গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট

মির্জা মেহেদী তমাল

ফেসবুকে গুরুত্বপূর্ণ একজন ব্যক্তির ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পেয়ে হয়তো আপনি অবাক। এও সম্ভব! এমন একজন সেলিব্রেটি লোক আপনাকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্টই শুধু পাঠাননি, মেসেঞ্জারেও নক করেছে। আপনি তার ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট একসেপ্ট করে নিলেন। পরে তার সঙ্গে ধীরে ধীরে কথাবার্তা হলো। একটা সময় বিপদের কথা বলে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিয়ে আপনাকে ব্লক মেরে দিল। আপনি তাকে নক করছেন পাচ্ছেন না। একটা সময় আপনি বুঝতে পারলেন, গুরুত্বপূর্ণ সেই লোকটি আসলে তার আসল পরিচয় নয়। প্রতারণার শিকার হলেন আপনি। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীসহ সরকারের দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের নামে এমন একটি গ্রুপ ও ৩৬টি ভুয়া আইডি শনাক্ত করে র‌্যাব। এমন তথ্য পেয়ে নতুন করে নড়েচড়ে বসেছে প্রশাসন। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের নামেও আইডি খুলে ফাঁদ পাতা হয়েছে এবং জানতে পেরে ফখরুল থানায় সাধারণ ডায়েরি করেছেন।

পুলিশের সাইবার ক্রাইম তদন্তকারী সূত্র জানায়, নাট্যনির্মাতা রেদওয়ান রনির নামে ভুয়া ফেসবুক আইডি খুলে অভিনয়ের কথা বলে টাকা হাতিয়ে নিয়েছিল এক যুবক। অভিনেতা আরিফিন শুভর নামে আছে বেশ কিছু আইডি। একটি আইডি থেকে প্রতারণার অভিযোগ করেছেন ওই তারকা। একইভাবে কণ্ঠশিল্পী হাবিব ওয়াহিদ, হৃদয় খান, ইমরান, দিলশাদ নাহার কণা, নায়িকা মেহজাবিন চৌধুরী, মাহিয়া মাহী, পরীমণি, মৌসুমী, পূর্ণিমা, শাবনূর, রেসি, ববি, নায়ক শাকিব খান, রিয়াজ, ফেরদৌস, বাপ্পি, ক্রিকেটার মাশরাফি বিন মর্তুজা, মেহেদী হাসান মিরাজ, মোস্তাফিজুরসহ জনপ্রিয় সব তারকার নামেই ভুয়া আইডি আছে। মারুফ আহমেদ নামের এক ব্যক্তি জানান, নায়িকা কেয়ার নামে একটি ভুয়া আইডি থেকে তার সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করে ৫০ হাজার টাকা কৌশলে হাতিয়ে নেয়। পরে সেই আইডিটি বন্ধ করা গেলেও প্রতারক নারীর নাগাল পাননি তিনি।
তদন্তসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, যেসব আইডি থেকে অসামাজিক কাজের প্রস্তাব দেওয়া হয় সেসব আইডির বেশির ভাগ তথ্যই ভুয়া, মানে আইডিটি ভুয়া। তবে অনেক সময় এর পেছনে সংঘবদ্ধ প্রতারক চক্রও থাকে। সুন্দরী নারী, তারকার ছবি ও অশালীন ছবি দেওয়া থাকে এসব আইডিতে। তাদের অনেকে নামের শেষে ‘আক্তার’ শব্দটি ব্যবহার করে। গত মাসে নিজের ফেসবুক আইডি থেকে উদ্বেগ প্রকাশ করে একটি পোস্ট দেন রাজশাহীর এক নারী ইন্টার্ন চিকিৎসক। ‘আমার আইডি দিয়ে কেউ একজন ফেক আইডি খুলে সেই আইডিতে খারাপ খারাপ ছবি দিয়ে আপলোড করছে…।’ পরে যোগাযোগ করা হলে ওই মেডিকেল শিক্ষার্থী স্বস্তির সঙ্গে জানান, ফেসবুকের কাছে রিপোর্ট করা হলে ফেক আইডিটি রিমুভ করা হয়েছে। তবে তার ছবি যাচাই করে দেখা গেছে ‘মোরশেদ’ নামের আরেকটি আইডিতে তার ছবি কাভার ছবি হিসেবেই আছে। শুধু তাই নয়, সেই আইডির ভিতরে আছে আরও কিছু তরুণীর ছবি।

জানা যায়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নামে ছয়টি ও তাঁর কন্যা সায়মা ওয়াজেদ পুতুলের নামে একটি অ্যাকাউন্ট খোলে ওমর ফারুক নামের এক ব্যক্তি। এসব আইডিতে সরকারের উন্নয়ন প্রকল্পের ছবি দিয়ে নিজের নম্বর দেয় সে। অনেকে যোগাযোগের চেষ্টা করলে কৌশলে চ্যাটিংয়ে যায় সে। এরপর কাজের তদবিরের কথা বলে টাকা হাতিয়ে নেয়। একই কৌশলে স্পিকারসহ বিভিন্ন নেতাদের নামে ৩৬টি অ্যাকাউন্ট খোলে ফারুক। চার সহযোগীসহ গ্রেফতারের পর এখন ফারুককে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে পুলিশ। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের এক চাকরিজীবী মুহিত রহমান (ছদ্মনাম) ফেসবুকে কিছুদিন আগে ‘অনামিকা’ নামের সুন্দরী এক তরুণীকে বন্ধু করেন। কিছুদিন পর ওই ‘তরুণী’ অশালীন একটি ছবি পোস্ট করলে মুহিত বিস্মিত হন। একদিন মেসেঞ্জারে ‘অনামিকা’ বলেন, ‘ইমো…করি। আগ্রহী হলে যোগাযোগ করেন। বিকাশে ৫০০ টাকা লাগবে।’ ঘটনা কী মুহিত জানতে চাইলে বলা হয়, ‘কাজ করলে বলেন। বিকাশ করেন। ফালতু প্যাঁচাল পারলে ব্লক করে দিব।’ কৌতূহলী হয়ে মুহিত ৩০০ টাকা বিকাশে পাঠান; এরপর তিনি ফোন করে দেখেন নম্বর বন্ধ, ফেসবুকে ঢুকে দেখেন তাকে ব্লক করে দিয়েছে ওই আইডি। শাহিন নামের বাড্ডার আরেক যুবক জানান, ‘নওশীন লিজা’ নামের একটি আইডি থেকে সরাসরি অসামাজিক কাজের প্রস্তাব দেওয়া হয় তাকে। ইমো অ্যাপে বিশেষ কথা বলতে তার কাছ থেকে এক হাজার টাকা বিকাশে নেওয়া হয়। এক নারীকণ্ঠের সঙ্গে কথাও বলেছেন শাহিন। একপর্যায় তিনি দেখা করার কথা বললে ব্লক করে দেওয়া হয়। নিজের অভিজ্ঞতা জানিয়ে বনানীর একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র রবিন হোসেন (ছদ্মনাম) বলেন, ‘মেঘা চৌধুরী’ নামের একটি আইডি থেকে বনশ্রীতে অসামাজিক কাজের জন্য বাসার ঠিকানা দিয়ে বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়েছে ফেসবুকে। সম্প্রতি বোনের সামনে ফেসবুকের ওয়ালে এমন পোস্ট দেখে তিনি বিব্রতকর অবস্থায় পড়ে যান। রবিন জানান, এমন আরও কিছু আইডি তিনি পেয়েছেন। গত সপ্তাহে তৌফিক রহমান নামের এক ব্যক্তি ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে বলেন, ‘আমার আইডি থেকে টাকা চাইলে কেউ দেবেন না। আইডি হ্যাকড। ’

পরে তিনি বলেন, আইডি রিমুভ করা গেছে। তবে প্রযুক্তিগত ভুলে তিনি উদ্ধার আর করতে পারেননি। পুলিশ সদর দফতর সূত্র জানিয়েছে, ফেসবুকের অপরাধ নিয়ে তদন্তের সক্ষমতা বাড়ছে। তবে ফেসবুকের সঙ্গে সরাসরি কাজ করে এমন একক কোনো সংস্থা নেই পুলিশ প্রশাসনে। এ ব্যাপারে কোনো সমন্বিত তথ্যও নেই।

ঢাকা মহানগর পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিট, পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) সাইবার ইউনিট, পুলিশ সদর দফতরের এলআইসি সেল, পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই), বিশেষ শাখা (এসবি) ও র‌্যাব সাইবার ক্রাইম নিয়ে আলাদাভাবে কাজ করছে। এদিকে র‌্যাব ফেসবুকসহ অন্যান্য সামাজিক মাধ্যমে প্যাট্রলিংয়ের জন্য ‘সাইবার নিউজ ভেরিফিকেশন সেন্টার’ চালু করেছে। সেখানে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে অভিযান চালানো হয়। অভিযোগ পেলে র‌্যাব দ্রুত পদক্ষেপ নিচ্ছে। ফেসবুকের সবচেয়ে বেশি অভিযোগ সিটিটিসির সাইবার ক্রাইম ইউনিটে। গত এক বছরে এক হাজার ৬৭০টি অভিযোগ এসেছে সেখানে। দুই শতাধিক আইডির বিরুদ্ধে ২০৪ মামলার তদন্ত চলছে।
মির্জা মেহেদী তমাল

Others শীর্ষ সংবাদ