নিজস্ব প্রতিবেদক; জাতীয় সংসদে ২০১৮-১৯ অর্থবছরের সম্পূরক বাজেটের ওপর আলোচনা শুরু হয়েছে। আলোচনায় অংশ নিয়ে ৩০ ডিসেম্বরের জাতীয় নির্বাচন নিয়ে সরকার ও বিএনপির সংসদ সদস্যদের মধ্যে উত্তপ্ত বিতর্ক হয়েছে। বিএনপির সংসদ সদস্যরা অভিযোগ করেন, সংসদে আমরা ৬ জন (বিএনপি) প্রবেশ করলেও এই সংসদ বৈধতা পাবে না। বর্তমানের সংসদের কেউ জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত নন। নির্বাচনে তিনশ’ আসন লুট করা হয়েছে। তাই জাতীয় সংলাপ শুরুর মাধ্যমে দেশে সুশাসন ও সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক সুবাতাস ফিরিয়ে আনার জন্য সংসদ নেতার প্রতি আহ্বান জানান তারা। ব্যারিস্টার রুমিন ফারহান বলেন, আমি দাঁড়ালেই যদি পুরো সংসদ উত্তেজিত হয়ে যায়, তিনশ সদস্য যদি মারমুখী হয়ে যায়, তাহলে বক্তব্য কীভাবে রাখব? সরকারি দল আওয়ামী লীগ ও সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টি বিএনপির বক্তব্যের কঠোর সমালোচনা করে বলেন, সংসদে শপথ নিয়ে, সকল সুযোগ-সুবিধা গ্রহণে করে আবার সংসদকে অবৈধ বলা বিএনপির নির্লজ্জতা-দ্বিচারিতা ছাড়া আর কিছুই নয়। সংসদ অবৈধ হলে সংসদে আসলেন কেন? পরে সরকারি দলের দাবিতে ডেপুটি স্পিকার বিএনপির ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানার সকল অসংসদীয় বক্তব্য এক্সপাঞ্জ করে দেন।
স্পকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী এবং ডেপুটি স্পিকার ফজলে রাব্বি মিয়ার সভাপতিত্বে সংসদের বাজেট অধিবেশনের রবিবারের বৈঠকে ২০১৮-১৯ অর্থবছরের সম্পূরক বাজেটের ওপর সাধারণ আলোচনার অংশ নিয়ে বিএনপির এমপিদের বক্তব্যের সময় সরকারি দলের সদস্যরা বিতর্কে জড়িয়ে পড়লে সংসদ ক্ষণিকক্ষণের জন্য উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। আলোচনায় অংশ নেন সাবেক কৃষিমন্ত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরী, কৃষিমন্ত্রী ড. আবদুর রাজ্জাক, লে. কর্নেল (অব.) মুহাম্মদ ফারুক খান, প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক, উপাধ্যক্ষ আবদুস শহীদ, সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টির কাজী ফিরোজ রশিদ, ফখরুল ইমাম, পীর ফজলুর রহমান মিসবাহ, ডা. রুস্তম আলী ফরাজী, গণফোরামের মোকাব্বির খান এবং বিএনপির হারুনুর রশীদ, ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানা ও মোশারফ হোসেন ভুঁইয়া।
জাতীয় পার্টির সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ফখরুল ইমাম বলেন, ৭৮ ভাগ বাজেট গত বছর বাস্তবায়ন করতে পারেনি সরকার। প্রতি বছরই বাজেট বাস্তবায়নের হার কমছে। আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। ব্যাংকে টাকা নেই, সব টাকা ঋণখেলাপীদের কাছে। ২২ হাজার কোটি টাকা মূলধন ঘাটতি। দেড় লাখ কোটি টাকা ঋণখেলাপী হলে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো টিকবে কীভাবে? নির্দেশের পরও ব্যাংকের সুদের হার কমে না এতো স্পর্ধা পায় কোথায়? বিদ্যুৎ উৎপাদন বৃদ্ধি পেলেও এই খাতে ১০ হাজার কোটি টাকা ক্ষতি হচ্ছে। দেশের অর্থনীতি চাঙ্গা হলে ঋণখেলাপীরা টাকা ফেরত দিচ্ছেন না কেন?
বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব হারুনুর রশীদ বলেন, বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া আজ সরকারের রাজনৈতিক হয়রানির শিকার। তাঁকে জামিন দেয়া হচ্ছে না। উচ্চ ও নিম্ন আদালত কোনটাই স্বাধীন নয়। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিচার বন্ধ জিয়াউর রহমান নয়, খন্দকার মোশতাকের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের একটি অংশই ইনডেমনিটি জারি করেছিলেন। তিনি আরো বলেন, গত নির্বাচন কোনভাবেই জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য হয়নি। অপদার্থ নির্বাচন কমিশন নির্বাচনের নামে বিপুল অর্থ অপচয় করেছে। তাদের দ্রুত পদত্যাগ করা উচিত। এসময় জাতীয় সংলাপ শুরুর মাধ্যমে দেশে একটি সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক সুবাতাস ফিরেয়ে আনার আহ্বান জানান তিনি। এছাড়া গত ১০ বছরে কত লাখ মেট্রিক টন চাল, গম ও ডাল আমদানি করা হচ্ছে আমরা তার হিসাবও চান তিনি। বলেন, দেশ খাদ্য স্বয়ংসম্পূর্ণ এটি ঠিক নয়।
বিএনপি নেতার বক্তব্যের জবাবে পীর ফজলুর রহমান বলেন, এই সংসদ অবৈধ হলে তাঁরা (বিএনপি) আসেন কীভাবে? সংসদে থাকা আপনারা সবাই তো অবৈধ। সংসদ কখনো অবৈধ হতে পারে না, ব্যর্থতা থাকলে সেটা বিএনপির। সংসদ বৈধ বলেই তাঁরা শপথ নিয়েছেন, কথা বলছেন। এছাড়া আওয়ামী লীগের একংশ নয়, বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানই বঙ্গবন্ধু হত্যা বিচার বন্ধে ইনডেমনিটি দিয়েছিলেন। কেননা বঙ্গবন্ধু হত্যার বেনিফিশিয়ারী একমাত্র বিএনপি। ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা, বৃটিশ রাষ্ট্রদূতের ওপর গ্রেনেড হামলা, সাবেক অর্থমন্ত্রী কিবরিয়াকে গ্রেনেড হামলা করে হত্যা, অগ্নিসন্ত্রাস, পুড়িয়ে পুড়িয়ে মানুষ হত্যার কথা কি বিএনপি নেতারা ভুলে গেছেন?
জাপার কাজী ফিরোজ রশীদ বলেন, বিএনপির এক নেতা নিজেকে ঈমানদার দাবী করেছেন। যদি তাই হয় তবে শেখ হাসিনা পদ্মা সেতু করছেন, মেট্রোরেল করছেন, বড় মহাসড়কগুলো ৪ লেনে উন্নীত হচ্ছে এসব কথা সংসদে বলুন, সত্যকে সত্য বলুন। বিনা ভোটে সংসদে এসে সংসদকে অবৈধ বলা ঠিক হয়নি। আমরা সবাই নির্বাচন করে জনগণের ভোট নিয়ে এসেছি।
বিএনপির ব্যারিস্টার রুমিন ফারহান তার বক্তব্যে জিয়াউর রহমানকে স্বাধীনতার ঘোষক বলে দাবি করলে তাৎক্ষণিকভাবে সরকার দলীয় সদস্যরা তীব্র প্রতিবাদ করেন। এ সময় তিনি বলেন, আপনারা বলেছেন, আমরা সংসদে এলে কথা বলতে পারব। আমরা সংসদে এসেছি। আপনারা কথা বলতে দিচ্ছেন না। আমি প্রথম দিন দুই মিনিটও শান্তিতে কথা বলতে পারিনি। আমি দাঁড়ালেই যদি পুরো সংসদ উত্তেজিত হয়ে যায়, তিনশ সদস্য যদি মারমুখী হয়ে যায়, তাহলে বক্তব্য কীভাবে রাখব? এসময় তিনি প্রশ্ন তোলেন, বর্তমান সংসদের কয়জন জনগণের প্রত্যক্ষভোটে নির্বাচিত হয়ে এসেছেন? কীভাবে নির্বাচন হয়েছে তা দেশের জনগণ জানেন। তিনশ’ আসন লুট করে নেয়া হয়েছে। আইন, শাসন থাকলেও আইনের শাসন দেশে নেই। সরকারের সক্ষমতা ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছে। বাজেট বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে ঘাটতি রয়েছে।
গণফোরামের মোকাব্বির খান বলেন, সাধারণ মানুষ নয়, কয়েকটি স্বার্থান্বেসী ও ব্যবসায়ী মহলের দিকে তাকিয়ে বাজেট বরাদ্দ করা হয়েছে। সরকারের নানা পর্যায়ে দুর্নীতি হচ্ছে। তাই সরকারের ব্যয় সঠিক ও নিশ্চিত করতে হবে। রাজনৈতিক মহলের সঙ্গে উচ্চ মূল্যে চুক্তির কারণে বিদ্যুৎ খাতে ১০ হাজার কোটি টাকার ওপর ক্ষতি হচ্ছে। স্মার্ট বাজেটের নামে গরিবকে আরও গরিব, ধনীকে আরও ধনী করার সুযোগ দেয়া হয়েছে।
আলোচনায় অংশ নিয়ে সাবেক কৃষিমন্ত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরী বলেন, গত নির্বাচনকে বিতর্কিত করার অনেক ষড়যন্ত্র হয়েছে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কৌশলী ও উদারনীতির কারণে তারা সেটা পারেনি। বিএনপির নেতাদের উদ্দেশ্যে করে তিনি বলেন, সংসদ অবৈধ হলে সংসদে আসলেন কেন? মুখে অবৈধ বলবেন, শপথ নেবেন, সংসদের সকল সুযোগ-সুবিধা নেবেন- এটা কেমন কথা? সংসদে গণতন্ত্রের চর্চাই ভাল। নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হয়েছে বলেই সংসদে সকল বিরোধী দলও অংশ নিয়েছেন।
কৃষিমন্ত্রী ড. আবদুর রাজ্জাক বিএনপি নেতাদের বক্তব্যের সমালোচনা করে বলেন, আন্দোলনের নামে অগ্নিসন্ত্রাসের মাধ্যমে বিএনপি শত শত মানুষকে পুড়িয়ে পুড়িয়ে হত্যা করেছে। সারাদেশে ভয়াল নাশকতা চালিয়েছে। যুদ্ধাপরাধীদের রক্ষায় বিএনপি নেতারা নানা হুমকি দিয়েছে। বিএনপি নেত্রী দুর্নীতি করেছেন, আদালতের রায়ে দণ্ডিত হয়েছেন। সেখানে সরকারের কী অপরাধ? বর্তমান সরকার জনগণের ভোটে ও সমর্থন নিয়ে ক্ষমতায় রয়েছে। জনগণ থেকে আপনারা (বিএনপি) প্রত্যাখ্যাত হয়েছেন। তিনি বলেন, বিএনপির অনেকে এখনও জিয়াকে স্বাধীনতার ঘোষণা বলতে চান। কিন্তু কট্টোর বিএনপি-জামায়াত, যাদের ঘাড়ে এখনও পাকিস্তানের ভুত চেপে বসে আছে। স্বাধীনতার ঘোষণাসহ প্রতিটি কর্মকাণ্ডে রয়েছে একটিমাত্র নাম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণার আগে কেউই জিয়াউর রহমানের নামটি পর্যন্ত জানতো না।