শওকত আলী; বাসায় নিরাপদ খাবার পানির জন্য জারের পানি নেওয়া শুরু করি বছর দুয়েক আগে। কিন্তু জারের পানির মধ্যেও নাকি মলের জীবাণু থাকে! তার পরও বাধ্য হয়ে খেতে হচ্ছে। ওয়াসার পানি তো আরো ময়লা, দুর্গন্ধযুক্ত।’ জীবনের জন্য অত্যাবশ্যকীয় পানি নিয়ে এভাবেই নিজের তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা বলেন রাজধানীর কাজীপাড়ার বাসিন্দা আরিফুর রহমান চঞ্চল। সম্প্রতি রাজধানীর বেশ কয়েকটি এলাকা ঘুরে অভিজাত কিছু হোটেল ছাড়া অন্য বেশির ভাগ হোটেল-রেস্তোরাঁ ও অস্থায়ী দোকানে নিম্নমানের জারে পানি রেখে বিক্রি করতে দেখা গেছে। ওই সব জার ফুড গ্রেড (খাদ্যসামগ্রী রাখার উপযোগী) নয়। প্রতিষ্ঠানের নাম, উৎপাদনের তারিখ, মেয়াদও লেখা নেই জারের গায়ে। অথচ ওই সব জারের পানি দেদার বিক্রি হচ্ছে প্রতি গ্লাস এক টাকা দরে।
মনিপুরিপাড়ার বাসিন্দা তারানা পারভিন চাকরি করেন একটি বেসরকারি সংস্থায়। সাপ্তাহিক ছুটির দিন ছাড়া পছন্দের দোকান থেকে কেনাকাটা করার সুযোগ পান না। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ছুটির দিনে যতটা সম্ভব পছন্দের দোকান থেকে বেছে বেছে কেনাকাটা করার সুযোগ হয়। কিন্তু শাকসবজি তো আর এক দিন কিনে সাত দিন খাওয়া যায় না। অফিস থেকে ফিরতে রাত ৮টাও পেরিয়ে যায়। তখন বাধ্য হয়েই পাড়ার ছোট দোকান থেকে প্রয়োজনীয় কিছু শাকসবজি কিনতে হয়। সেই শাকসবজি কতটা নিরাপদ তা নিয়ে মনে সংশয় থেকেই যায়। তবু না খেয়ে তো পারি না। আর তরল দুধে অ্যান্টিবায়োটিক, ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়ারসহ নানা রকম ভেজাল ও দূষণের কথা প্রায়ই শুনি। তাই ইউএইচটি মিল্ক ছাড়া অন্য কোনো তরল দুধ কিনি না পারতপক্ষে। মাছ-মাংস কিনি সুপারশপ থেকে। তবু ভয় থেকেই যায় মনে।’
শুক্রাবাদের বাসিন্দা আলতাফ হোসেন বলেন, ‘শাকসবজিতে বিভিন্ন কীটনাশকের অতিরিক্ত ব্যবহারের কথা প্রায়ই শুনি। মনে ভয় কাজ করে, এগুলো খেয়ে শরীরের হয়তো অনেক ক্ষতি হচ্ছে। কিন্তু শাকসবজি না খেয়েও তো উপায় নেই।’
লালমাটিয়ার স্কুলশিক্ষক তানিয়া সুলতানা বলেন, ‘মিডিয়ায় দেখি ব্রয়লার মুরগির খাবার হিসেবে ট্যানারির বর্জ্য ব্যবহার করা হয়। এতে মাংস অনিরাপদ হয়ে পড়ছে ভয়ানক মাত্রায়। বড় কিছু কম্পানির ব্রয়লার মুরগির মাংসেও উচ্চমাত্রার অ্যান্টিবায়োটিকের উপস্থিতি পাওয়া গেছে বলে মিডিয়ায় এসেছে। ওই মাংস খেলে তা থেকে অ্যান্টিবায়োটিক ঢুকে যায় মানুষের শরীরেও। আর মাছ-মাংসসহ বিভিন্ন খাদ্যে ভেজাল তো প্রায়ই ধরা পড়ছে ভ্রাম্যমান আদালতের অভিযানে। এসব দেখে খাদ্যসামগ্রী নিয়ে কার মনে ভয় কাজ না করে!’
রামপুরা এলাকার দীপা রানী বলেন, ‘ভেজাল এত বেড়েছে যে শঙ্কিত না হয়ে উপায় নেই। তবে খাওয়া বাদ রাখারও সুযোগ নেই। কারণ যেগুলোতে ভেজাল, সেগুলোই আমাদের প্রয়োজনীয় খাবার।’
শনির আখড়ার আনিসুল ইসলাম বলেন, ‘ভেজাল জেনেও খাচ্ছি। না খেয়ে তো উপায় নেই।’
গত এক মাসে ঢাকার বিভিন্ন এলাকার ২৫ জন ভোক্তার সঙ্গে কথা বললে সবাই খাদ্যে ভেজাল ও দূষণ নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেন। তাঁরা বলেন, এমন অবস্থা যে কোনো কিছুই আর আস্থা নিয়ে খাওয়ার পর্যায়ে নেই। খেতে হচ্ছে ভয়ে ভয়ে। কেউ কেউ বলেছেন, নামি ব্র্যান্ডের পণ্য কিনেও স্বস্তি পান না তাঁরা। তবে দুজন একটু ভিন্ন ধরনের মন্তব্য করেন। ঢালাওভাবে আস্থাহীনতার কথা বলেননি তাঁরা। মিরপুরের বাসিন্দা শামসুল আরেফিন বলেন, ‘ঢালাওভাবে সব পণ্যকে খারাপ বলার সুযোগ নেই। নির্দিষ্ট কিছু বিষয়ে মান নিয়ে প্রশ্ন তোলা যেতে পারে।’
পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের (পবা) চেয়ারম্যান আবু নাসের খান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘খাদ্যে ভেজাল, কীটনাশক ও রাসায়নিকের মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহারের কারণে সাধারণ ভোক্তারা কোনো খাবারেই নিশ্চিন্ত হতে পারছে না, স্বস্তি পাচ্ছে না। ব্যাপক পরিসরে এই খাদ্যভীতি মানুষকে গ্রাস করেছে। কিন্তু খাবার না খেয়েও কোনো উপায় নেই।’ তিনি আরো বলেন, ‘এই পরিস্থিতি থেকে বেরোতে হলে উৎপাদন থেকে শুরু করে খাবার টেবিল পর্যন্ত পুরো চেইন একটি কাঠামোর মধ্যে আনতে হবে, যাতে সহজে নজরদারি করা যায়। এটা নিশ্চিত করে সরকারকেই বলতে হবে কোন খাবার নিরাপদ, কোনগুলো অনিরাপদ।’
কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘মনিটরিং সংস্থাগুলো দুর্বল করে রাখা হয়েছে। অনেকের গাফিলতি রয়েছে, অনেকে আবার চাইলেও সব কাজ করতে পারছে না। কিন্তু যেহেতু নিরাপদ খাদ্যের বিষয়ে এখন সরকারের একটা রাজনৈতিক অঙ্গীকার রয়েছে, সেহেতু সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোকে কার্যকরীভাবে কাজে লাগাতে হবে। নইলে এই অবস্থা থেকে বের হওয়া যাবে না।’
বিএআরসির পুষ্টি ইউনিটের পরিচালক ড. মো. মনিরুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘পানি শরীরের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। তবে নিরাপদ পানির সহজলভ্যতার জন্য নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠানগুলোকে সেভাবে কাজ করতে দেখা যায় না।’
বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশনের (বিএসটিআই) ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযানের মুখে কিছু প্রতিষ্ঠান জারের গায়ে উৎপাদনের তারিখ ও উপাদানের স্টিকার লাগানো শুরু করলেও এখনো অনেক হোটেল বা দোকানে নন-ফুড গ্রেডের জারই বেশি চোখে পড়ে। গত ৮ মে নয়াপল্টন এলাকায় অভিযান চালিয়ে রাস্তায় পানি বহনকারী পিকআপ ভ্যান আটকে প্রায় ৫০০ পানির জার ধ্বংস করা হয়। বিএসটিআইয়ের উপপরিচালক রিয়াজুল হক কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘অবৈধ জার ও পানির বিরুদ্ধে আমাদের অভিযান চলবেই। তবে স্থায়ীভাবে সমাধানের কিছু পরিকল্পনা আছে, যেগুলো নিয়ে দ্রুতই কাজ শুরু হবে।’
এ বছরের শুরুতে হাইকোর্টের একটি রুলের পরিপ্রেক্ষিতে খাবার পানি পরীক্ষা করে বিএসটিআই। ২২টি ব্র্যান্ডের জার ও বোতলের পানি পরীক্ষা করে সাতটি ব্র্যান্ডের পানিই মানহীন পাওয়া যায়। বছর দেড়েক আগে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের (বিএআরসি) এক গবেষণায় রাজধানীর বাসাবাড়ি, অফিস-আদালতে সরবরাহ করা ৯৭ শতাংশ জারের পানিতে ক্ষতিকর মাত্রায় কলিফর্ম বা মানুষ ও প্রাণীর মলের জীবাণু মেলে। সম্প্রতি আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র বাংলাদেশের (আইসিডিডিআরবি) একাধিক পরীক্ষায় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের পাস্তুরিত দুধ এবং গরুর কাঁচা দুধেও ধরা পড়েছে ক্ষতিকর মাত্রার অ্যান্টিবায়োটিক ও ব্যাকটেরিয়া। বিএআরসির সর্বশেষ এক গবেষণায় উচ্চমাত্রার অ্যান্টিবায়োটিক পাওয়া গেছে নামিদামি কম্পানিগুলোর ব্রয়লার মুরগিতে।
পুষ্টির চাহিদা বিবেচনায় দৈনন্দিন খাদ্যতালিকার অন্যতম উপাদান দুধ। বিশেষ করে ছোট শিশুদের জন্য দুধ অপরিহার্য। শহরের মানুষ মূলত নামি কয়েকটি কম্পানির পাস্তুরিত দুধের ওপর নির্ভরশীল। অথচ গত বছর আইসিডিডিআরবির এক পরীক্ষায় দেখা যায়, বিভিন্ন ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়ার উপস্থিতির কারণে বাজারে পাওয়া পাস্তুরিত তরল দুধের ৭৫ শতাংশই অনিরাপদ। এসংক্রান্ত প্রতিবেদন প্রকাশিত হওয়ার পর আবার নির্দেশনা জারি করেন হাইকোর্ট। সে অনুযায়ী বাজারে থাকা পাস্তুরিত তরল দুধের মান পরীক্ষার জন্য একটি কমিটি করে দেয় খাদ্য মন্ত্রণালয়। কমিটি বাজারের সব ব্র্যান্ডের পাস্তুরিত তরল দুধ পরীক্ষা করে প্রথম সারির ছয়টি ব্র্যান্ডের দুধে ক্ষতিকর মাত্রায় ব্যাকটেরিয়া ও কলিফর্মের উপস্থিতি পেয়েছে। সেই সঙ্গে পাস্তুরিত দুধ বাজারজাতকরণ ব্যবস্থার ত্রুটি চিহ্নিত করে প্রয়োজনীয় সুপারিশ দিয়েছে।
কিন্তু সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, ওই সুপারিশ অনুযায়ী দুধ পরিবহনকারী সব ভ্যান আধুনিকায়ন করা হয়নি। নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় সংরক্ষণ করা, প্যাকেটের গায়ে বড় করে তাপমাত্রার নির্দেশনা দেওয়ার সুপারিশও বাস্তবায়িত হয়নি পুরোপুরি। এখনো খুচরা বিক্রেতারা জানে না ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় পাস্তুরিত দুধ সংরক্ষণ করার নিয়ম। মেরুল বাড্ডার ডিআইটি প্রজেক্টের ১২ নম্বর রোডে বিসমিল্লাহ জেনারেল স্টোরে এক পাশে স্বচ্ছ কাচ থাকায় ফ্রিজের বাইরে থেকেই বিভিন্ন কম্পানির পাস্তুরিত দুধের প্যাকেট দেখা যায়। তবে ফ্রিজটি কত তাপমাত্রায় চালু আছে, তা দোকানি জানেনই না। তিনি বলেন, ‘ওটা তো যে কম্পানির ফ্রিজ, ওরাই ঠিক করে দিয়ে গেছে।’ দুধ রাখতে হলে ফ্রিজের তাপমাত্রা কত রাখতে হবে জানতে চাইলে তিনি আরো বলেন, ‘তা জানি না। তবে দুধ তো নষ্ট হয় না, ঠিকই আছে।’ আরো কয়েকজন দোকানির সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তারা রাতে দোকান বন্ধ করার সময় ফ্রিজও বন্ধ করে রেখে যায়। পরদিন সকালে আবার চালু করে। নির্ধারিত তাপমাত্রার বিষয়টিও জানে না বেশির ভাগ দোকানি। আবার কেউ কেউ জানলেও মানে না। মহানগর প্রজেক্টের হারুন ট্রেডার্সের হারুনুর রশিদ বলেন, ‘কম্পানি থেকে বলছে ৪ ডিগ্রি তাপমাত্রায় রাখার কথা। বেশি থাকলেও দুধে সমস্যা হয় না।’
পুষ্টিবিজ্ঞানীদের মতে, দুধ পাস্তুরিত করা হলেও শতভাগ জীবাণু ধ্বংসের নিশ্চয়তা থাকে না। এ অবস্থায় দেশের বিভিন্ন কম্পানি ইউএসটি মিল্ক বাজারজাত করতে শুরু করে। এটিও পুরোপুরি নিরাপদ নয়। বিভিন্ন দেশে এখন হাই প্রেসার প্রসেসিং (এইচপিপি) পদ্ধতিতে দুধ প্রক্রিয়াজাত ও বাজারজাত করা হচ্ছে, যা অনেক বেশি নিরাপদ। কিন্তু বাংলাদেশে কোনো প্রতিষ্ঠান ওই প্রযুক্তি ব্যবহার করছে না। মিল্ক ভিটার চেয়ারম্যান শেখ নাদির হোসেন লিপু কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এইচপিপি প্রক্রিয়াটি সম্পর্কে আমরা অবগত আছি। এটা ইউএসটি মিল্কের চেয়েও বেশি নিরাপদ। তবে এখনো বাংলাদেশের কেউ এই প্রযুক্তি ব্যবহার করছে না। মিল্ক ভিটা আবার যখন আধুনিকায়ন নিয়ে কাজ করবে তখন এই প্রযুক্তি ব্যবহার করা যায় কি না সেটা চেষ্টা করবে।’
বিদেশ থেকে অবৈধভাবে দেশে ঢুকছে মুরগি, গরু, দুম্বা ও মহিষের মাংস। মেয়াদ শেষ হওয়ার পরও সেই মাংস বিক্রি করা হয় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে। কোনো কোনো হোটেল-রেস্টুরেন্টে বিরিয়ানিসহ বিভিন্ন ধরনের ফাস্ট ফুডে ওই সব মেয়াদোত্তীর্ণ মাংস ব্যবহার করা হয়। বাজারে মেয়াদোত্তীর্ণ এবং উৎপাদন ও মেয়াদের তারিখ ছাড়া দই, মিষ্টি, পাউরুটি ধরা পড়ছে নিয়মিত। লাইসেন্স এবং উৎপাদন ও মেয়াদের তারিখ ছাড়া মুড়ি, আইসক্রিম, মুগ ডাল, চিঁড়া ভাজা, ডাল ভাজা, ফুলক্রিম মিল্ক পাউডার, পাউরুটি, বিস্কুট, ম্যাঙ্গো জুস, ফার্মেন্টেড মিল্ক (দই) উৎপাদন, আমদানি ও বাজারজাত করায় গত ৭ মে কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মামলা করে বিএসটিআই।
গত ২১ মে হাইকোর্ট ঢাকা ওয়াসার পানির উৎস থেকে গ্রাহক পর্যায় পর্যন্ত মোট ৩৪টি স্থান থেকে পানির নমুনা সংগ্রহ করে তা পরীক্ষার নির্দেশ দিয়েছেন। আগামী ২ জুলাইয়ের মধ্যে পানি পরীক্ষার প্রতিবেদন আদালতে দাখিল করতে বলা হয়েছে। একই দিনে হাইকোর্টের অপর একটি বেঞ্চ দুধ, দই ও পশুখাদ্যের নমুনা সংগ্রহ করে তাতে কী পরিমাণ ব্যাকটেরিয়া, অ্যান্টিবায়োটিক, রাসায়নিক, সিসাসহ মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর উপাদান রয়েছে তা নিরূপণ করে আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করতে নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ ও বিএসটিআইকে নির্দেশ দেন।