নিষিদ্ধ ৫২ খাদ্যপণ্য বিক্রি চলছেই

বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ড অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশনের (বিএসটিআই) পরীক্ষায় ভেজাল ও নিম্নমানের প্রমাণিত হওয়া ৫২ খাদ্যপণ্য প্রত্যাহারে হাইকোর্টের নির্দেশের পরও এখনো বাজারে বিক্রি হচ্ছে। এ নিয়ে নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ সংশ্লিষ্ট উৎপাদন ও বাজারজাতকরণ প্রতিষ্ঠানকে বাজার থেকে পণ্য সরাতে ৩/৪ দিনের সময় বেঁধে দিলেও এ নিয়ে তাদের কোনো উদ্যোগ নিতে দেখা যায়নি। তৎপরতা চোখে পড়েনি নিয়ন্ত্রণকারী অন্যান্য সরকারি সংস্থাগুলোরও।

স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এসব পণ্য ব্যবহারে ক্যান্সারের মতো মরণব্যাধিতে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে। তবে ব্যবসায়ীরা বলছেন, তারা এখন এসব পণ্য বিক্রি করবেন কিনা তা বুঝে উঠতে পারছেন না। তাদের মতে, যদি বিক্রি বন্ধ করি তাহলে ক্রেতা হারাব। অন্যদিকে আবার যদি শুনি এই পণ্য বিক্রি করা যাবে, তখন তো ব্যবসার ক্ষতি হবে।

এ প্রসঙ্গে স্বাস্থ্য অধিদফতরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক এবং মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের অধ্যাপক ডা. একেএম শামসুজ্জামান বলেন, খাবারে অধিক ময়েশ্চার আর্দ্রতার কারণে এক ধরনের ফাঙ্গাস সৃষ্টি হয়। ‘এসপারজাইলাস ফ্লেভাস’ নামক এ ফাঙ্গাস খাবারে আফলাটক্সিন নামক বিষাক্ত পদার্থ নিঃসরণ করে। এসব খাবার খেলে মানুষের ক্যান্সার হওয়ার ঝুঁকি থাকে।

তিনি বলেন, আর্দ্রতায় এক ধরনের ব্যাকটেরিয়ার আক্রমণ ঘটে। এসব ব্যাকটেরিয়া খাবারে ‘বেসিলাস সিরিয়াস’ তৈরি করে। যা মূলত এক ধরনের সাইটোটক্সিন। এ ধরনের সাইটোটক্সিন খাদ্যে বিষক্রিয়া ঘটিয়ে মারাত্মক আমাশয় ঘটায়।

তিনি আরো বলেন, খাবারে বা লবণে ময়েশ্চার বেশি থাকলে সেই খাবার ভেজা থাকবে। ফলে খাবারের গুণগতমান দ্রুত নষ্ট হয়ে যাবে। খাবার তার খাদ্য উপযোগিতা হারাবে।
বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান মাহফুজুল হক জানান, ৫২টি পণ্যের প্রতিষ্ঠানকে তাদের পণ্য বাজার থেকে সরিয়ে নিতে ৩ থেকে ৪ দিনের সময় দেয়া হয়েছে। এই সময়ের মধ্যে সরিয়ে না নিলে ব্যবস্থা নেয়া হবে।

রাজধানীর অন্যতম বৃহৎ পাইকারি হাট কারওয়ান বাজার। সরজমিনে দেখা যায়, এ বাজারে এসব পণ্য আগের মতোই বিক্রি হচ্ছে। বিক্রেতারা বলেন, তারা বুঝতে পারছেন না যে কী করবেন।

কারওয়ান বাজারে প্রাণ পণ্যের অন্যতম ডিলার আব্দুল হক খান বলেন, প্রাণের গুঁড়া হলুদ, লাচ্ছা সেমাইসহ এ ধরনের পণ্যগুলো বাজারে খুব চলে। কিন্তু এসব পণ্যে কী ধরনের বা কোন মাত্রার সমস্যা রয়েছে, তা আমরা এখনো জানতে পারিনি। দু’-একটি পণ্যে সমস্যা থাকলেও সব পণ্যই যে ক্ষতিকর হয়ে গেছে, এমনটা আমার মনে হচ্ছে না।

তিনি বলেন, এখন আমি কী করব, বুঝতে পারছি না। যদি সত্যিই সমস্যা থেকে থাকে, তাহলে তো কোম্পানি পণ্য দেবে না আমরাও বিক্রি করব না। এখন বিক্রি বন্ধ করে দিলে তো ক্রেতা হারাব। আবার যদি শুনি এই পণ্য বিক্রি করা যাবে, তখন তো ব্যবসার একটা ক্ষতি হবে। এ নিয়ে একটা ধোঁয়াশার মধ্যে আছি।

কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) প্রেসিডেন্ট ও সাবেক বিচারপতি গোলাম রহমান বলেন, দোকান মালিক ও ব্যবসায়ীদের ৫২টির তালিকায় থাকা পণ্যগুলো পরবর্তী নির্দেশনা আসা পর্যন্ত বিক্রি বন্ধ রাখা নৈতিকভাবে উচিত। ওই ৫২টি পণ্যের মধ্যে দেশের অন্যতম বৃহৎ খাদ্যপণ্য উৎপাদনকারী ব্র্যান্ড প্রাণের গুঁড়া হলুদ ও লাচ্ছা সেমাই রয়েছে। ড্যানিশ, ফ্রেশ ও সান এর গুঁড়া হলুদও রয়েছে এই তালিকায়। রয়েছে এসিআই ফুডের পিওর ব্র্যান্ডের গুঁড়া ধনিয়াও।

কারওয়ান বাজারে তীর ব্র্যান্ডের সরিষার তেলও দেখা যায় দোকানে দোকানে। একটি দোকানের কর্মী আনোয়ার বলেন, আদালতের নির্দেশ অমান্য করে ব্যবসা করার চিন্তা তারা করছেন না। তবে দীর্ঘদিন ধরে বিক্রি হওয়া তীর ব্র্যান্ডের সরিষার তেলে কী সমস্যা, তা তারা আরো ‘ভালোভাবে’ বুঝতে চান। সিটি গ্রুপের তীরের পাশাপাশি বাংলাদেশ এডিবল অয়েলের রূপচাঁদা, শবনম ভেজিটেবল অয়েলের পুষ্টি ব্র্যান্ডগুলোও রয়েছে বিক্রি নিষিদ্ধের তালিকায়। নিউজিল্যান্ড ডেইরির ডুডলি নুডলসও রয়েছে এই তালিকায়।

ডুডল ব্রান্ডের বিপণনকারী প্রতিষ্ঠান ভিআইপি স্টোরের আলমগীর হোসেন বলেন, ভোক্তার জন্য ক্ষতিকর পণ্য তারা বিক্রি করতে চান না। তবে তাদের দোকানে এখনো ডুডল নুডলস আছে। যখনই চূড়ান্ত নির্দেশ আসবে তারা বিক্রি বন্ধ করবেন। তবে নিষিদ্ধ পণ্যগুলোর বিষয়ে উৎপাদক ও বাজারজাতকারী প্রতিষ্ঠান বা সরবরাহকারীদের কাছ থেকে এখনো কোনো ‘নির্দেশনা’ পাওয়া যায়নি বলে নিশ্চিত করেছেন বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি হেলাল উদ্দিন।

পণ্যগুলো এখনো বিক্রি হচ্ছে এবং ক্রেতারা কিনছেন জানিয়ে তিনি বলেন, এ ধরনের খবর রীতিমত আতঙ্কিত হওয়ার মতো খবর। কিন্ত বাস্তবতা হচ্ছে, বিএসটিআই বা অন্যান্য অনেক সংস্থার ওপরই এখন জনগণের আস্থা সেভাবে নেই। বিএসটিআইয়ের থেকে অনেক উচ্চমানের পরীক্ষাগার আছে এসব প্রতিষ্ঠানের। তবে আদালতের রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে প্রতিষ্ঠানগুলোর পক্ষ থেকে এখন পর্যন্ত কোনো নির্দেশনা আমাদের দেয়া হয়নি। কিন্তু আমরা দোকান মালিক সমিতির পক্ষ থেকে প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে একটি চিঠি লেখার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আমরা সেখানে প্রতিষ্ঠানগুলোকে বলব যে, আমাদের মজুদে থাকা মালগুলো নিয়ে কেনার সময়ে দেয়া মূল্য ফিরিয়ে দিতে অথবা পণ্যগুলোতে যে ভেজাল নেই সেটা যেন তারা প্রমাণ করে।

বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ড অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশনের (বিএসটিআই) উপপরিচালক রিয়াজুল হক খান বলেন, পণ্যগুলো বাজার থেকে অপসারণের প্রাথমিক পদক্ষেপ নেবে নিরাপদ খাদ্য অধিদফতর ও জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর।

বিএসটিআইয়ের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, খাদ্যের গুণগতমান নেই আররা ফুডের আরা ড্রিংকিং ওয়াটার, আল সাফির ড্রিংকিং ওয়াটার, মিজানের ড্রিংকিং ওয়াটার, মর্ন ডিউয়ের ড্রিংকিং ওয়াটার, ডানকানের ন্যাচারাল মিনারেল ওয়াটার, আরার ডিউ ড্রিংকিং ওয়াটার, দীঘির ড্রিংকিং ওয়াটারে। এ ছাড়া ডুডলি নুডলসে অতিরিক্ত চর্বি, শান্ত ফুডের সফট ড্রিংকস, জাহাঙ্গীর ফুড সফট ড্রিংকে এসিডের পরিমাণ বেশি। ড্যানিশের হলুদের গুঁড়ায় ছাই পাওয়া গেছে।

তানভির ফুডের ফ্রেশ হলুদের গুঁড়ায় মাত্রাতিরিক্ত সিসা পাওয়া গেছে, এসিআইয়ের ধনিয়ার গুঁড়ায় পুরোটাই ছাই, ড্যানিশ কারি পাউডারে সিসা ও আর্সেনিক, বনলতার ঘিতে তরল পদার্থ ও ক্ষতিকারক এসিড এবং পিওর হাটহাজারী মরিচ গুঁড়ায় ছাই পাওয়া গেছে। এ ছাড়াও মিষ্টিমেলা, ওয়েল ফুড ও মুধবনের লাচ্ছা সেমাইতে অতিরিক্ত চর্বি, এসিআইয়ের আয়োডিনযুক্ত লবণ, কিংয়ের ময়দা, রূপসার দই, মক্কার চানাচুরে মাত্রাতিরিক্ত চর্বি পাওয়া গেছে।

মেহেদির বিস্কুট, বাঘাবাড়ীর স্পেশাল ঘিতে কোনো উপাদানই ঠিকমতো নেই। নিশিতা ফুডসের সুজিতে ক্ষতিকারক কণা পাওয়া গেছে। মঞ্জিলের হলুদ গুঁড়া, সান ফুডের হলুদ গুঁড়া, ডলফিনের মরিচ গুঁড়া, ডলফিনের হলুদ গুঁড়া, সূর্যের মরিচের গুঁড়ায় ছাই পাওয়া গেছে। কিরণের লাচ্ছা সেমাই, জেদ্দার লাচ্ছা সেমাই এবং অমৃতের লাচ্ছা সেমাইতে পাওয়া গেছে মাত্রাতিরিক্ত চর্বি। দাদা সুপার, তিন তীর, মদিনা স্টারশিপ, তাজ, নুর ও মধুমতির আয়োডিনযুক্ত লবণ, মোল্লা সল্টের আয়োডিন লবণে ক্ষতিকারক সোডিয়াম ক্লোরাইড পাওয়া গেছে।

জাতীয় শীর্ষ সংবাদ