কোটিপতি প্রতারক

মির্জা মেহেদী তমাল অনলাইনভিত্তিক দেশের শীর্ষ স্থানীয় চাকরিদাতা প্রতিষ্ঠান বিডি জবসে একটি বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়। কাতারভিত্তিক স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠান ‘আলি বিন গ্রুপ’, ‘এবিএ গ্রুপ’ বিদেশে লোক পাঠাবে। স্টোর ম্যানেজার, কমার্শিয়াল ম্যানেজারের পদে বাংলাদেশ থেকে লোভনীয় বেতনে সপরিবারে কাতার যাওয়ার অফার রয়েছে তাদের। এমন লোভনীয় চাকরির বিজ্ঞাপন দেখে সাইফুল ইসলাম তাতে যোগাযোগ করেন। বিজ্ঞাপনের লিংকের মাধ্যমে আবেদন করে সাইফুল। তাকে ই-মেইল অ্যাড্রেস দিতে বলা হয়। সাইফুল তার মেইল নম্বর দিয়ে দেন। পাঁচ থেকে সাত দিন পর ওই পদে আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে নির্বাচিত হয়েছেন এমন একটি লেটার সাইফুলের ই-মেইল আসে এবং জানিয়ে দেয় কাতারে সংশ্লিষ্ট কোম্পানির একজন প্রতিনিধি বর্তমানে বাংলাদেশে আছে এবং তার মোবাইল নম্বর দিয়ে দিয়ে বলা হয় যোগাযোগ করতে। সাইফুল ওই প্রতিনিধিকে ফোন দেয়। ওপাশের লোকটি বিভিন্ন ভাষায় কখনো ইংরেজি কখনো আরবিতে কথা বলতে শুরু করে। এমন দুই ভাষায় কথা শুনে সাইফুল নিশ্চিত হয়, সে ঠিক যায়গাতেই নক করেছেন। তবে প্রতিনিধি বলছিল, আপনার পদে তো আসলে লোক নেওয়া শেষ। দুই দিন পর যোগাযোগ করে দেখবেন। পরে এর দু-এক দিন পর সাইফুল ফোন করলে ওই লোক পরে কথা বলবে জানায়। লোকটি নিজ থেকেই কল করে একটা বিকাশ নম্বর দেয় এবং আবেদনকারী সর্বশেষ শিক্ষাগত যোগ্যতার সার্টিফিকেট স্ক্যানকপি এবং কাতার দূতাবাসের সত্যায়ন ফি বাবদ সাড়ে সাত থেকে দশ হাজার টাকা বিকাশ করতে বলে। সাইফুলের ই-মেইলে অফার লেটার, কনফার্মেশন লেটার, অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার, পুলিশ ক্লিয়ারেন্স পাঠানো হয়। এ সবের মধ্যেও কাতারের দুই সপ্তাহের হোটেল বুকিং, পাসপোর্ট ও ভিসা প্রসেসিং, এয়ার টিকিটের বাবদ সাইফুলের কাছ থেকে চার লাখ টাকা নিয়ে নেয়। এরপর সাইফুল টিকিট কবে পাবে এসব বিষয়ে ফোন দিলে নম্বর বন্ধ পায়। সাইফুল বুঝতে পারেন তিনি প্রতারিত হয়েছেন। সাইফুল শুধু নয়, এভাবে প্রতিদিন প্রতারিত হচ্ছে সাধারণ মানুষ। প্রতারক চক্রের হাতে টাকা তুলে দিয়ে নিঃস্ব হয়ে পথে বসেছে অনেক মানুষ। পুলিশ এমন প্রতারক চক্র গ্রুপকে গ্রেফতার করলেও বন্ধ হচ্ছে না প্রতারণা। এই গ্রুপের প্রধান শাহীনসহ গ্রেফতার হয়েছে কার সাংগপাংগরা। পুলিশ তাদের কাছ থেকে যে তথ্য পায়, তাতে করে তারা হতবাক।

পুলিশ জানায়, শাহীন হায়দার একটি সংঘবদ্ধ প্রতারণা চক্রের মূল হোতা। সে বিডি জবসে চাকরির বিজ্ঞাপন দিয়ে হাজারের বেশি বেকার মানুষের কাছ থেকে কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। ওই জালিয়াতির টাকা দিয়ে লন্ডনে একটি রেস্টুরেন্ট ও রাজধানীর ধানমন্ডিতে একটি বিলাসবহুল ফ্ল্যাট কিনেছে সে। শাহীন একজন কোটিপতি প্রতারক। তার সহযোগীরা হলো তাজুল, হাসান ও শ্যামল। এ সময় তাদের কাছ থেকে বিভিন্ন মোবাইল কোম্পানির সিম জব্দ করা হয়।
পুলিশ জানায়, সংঘবদ্ধ অসাধু প্রতারক এই চক্রের সদস্যদের সঙ্গে বিডি জবসের কয়েকজন কর্মী সরাসরিভাবে জড়িত। প্রতারক চক্র যখন তাদের বিজ্ঞাপন আপলোড করতে বলত, তখন তারা বিজ্ঞাপন আপলোড করত। আবার বিজ্ঞাপন ডাউন করতে বললে ডাউন করত। মাঝে মাঝে প্রতারক চক্রটির কাছে বিজ্ঞাপন আপলোডের নামে বিডি জবসের কর্মীরা অধিক টাকাও দাবি করত।

তেজগাঁও বিভাগের উপকমিশনার বিপ্লব সরকার বলেন, যে কোনো চাকরির বিজ্ঞাপন আপলোড করার আগে ওই প্রতিষ্ঠানের সব নথিপত্র যাচাই-বাছাই করে বিজ্ঞাপন ছাপানোর নিয়ম থাকলেও বিডি জবস তা করেনি বলে প্রাথমিক তদন্তে বের হয়ে এসেছে। তিনি বলেন, আমরা বিডি জবস কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি জানিয়েছি, তাদের প্রতিষ্ঠানের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ইতিমধ্যেই আমাদের অফিসে উপস্থিত হয়েছেন, তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। তাদের গাফিলতি পাওয়া গেলে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। শুধু তাই নয়, মোবাইল সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর মাঠ পর্যায়ের কর্মীরা অন্যের বায়োমেট্রিক সিম অবৈধভাবে বিক্রি করে। এসব সিম দিয়েই প্রতারক চক্র জালিয়াতি করে। আমরা মোবাইল সেবা দাতা প্রতিষ্ঠান ও বিভিন্ন মোবাইল ব্যাংকিং বিকাশ, রকেট কর্তৃপক্ষকে অবহিত করেছি। কারও কোনো গাফিলতি পাওয়া গেলেই তাদের আটক করা হবে।

ডিসি বিপ্লব আরও বলেন, এই চক্রের মূলহোতা শাহীন হায়দারের নেতৃত্বে দশ থেকে পনেরোজন প্রতারণার সঙ্গে জড়িত। চক্রটিকে মোবাইলের বায়োমেট্রিক সিম সরবরাহ করত হাসান ও তাজুল। তারা অন্যের এনআইডি (জাতীয় পরিচয়পত্র) ও মোবাইল সিম প্রতারক চক্রের কাছে পনেরো থেকে পঞ্চাশ হাজার টাকায় সিম বিক্রি করত। শ্যামল ভুয়া অফার লেটার, কনফার্মেশন লেটার, অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার, পুলিশ ক্লিয়ারেন্স বানাত। প্রতারক চক্রটি ব্যবহৃত সিম দিয়ে শুধুমাত্র ভুক্তভোগীদের ফোন দিত। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মানুষের অসচেতনার কারণেই নিজেরাই বিপদে পরছে। বিদেশে লোক পাঠানোর বিজ্ঞাপন দেখেই টাকা তুলে দিলে চলবে না। আগে খোঁজখবর নিতে হবে।

Others শীর্ষ সংবাদ