস্তুতিই হচ্ছে মূল বিষয়।

বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদফতরের হিসেবে অনুযায়ী, চলতি বছরে এখন পর্যন্ত দেশে ৫টি ভূমিকম্প হয়েছে। সর্বশেষ গত ২৬ ফেব্রুয়ারি সকাল ১০টা ৫০ মিনিটে ৪ দশমিক ১ মাত্রার ভূমিকম্পের উত্পত্তিস্থল ছিল ঢাকার আগারগাঁও আবহাওয়া অধিদফতর থেকে ৩৭ কিলোমিটার উত্তর-পূর্বে গাজীপুর-নরসিংদী এলাকায়। গত বছর জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ২০টির মতো ভূমিকম্প হয়েছে, যেগুলোর উত্পত্তিস্থল ঢাকা থেকে সাড়ে ৮০০ কিলোমিটারের মধ্যে। ২০১৫ সালে দুটি ভূমিকম্পের কেন্দ্র ছিল দেশের ভিতর। ওই বছরের ৯ জানুয়ারি ৩ দশমিক ৮ মাত্রার ভূমিকম্প হয়েছে, এর কেন্দ্র ছিল ভৈরব বাজার। এ ছাড়া ৮ এপ্রিল ৪ দশমিক ৬ মাত্রার ভূমিকম্প হয়। এর কেন্দ্র ছিল বাগেরহাটের শরণখোলা।

আবহাওয়া অধিদফতরের ভূমিকম্প পরিমাপ কেন্দ্রে কর্মরত আতিকুর রহমান বলেন, ভূমিকম্পর ঝুঁকির ওপর ভিত্তি করে অতি ঝুঁকিপূর্ণ, মাঝারি ঝুঁকিপূর্ণ ও কম ঝুঁকিপূর্ণ বাংলাদেশকে এই তিন ভাগে করা হয়েছে। অতি ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা হিসেবে জোন-১ এর মধ্যে রয়েছে রংপুর, ময়মনসিংহ ও সিলেট বিভাগ। এই জোনটি ভারতের ডাউকি ফল্টের কারণেও সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে। মাঝারি ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে জোন-২-এ রয়েছে রাজশাহী, ঢাকা ও চট্টগ্রাম অঞ্চল। আর কম ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে জোন-৩ এর অধীনে রয়েছে বরিশাল ও খুলনা অঞ্চল।

আবহাওয়াবিদ আতিকুর রহমান বলেন, ‘আসাম ও মিয়ানমার ভূমিকম্পের জন্য খুবই ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চল। এই অঞ্চলগুলো আমাদের খুব কাছে। এজন্য আমরাও ঝুঁকিতে আছি। ভূমিকম্পের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো পূর্বাভাস নেই। ৫শ’ বছরের ভূমিকম্পের ডাটা বিশ্লেষণ করে বলা হচ্ছে, এই অঞ্চল এতটা ঝুঁকিপূর্ণ— যে কোনো সময় হতে পারে, এটা মাথায় রেখেই আমাদের কাজ করতে হবে। তিনি আরো বলেন, বাংলাদেশে ভূমিকম্প পরিমাপের জন্য দশটি স্থানে সিসমোমিটার রয়েছে। এই কেন্দ্রগুলো থেকে ২৪ ঘণ্টা ডাটা ঢাকার কেন্দ্রীয় অফিসের সার্ভারে আসতে থাকে।

ভূ-বিজ্ঞানীদের মতে, বাংলাদেশ ভারতীয়, ইউরেশীয় এবং মিয়ানমার টেকটনিক প্লেটের মধ্যে অবস্থান করছে। ভারতীয় এবং ইউরেশীয় প্লেট দুটি (১৯৩৪ সালের পর থেকে) দীর্ঘদিন যাবত হিমালয়ের পাদদেশে আটকা পড়ে আছে। বাংলাদেশে বেশ কয়েকটি ভূতাত্ত্বিক চ্যুতি এলাকা বা ফল্ট জোন সচল অবস্থায় রয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্থ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স বিভাগের অধ্যাপক ড. এ এস এম মাকসুদ কামাল বলেন, পার্বত্য সীমান্ত আর সিলেট অঞ্চলের ভূঅভ্যন্তরে ৮ মাত্রার ভূমিকম্প সৃষ্টির মতো শক্তি সঞ্চিত হয়ে আছে। যেখানে ভূমিকম্প হলে সিলেট, চট্টগ্রাম, ঢাকা, ময়ময়নসিংহসহ জনবহুল শহরগুলোতে বড় বিপর্যয় নেমে আসতে পারে।

গবেষকরা বলছেন, ভৌগলিক অবস্থানের কারণে বাংলাদেশ ভূমিকম্প প্রবণ এলাকা। ইন্ডিয়ান, ইউরোপিয়ান এবং বার্মিজ এই তিনটি গতিশীল প্লেটের সংযোগস্থলে বাংলাদেশের অবস্থান। আর এগুলোর মধ্যে সিলেট ও পার্বত্য চট্টগ্রাম সীমান্তের ভূঅভ্যন্তরে যে শক্তি সঞ্চিত হয়েছে তা বড় মাত্রার ভূমিকম্পের কারণ হতে পারে।
ভূমিকম্পে লিকুইফেকশন হওয়া খুবই ভয়ঙ্কর। কারণ ভূমিকম্পে লিকুইফেকশন ক্ষয়ক্ষতি, ধংস ও প্রাণহানির সংখ্যা বেড়ে যায় বহুগুণ। লিকুইফেকশনকে সহজ বাংলায় বলা যেতে পারে ‘মাটির তরলীকরণ’। অর্থাত্ মাটি যখন তরল পদার্থের মতো আচরণ শুরু করে। এতে মাটির ওপরের সব বাড়িঘর, রাস্তাঘাট, স্কুল, হাসপাতাল, সেতু ধসে গিয়ে ডুবে যায় জল-কাদা-বালির এক সমুদ্রে।

ঢাকায় ভূমিকম্প হলে লিকুইফেকশনের আশঙ্কা রয়েছে কি না এমন প্রশ্নের জবাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল বিভাগের অধ্যাপক ড. আফতাব আলম খান বলেন, বাংলাদেশের বেশিরভাগটাই যেহেতু গড়ে উঠেছে নদী বিধৌত পলিমাটিতে, তাই এ রকম লিকুইফেকশনের ঝুঁকি কম বেশি অনেক জায়গাতেই আছে। যদি বর্ষাকালে বাংলাদেশে বড় ভূমিকম্প হয়, তখন লিকুইফেকশনের ঝুঁকি বেশি। তবে শীতকালের ভূমিকম্পে লিকুইফেকশনের ঝুঁকিটা অনেক কম। কেবলমাত্র উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের রংপুর, দিনাজপুর, বগুড়া রাজশাহীর মতো কিছু জেলায় অগভীর মাটিতে শক্ত শিলা বা ‘সলিড ক্রাস্ট’ আছে। যেখানে লিকুইফেকশনের ঝুঁকি নেই। কিন্তু ঢাকার অবস্থা খুবই নাজুক। পুরো ঢাকা শহরের ৬০ শতাংশ ভূমির গঠনপ্রকৃতি এমন যে, বড় মাত্রার ভূমিকম্প হলে লিকুইফেকশনের ঘটনা ঘটতে পারে। তিনি বলেন, ভূমিকম্প হলেই যে লিকুইফেকশন হবে, ব্যাপারটা তা নয়। যদি ভূমিকম্প ছয় মাত্রার কাছাকাছি বা তার চেয়ে শক্তিশালী হয় এবং এর উত্পত্তিস্থল যদি দশ থেকে পনের কিলোমিটার গভীরতার মধ্যে হয়, তাহলে লিকুইফেকশনের ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি। কয়েকটি ব্যাপার একসঙ্গে ঘটতে হবে। এটি নির্ভর করবে ভূমিকম্পটি কতটা শক্তিশালী, মাটির কতটা গভীরে ঘটছে এবং সেখানে যে একুইফার বা পানির স্তর আছে, সেটিতে কতটা পানি আছে তার ওপর।

Others শীর্ষ সংবাদ