মির্জা মেহেদী তমাল মধ্যরাতে ঘরে হঠাৎ আগুন। সে ঘরে আটকা পড়েছে তিনজন। বিল্লাল, তার স্ত্রী আর তাদের দুই বছরের শিশুকন্যা মোহনা। বিল্লালের আর্তচিৎকার। আগুনে পুড়ে যাচ্ছে ঘর আর তিনটি মানুষ। বাঁচাও, বাঁচাও চিৎকারে আশপাশের মানুষ ছুটে আসছে তাদের রক্ষায়। পাড়া-প্রতিবেশীরা যে যেভাবে পারছে আগুন নেভানোর চেষ্টা করছে। কেউ কেউ ভিতরে ঢোকার চেষ্টা করছে। কিছুক্ষণের মধ্যে আগুন অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে। কয়েক ব্যক্তি ঘরের ভিতর ঢুকে পড়ে। পড়ে ছিল বিল্লাল। তার শরীরের কিছুটা পুড়েছে। পরনের কাপড় পুড়ে কালো। বিল্লালের শরীরও কালি লেগে কালো হয়ে আছে। জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে। কিন্তু বিল্লালের স্ত্রী আর শিশুকন্যা জীবিত নেই। পুরোটা শরীর পুড়ে গেছে দুজনের। বিল্লালকে রাতেই নেওয়া হলো হাসপাতালে। প্রাণে রক্ষা পেয়েছেন তিনি। জ্ঞান ফিরে তার। জানতে চায় স্ত্রী-কন্যার কথা। সবাই নীরব। সান্ত্বনা দেয় সবাই তাকে। সে মানে না কিছু। কাঁদতে থাকে। আমার শাহানাজ কোথায় গেলা একা ফেলে। মোহনারে…! তার চিৎকারে কেউ চোখের পানি ধরে রাখতে পারে না। পুলিশ আসে। সকালে লাশের সুরতহাল তৈরি করে। শাহানাজের শরীর পুড়ে গেছে। লিখে যায় পুলিশ তাদের খাতায়। বুক পেরিয়ে গলার কাছে চোখ আটকে যায় পুলিশের। কী ব্যাপার মহিলার গলা তো পুড়ে যায়নি! কিন্তু গলায় ক্ষত কেন? পুলিশ নতুন করে ভাবতে শুরু করে। কী ব্যাপার! গভীর ক্ষত! দেখে তো মনে হচ্ছে ধারালো কিছুর আঘাত। ভাবিয়ে তোলে পুলিশকে। তবে কি এটা নিছক কোনো আগুন নয়? অন্য কিছু আছে এতে? প্রশ্ন পুলিশের মনে। নাটকীয় মোড় নেয় ঘটনার। ভোলা জেলার দৌলতখান উপজেলার জয়নগরের ঘটনা এটি। পুলিশ এ ঘটনার তদন্ত করে জানতে পারে এটি একটি হত্যাকা । খুনি শনাক্ত হয়। গ্রেফতার হয় খুনি। গোয়েন্দারা জানায়, বিল্লালের স্ত্রী শাহনাজ, এক রমজান মাসে ইফতার করে ঘরের টুকিটাকি কাজকর্ম সেরে পাশের ঘরে চাচাত জায়ের ঘরে তারাবির নামাজ আদায় করেন। নামাজ শেষে তিনি তার ঘরে ফিরে ভাবছিলেন রাতে কী খাবেন? এবং ভোর রাতে কী খেয়ে রোজা রাখবেন। কারণ তার স্বামী বিল্লাল একদিন বাজার করে তো দুই দিন করতেন না। সব সময় সে স্ত্রী শাহানাজকে অভাব অনটনেই রেখেছেন। বিল্লাল ড্রাইভিং করে যা ইনকাম করতেন তার বেশির ভাগ পরকীয়ার পেছনেই খরচ করতেন। ওই মুহূর্তে শাহানাজের ঘরে থাকা আগের দিনের কিছু পান্তা ভাত লবণ-মরিচ দিয়ে খেয়ে তার দুই বছরের শিশু সন্তানকে কোলে নিয়ে ঘুমিয়ে পড়েন। এটাই ছিল তার শেষ খাওয়া ও শেষ ঘুম! বিল্লাল রাত ১২টার দিকে ঘরে প্রবেশ করেন। ঘরে এসে সে অন্য খাটে শুয়ে তার প্রেমিকার সঙ্গে মোবাইলে কথা শুরু করে। টের পেয়ে স্ত্রী শাহানাজ উঠে বললেন, তুমি সারা দিন বাসায় আসনি। বাজার দেওনি, আমাদের খোঁজখবর রাখনি, এখন আবার অন্য মেয়ের সঙ্গে কথা বলছ? এতে বিল্লাল ক্ষিপ্ত হয়। দুজনের বাকবিত ার এক পর্যায়ে শাহানাজের গলায় ধারালো ছুরি ঢুকিয়ে দেয়। এতে শাহানাজ রক্তক্ষরণের পর মৃত্যুর মুখে ঢলে পড়েন। ওই মুহূর্তে বিল্লাল লাশটি শাহানাজের রুমে নিয়ে তার ঘুমন্ত বাচ্চা মোহনার পাশে রাখে। এরপর এ হত্যাকা টি অগ্নিকা হিসেবে প্রমাণ করার জন্য প্রথমে ঘর থেকে রক্ত পরিষ্কার করে। এবার বিল্লাল নিহত স্ত্রী ও জীবিত বাচ্চার গায়ের ওপর কম্বল ও বিভিন্ন কাপড়-চোপড় ছিটিয়ে দেয়। এরপর বিল্লাল ঘরে থাকা কেরোসিনের বোতল থেকে তেল ঢেলে জীবিত মোহনা ও মৃত শাহানাজের গায়ে আগুন ধরিয়ে দেয়। যখন আগুন জ্বলা শুরু হলো ওই মুহূর্তে বাচ্চা মোহনা আগুনের তাপে চিৎকার দিয়ে কেঁদে ওঠে। কিন্তু নরপশু বিল্লাল নিজে বাঁচার জন্য নিষ্পাপ শিশু মোহনাকে উদ্ধার করেনি আগুন থেকে। এত কিছুর পরও বিল্লালের শেষ রক্ষা হলো না। বিল্লাল নিজের পরনের লুঙ্গি ও গেঞ্জি নিজে পুরে, শরীরে কালি লাগায়। আগুন আগুন করে চিৎকার শুরু করে, এতে আশপাশের বাড়ির লোকজন এসে পড়লে বিল্লাল ইচ্ছা করে বেহুঁশ হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। সে প্রশাসন ও বাড়ির লোকজনকে বোঝাতে চেয়েছে, ঘরে আগুন লেগে স্ত্রী-সন্তান পুড়ে গেছে, তাদের বাঁচাতে গিয়ে সে গুরুতর আহত হয়েছে। পরে স্থানীয়রা বিল্লালকে অসুস্থ ভেবে ভোলা সদর হাসপাতালে ভর্তি করে।
বিল্লালের ধারণা ছিল, যেভাবে সে আগুন লাগিয়েছে, তাতে শাহানাজ ও মোহনা পুড়ে ছাই হয়ে যাওয়ার কথা। আর ভালোভাবে পুড়ে গেলে শাহানাজের গলার জবাই করা চিহ্ন খুঁজে পাবে না কেউ। কিন্তু বিল্লালের এ ধারণা সম্পূর্ণ মিথ্যা প্রমাণ হলো। আগুনে শাহানাজের শরীর পুড়লেও গলা পুড়েনি। সকালে পুলিশ খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে গিয়ে লাশের সুরতহাল রিপোর্ট করার সময় দেখে স্ত্রী শাহানাজের গলায় ছুরির আঘাত। এতে পুলিশ ভালোভাবে বুঝতে পারে। নিশ্চই বিল্লাল এ জোডা খুন করে বাঁচার জন্য নাটকীয়ভাবে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। পুলিশ দ্রুত ভোলা সদর হাসপাতাল থেকে ঘাতক বিল্লালকে গ্রেফতার করে। এরপর স্বীকার করে নেয় তার খুন করার কাহিনি। অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যত নিখুঁতভাবে খুন করুক না কেন, খুনিকে ধরা পড়তেই হয়। বিল্লালও ধরা পড়েছে। খুনিরা ধরা পড়ে যায়।