রূপপুর পারমানবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের কর্মকর্তা-কর্মচারিদের জন্য নির্মিত গ্রীনসিটি ভবনের জন্য বিভিন্ন আসবাবপত্র ও ইলেক্ট্রনিক্স সামগ্রী ক্রয়ে অকল্পনীয় দুর্নীতি সংঘটিত হয়েছে। জনগনের রাজস্ব ও বৈদেশিক ঋণের টাকায় বাস্তবায়নাধীন এই প্রকল্পে কর্মকর্তাদের জন্য ২ কোটি টাকার বালিশ কেনার তথ্য এখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল আলোচ্য বিষয়ে পরিনত হয়েছে। প্রতিটি বালিশ কিনতে খরচ দেখানো হয়েছে প্রায় ৬ হাজার টাকা। বিস্ময়ের এখানেই শেষ নয়, একেকটি বালিশ ফ্ল্যাটে তোলার খরচ দেখানো হয়েছে ৭৬০ টাকা। বালিশ কাহিনী ইতিমধ্যে ভাইরাল হলেও এই হাউজিং প্রকল্পের প্রায় প্রতিটি সামগ্রী ক্রয়েই অস্বাভাবিক উচ্চ মূল্য এবং এসব পণ্য ফ্ল্যাটে তোলতে যে খরচ দেখানো হয়েছে, তা শুধু দুর্নীতি নয়, পুকুর চুরি। খাট, তোশক, সোফা, ডাইনিং টেবিল, চেয়ার, আলমারি, টিভি, ওয়াশিং মেশিন, ওভেন, কেটলি, ইলেক্ট্রিক ইস্ত্রি ও চুলার ক্রয়মূল্য এবং এসব পণ্য ফ্ল্যাটে তোলার যে খরচ দেখানো হয়েছে তা অবিশ্বাস্য ও অভূতপূর্ব। একেকটি গ্যাসস্টোভের ক্রয়মূল্য ৭ হাজার ৭৪৭ টাকা আর ফ্ল্যাটে তোলার খরচ দেখানো হয়েছে ৬ হাজার ৬৫০টাকা। একটি ইলেক্ট্রিক ইস্ত্রি(আয়রন) ফ্লাটে ওঠাতে খরচ দেখানো হয়েছে প্রায় তিন হাজার টাকা। মাইক্রোওয়েভ ওভেন ফ্লাটে তোলার খরচ প্রায় ৭ হাজার টাকা। একেকটি ওয়ারড্রোব ফ্ল্যাটে তোলার খরচ প্রায় সাড়ে ১৭ হাজার টাকা। প্রতিটি পণ্যের অস্বভাবিক ক্রয়মূল্য এবং ততোধিক অস্বাভাবিক সরবরাহ খরচ এই প্রকল্পে সীমাহীন অপচয়-দুর্নীতির চিত্রই বেরিয়ে এসেছে।
রূপপুর পারমানবিক বিদ্যুত প্রকল্প ৬ দশকের প্রত্যাশিত একটি স্বাপ্নিক প্রকল্প। বিগত শতকের ষাটের দশকে তৎকালীন পাকিস্তান সরকার এই বিদ্যুত প্রকল্প গ্রহণ করলেও স্বাধীনতার পর প্রায় অর্ধশত বছর পেরিয়ে গেলেও কোনো সরকারই এই প্রকল্প বাস্তবায়নে কোনো কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। শেখ হাসিনার সরকার এই প্রকল্প বাস্তবায়নের সাহসী উদ্যোগের মধ্য দিয়ে জাতির সুদীর্ঘদিনের প্রত্যাশার বাস্তবায়ন ঘটতে চলেছে। তবে পারমানবিক বিদ্যুত প্রকল্পের জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষ জনবলসহ প্রযুক্তিগত ও কারিগরি সক্ষমতা ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা আছে কি না তা ভিন্ন প্রশ্ন। রাশিয়ান কোম্পানীর সাথে প্রকল্প সহায়তা ও নির্মান চুক্তির মধ্য দিয়ে এই প্রকল্পের নির্মান কাজ এরই মধ্যে দৃশ্যমান হতে শুরু করেছে। অন্যান্ন মেগা প্রকল্পের মত এই প্রকল্প বাস্তবায়নের শুরুতেই অস্বাভাবিক উচ্চব্যয় ও প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে দেখা গেছে। এখন রূপপুর আবাসন প্রকল্পে যে সব দুর্নীতি, অস্বচ্ছতা ও অস্বাভাবিক ব্যয়ের তথ্য উঠে এসেছে, তাতে মূল প্রকল্পের ব্যয় নিয়েও জনমনে সন্দেহ ও সংশয় দেখা দিতে পারে। উপযুক্ত তদন্তের মাধ্যমে গ্রিনসিটি প্রকল্পে দুর্নীতি-অস্বচ্ছতার সামগ্রিক চিত্র তুলে ধরা এবং দুর্নীতির সাথে জড়িত ব্যক্তিদের শাস্তির আওতায় আনার মাধ্যমে সে সংশয় দূর করতে হবে। বর্তমান সরকার আরো বেশ কিছু যুগান্তকারী মেগা প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করছে। সে সব প্রকল্পে অনুরূপ দুর্নীতি ও লুটপাটের ঘটনা ঘটছে কিনা তা সংশ্লিষ্টদের খতিয়ে দেখতে হবে। গ্রিনসিটি প্রকল্পের দুর্নীতিবাজদের শাস্তি নিশ্চিত করা সম্ভব হলে তা অন্যান্য প্রকল্পের কর্মকর্তাদের জন্য দৃষ্টান্ত হতে পারে।
সরকারী প্রকল্পে দুর্নীতি-অপচয় ও অস্বচ্ছতা কোনো নতুন বিষয় নয়। বিভিন্ন সেক্টরে বছরের পর বছর ধরে অনিয়ম-দুর্নীতি অব্যাহত আছে। এসব দুর্নীতির বিরুদ্ধে গণমাধ্যমে প্রায়শ রিপোর্ট-প্রতিবেদন প্রকাশিত হলেও অবস্থার খুব বেশি পরিবর্তন ঘটেনি। তবে প্রথাগত মূল ধারার গণমাধ্যমের পাশাপাশি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম প্রভাবশালী ভ‚মিকায় অবতীর্ণ হওয়ার কারনে রাষ্ট্রীয় সম্পদের এমন মাত্রাহীন অপচয়-লুটপাটের ঘটনায় সাধারণ মানুষকে সোচ্চার ভ‚মিকায় দেখা যায়। কোটি টাকার বালিশ ক্রয় এ কারণেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল ইস্যু হয়ে উঠেছে। গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রনালয়ের তরফ থেকে গ্রিনসিটি প্রকল্পের এমন অস্বাভাবিক ব্যয় বা দুর্নীতি খতিয়ে দেখতে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে ৭দিনের মধ্যে রিপোর্ট জমা দিতে গণপূর্ত অধিদফতরের প্রধান প্রকৌশলীকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে বলে জানা যায়। তদন্ত প্রতিবেদন দুর্নীতি দমন কমিশনে পাঠানো হবে বলে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রনালয়ের তরফ থেকে জানানো হয়েছে। দুদকও নিজস্ব প্রক্রিয়ায় এ বিষয়ে অনুসন্ধান এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবে বলে জানা গেছে। তদন্ত যেন লোক দেখানো বা আইওয়াশ না হয়। জনগণের টাকায় জনগণের স্বপ্নের প্রকল্পে এমন হরিলুট বন্ধ করতে হবে। ২০০-থেকে ৫০০ টাকায় বালিশ কেনা যায়, সেখানে ৬ হাজার টাকায় বালিশ কিনে তা ফø্যাটে পৌছাতে ৭৬০ টাকা খরচের নামে লুটপাটের এই চিত্র জাতির অগ্রগতির অন্যতম অন্তরায়। এহেন লুটপাট-দুর্নীতির সাথে জড়িতদের ছাড় দেয়ার কোনো সুযোগ নেই। কেপিআই বা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ রূপপুর পারমানবিক বিদ্যুত প্রকল্প বাস্তবায়নে সব ধরনের অস্বচ্ছতা দূর করার কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে।