রাজধানীতে চলন্ত সিঁড়িযুক্ত (এস্কেলেটর) ফুট ওভারব্রিজ আছে দুটি। একটি বিমানবন্দরে, অন্যটি বনানীতে। বিকল হয়ে প্রায়ই বন্ধ হয়ে যায় ৭ কোটি টাকায় নির্মিত ফুট ওভারব্রিজ দুটি। মেরামতে বছর বছর ব্যয় হয় মোটা অংকের অর্থ। শুধু ২০১৮ সালেই ৩৬ করে মোট ৭২ বার মেরামত করতে হয়েছে ফুটওভার ব্রিজ দুটি। এতে ব্যয় হয়েছে প্রায় ৩০ লাখ টাকা। এর বাইরে রক্ষণাবেক্ষণ বাবদ সে বছর আরো ১৩ লাখ টাকা খরচ করে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি)।
ঢাকার এ দুই চলন্ত সিঁড়ির ফুট ওভারব্রিজ মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণে যখন ডিএনসিসি হিমশিম খাচ্ছে, তখন নতুন করে আরো ৮৭টি ফুট ওভারব্রিজে চলন্ত সিঁড়ি যুক্ত করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এরই মধ্যে নর্দ্দা এলাকায় একটির নির্মাণও শুরু হয়েছে।
পথচারীদের পারাপার নিরাপদ করতে ২০১৪ সালে রাজধানীর বিমানবন্দর সড়কে চলন্ত সিঁড়িযুক্ত ফুট ওভারব্রিজ নির্মাণ করা হয়। এতে ব্যয় হয় ৩ কোটি ৫০ লাখ টাকা। এর মধ্যে বনানীর ফুট ওভারব্রিজটি নির্মাণে ব্যয় হয় ৩ কোটি ৬৬ লাখ টাকা। চালুর পর থেকে অসংখ্যবার বন্ধ থেকেছে এ দুই ফুট ওভারব্রিজ। ডিএনসিসির হিসাবে শুধু ২০১৮ সালে মেরামত করতে হয়েছে ৩৬ বার করে। তবে ফুট ওভারব্রিজ দুটি দেখভালের দায়িত্বে থাকা কর্মীরা জানিয়েছেন, মেরামত হয়েছে ৫০ বারের মতো।
ঘন ঘন নষ্ট হওয়ার কারণ জানতে চাইলে ডিএনসিসির প্রধান প্রকৌশলী ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মুহাম্মদ যুবায়ের সালেহীন বণিক বার্তাকে বলেন, উন্নত যেসব দেশে চলন্ত সিঁড়িযুক্ত এ ধরনের ফুট ওভারব্রিজ রয়েছে, তার কোনোটিই কিন্তু এমন খোলামেলা পরিবেশে রাস্তার পাশে নয়। ওগুলোর বেশির ভাগই একটি টানেলের মতো করে ঢেকে দেয়া ও শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত। এতে ওইসব ফুট ওভারব্রিজের মোটর ও বেল্টে কোনো অবস্থায়ই ধুলাবালি প্রবেশ করতে পারে না। সেজন্য উন্নত দেশে স্থাপন করা চলন্ত সিঁড়িযুক্ত ফুট ওভারব্রিজগুলো তেমন কোনো সমস্যা ছাড়াই বছরের পর বছর সার্ভিস দিয়ে যায়। কিন্তু আমাদের এখানে রাস্তার পাশে খোলা পরিবেশে চলন্ত সিঁড়ি স্থাপন করা হয়েছে। তীব্র রোদ-বৃষ্টিতে ভিজে চলন্ত সিঁড়ির মোটর ও বেল্ট চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এজন্য চলন্ত সিঁড়িযুক্ত ফুট ওভারব্রিজগুলোর রক্ষণাবেক্ষণ একটু বেশি করা লাগছে।
সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, বিমানবন্দরের পাশের চলন্ত সিঁড়িযুক্ত ফুট ওভারব্রিজটি দিয়ে মানুষ পারাপারের চেয়ে লাগেজ পারাপারই বেশি হচ্ছে। অনেক সময় লাগেজের চাপে পথচারীরাও চলন্ত সিঁড়ির ফুট ওভারব্রিজ ব্যবহারের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। তবে বনানীর চলন্ত সিঁড়ির অবস্থা বিমানবন্দরেরটির তুলনায় অনেকটাই ভালো। এ ফুট ওভারব্রিজ শুধু পথচারী পারাপারে ব্যবহার হয়। বিশেষ করে শিক্ষার্থীরা এ চলন্ত সিঁড়ির ফুট ওভারব্রিজ ব্যবহার বেশি করে। ফুট ওভারব্রিজটির র্যাম্পগুলোর উপরে গাছ থাকায় তুলনামূলক রোদের তাপটাও কম থাকে। তাছাড়া ধুলাবালিও কম থাকে চলন্ত সিঁড়ির এই ফুট ওভারব্রিজে।
চলন্ত সিঁড়িযুক্ত দুটি ফুট ওভারব্রিজের এস্কেলেটর নিয়মিত মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে নিয়োগ দিয়েছে ডিএনসিসি। প্রতিষ্ঠানটি নিয়মমাফিক প্রতি বছর ৩৬ বার করে দুটি ফুট ওভারব্রিজের চলন্ত সিঁড়ি সার্ভিসিং করেছে। শুধু মেরামতের জন্যই হরাইজন বিডি নামের ওই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে ৩০ লাখ টাকা দিতে হয়েছে।
ডিএনসিসির সংশ্লিষ্ট বিভাগের দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা জানান, নিয়মিত মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণের বাইরেও চলন্ত সিঁড়ির দুটি ফুট ওভারব্রিজ গত বছরই ৫৬ বার মেরামত করা লেগেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি মেরামত করা লেগেছে বিমানবন্দর সড়কের ফুট ওভারব্রিজটি। ৪৮ বার এই ফুট ওভারব্রিজের চলন্ত সিঁড়ি বিকল হয়। এর মধ্যে একবার চলন্ত সিঁড়ির মোটর নষ্ট হয়। সে সময় প্রায় ১৩ দিন মেরামতকাজ চালিয়েও মোটরটি সচল করা যায়নি। পরে নতুন মোটর সংযোজনের মাধ্যমে চলন্ত সিঁড়িটি সচল করা হয়।
এর মাস দুয়েকের মাথায় অতিরিক্ত চাপের ফলে চলন্ত সিঁড়ির ওই ফুট ওভারব্রিজের বেল্ট ছিঁড়ে যায়। পরে নতুন বেল্ট স্থাপন করে চলন্ত সিঁড়িটি সচল করা হয়। বিমানবন্দরের পাশে অবস্থিত চলন্ত সিঁড়ির ফুট ওভারব্রিজটির তুলনায় অনেক কম মেরামত করা লাগলেও বনানীর ফুট ওভারব্রিজটি নিয়েও ভোগান্তির শেষ ছিল না পথচারীদের। চলস্ত সিঁড়ির এই ফুট ওভারব্রিজটি গত বছর নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণের পাশাপাশি মেরামত করা লেগেছে ১৮ বার।
প্রকৌশলীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এ ধরনের চলন্ত সিঁড়ির ব্যবহার হয় সাধারণত বিপণিবিতান ও বিমানবন্দরের অভ্যন্তরে। উন্নত দেশের ফুট ওভারব্রিজেও এ ধরনের চলন্ত সিঁড়ি যুক্ত করা হয়। তবে সেগুলো থাকে একটি টানেলের মধ্যে এবং পুরোটা এয়ারটাইট শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত অবস্থায়। ফলে ওই চলন্ত সিঁড়িগুলোর মোটর বা বেল্টে কোনো প্রকার ধুলাবালি প্রবেশ করে না। তাছাড়া উন্নত দেশগুলোয় এ ধরনের চলন্ত সিঁড়িযুক্ত ফুট ওভারব্রিজগুলো শুধু শিশু, প্রতিবন্ধী ও বয়স্ক মানুষ ব্যবহার করে। কিন্তু আমাদের এখানে হয় উল্টোটা। মহাসড়কের পাশে খোলা পরিবেশে চলন্ত সিঁড়ি স্থাপন করা হয়েছে। নেই শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থাও। ফলে রাস্তার ধুলাবালি, রোদের তাপ ও অতিরিক্ত ওজন বহন করায় দ্রুত নষ্ট হচ্ছে চলন্ত সিঁড়িগুলো।
বর্তমানে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন এলাকায় ফুট ওভারব্রিজ রয়েছে ৮৪টি। এর মধ্যে ৫৫টিই ডিএনসিসি এলাকায়। পর্যায়ক্রমে এসব ফুট ওভারব্রিজে চলন্ত সিঁড়ি যুক্ত করা হলে এর মেরামতে প্রতি বছর ব্যয় করতে হবে অন্তত ৮ কোটি ২৫ লাখ টাকা। এর বাইরেও বিদ্যুৎ বিলসহ অন্যান্য রক্ষণাবেক্ষণে ব্যয় হবে সাড়ে ৫ কোটি টাকা। আর সব ফুট ওভারব্রিজে চলন্ত সিঁড়ি যুক্ত করা হলে তা মেরামতে ব্যয় হবে বছরে ১৩ কোটি আর রক্ষণাবেক্ষণে খরচ হবে আরো ৮ কোটি টাকা।