খাবার নিয়ে এসব কী হচ্ছে

ইকতেদার আহমেদ;

মানুষের জীবনধারণের জন্য খাবার অপরিহার্য। এ পৃথিবীতে সুস্থ ও সাবলীলভাবে বেঁচে থাকতে হলে বিশুদ্ধ ও সতেজ খাবার গ্রহণের আবশ্যকতা রয়েছে। শিশু, কিশোর, যুবক, প্রৌঢ়, বৃদ্ধ সবার সুষম খাবার গ্রহণ প্রয়োজন। একটি শিশু জন্মের পরই তার খাবারের প্রয়োজন অনুভূত হয়। কিন্তু শিশু তো নির্বোধ, সে কী করে তার খাবারের চাহিদার কথা জানাবে? শিশু ভূমিষ্ঠ হওয়ার পরপরই কান্নার অভিব্যক্তিতে সে তার খাবারের চাহিদার কথা জানিয়ে দেয়। শিশুর জন্য সবচেয়ে আদর্শ খাবার মায়ের বুকের দুধ। তা পর্যাপ্ত পরিমাণে পাওয়া গেলে বলতে হবে শিশুটি ভাগ্যবান আর পর্যাপ্ত পরিমাণে পাওয়া না গেলেই যত বিড়ম্বনা। তখন বিকল্প দুধের সন্ধান করতে হয়। বিকল্প দুধের মধ্যে সবচেয়ে আদর্শ হচ্ছে গরুর দুধ। গরুর দুধে পানি মেশানোর প্রবণতা আমাদের দেশের দুধ বিক্রেতাদের মধ্যে কখন সংক্রমিত হয়েছে তা দিন, তারিখ বা সাল উল্লেখ করে সুনির্দিষ্টভাবে বলা না গেলেও মোটামুটি বলা যায় যে, প্রাচীনকাল থেকেই এটি চলে আসছে। দুধে পানি মেশানো হয়ে থাকে ব্যবসায়িক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে অধিক লাভের আশায়। মিশ্রিত পানি বিশুদ্ধ হয়ে থাকলে দুধের ঘনত্ব নিরসনে তা অনেক সময় স্বাস্থ্য উপযোগী। কিন্তু যত বিপত্তি দেখা দেয় যদি মিশ্রিত পানি দূষিত হয়। আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে বিশুদ্ধ পানির সহজলভ্যতার অভাব রয়েছে। তাই সচরাচর দুধে যে পানি মেশানো হয় তা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই যে দূষিত, সে বিষয়ে খুব একটা সন্দেহ নেই। দূষিত পানি মেশানো দুধ খেলে যেকোনো বয়সের ব্যক্তির উপকারের চেয়ে অপকার বেশি হবে তা সবারই জানা।

আমাদের দেশে এখনো গরুর দুধের তুলনায় বিভিন্ন মানের প্যাকেটজাত গুঁড়ো দুধের দাম কম। নিম্নমানের প্যাকেটজাত গুঁড়ো দুধে প্রায়ই ক্ষতিকারক রাসায়নিক ও তেজস্ক্রিয় পদার্থের উপস্থিতি পরিলক্ষিত হয়। ব্যবসায়িক মনোবৃত্তি থেকে অসাধু দুধ বিক্রেতারা গরুর দুধের সাথে কম দামের ভেজাল গুঁড়ো দুধ মিশিয়ে বিক্রি করে জনস্বাস্থ্য বিপন্ন করে তুলছে।

ইদানীং আমাদের দেশের এক শ্রেণীর প্রতারক অভিনব পন্থায় কৃত্রিমভাবে গরুর তরল দুধ বানিয়ে তা মিল্কভিটা, আড়ং, প্রাণ, ফার্ম ফ্রেশ প্রভৃতি স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বাজারজাত করে নকল দুধের ব্যবসায়িক সাফল্যে আত্মসন্তুষ্টিতে মগ্ন। অভিজাত ও সাধারণ মিষ্টির দোকানে যেসব মিষ্টান্ন সামগ্রী বিক্রি করা হচ্ছে, এগুলো তৈরিতে খাঁটি দুধের ব্যবহার হয়েছে কি না সে নিশ্চয়তা দেয়ার কেউ কি আছে?
‘কনডেন্সড মিল্ক’ যার বাংলা অর্থ ঘনীভূত দুধ। বাজারে যেসব ব্র্যান্ডের কনডেন্সড মিল্ক পাওয়া যাচ্ছে তার প্রতিটিরই কৌটার মধ্যে দৃষ্টিগ্রাহ্যভাবে বিদেশী উন্নত জাতের গাভীর ছবি শোভা পাচ্ছে। কিন্তু এ কনডেন্সড মিল্কে যে গরুর দুধের লেশমাত্র নেই তা কয়জন ক্রেতা অনুধাবন করতে সক্ষম। তা ছাড়া কৌটার গায়ে গাভীর ছবি দিয়ে যে ক্রেতাদের প্রতারিত করা হচ্ছে তা প্রতিকারে রাষ্ট্রযন্ত্রের তৎপরতাই বা কেন নি®প্রভ?

নিঃসন্দেহে গরুর দুধ সবচেয়ে আদর্শ ও নির্ভরযোগ্য সুষম খাবার। সুস্থ-অসুস্থ নির্বিশেষ সব বয়স ও শ্রেণী-পেশার মানুষের জীবনের গতি মৃত্যুর পূর্বক্ষণ পর্যন্ত সচল রাখতে হলে দুধের বিকল্প অন্য কিছুর কথা কি ভাবা যায়? ভাবা যায় না বলেই সচেতন নাগরিক সমাজ উদ্বগ্ন। কিন্তু প্রতারক চক্রের অশুভ প্রভাব এত সুদূরপ্রসারী যে তাদের উদ্বিগ্নতা সেখানে অসহায়।

এ তো গেল দুধের কথা। এর বাইরে প্রাত্যহিক আমরা যেসব খাবার গ্রহণ করি তার মধ্যে রয়েছে চাল, ডাল, তেল, লবণ, পেঁয়াজ, রসুন, আটা-ময়দা, হলুদ-মরিচ, মাছ-গোশত, ফলমূল প্রভৃতি।

প্রথমেই চালের কথায় আসা যাক। বিমানের অবসরপ্রাপ্ত পাইলট আতাউর রহমান দেশের একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে অন্যান্য বিষয়ের পাশাপাশি খাবার নিয়ে যে সাধারণ জনগণ প্রতিনিয়ত প্রতারিত হচ্ছে সে বিষয়ে উদ্বিগ্ন। মসজিদে জামাতে বিশেষত তারাবি ও জুমা প্রায়ই পাশাপাশি পড়ার সুবাদে তার সাথে পরিচয় এবং সে সূত্রে মাঝে মধ্যে আলাপচারিতায় মতবিনিময়। তিনি একদিন বললেন, আমরা মিনিকেট নামে যে চালের ভাত খাই, মূলত এ নামে কোনো চাল বা ধান নেই। ইরির বিভিন্ন প্রজাতির চাল মেশিনের সাহায্যে চিকন করে এ চালের নামকরণ করা হয়েছে। এটি অসাধু ও প্রতারক ব্যবসায়ীদের উদ্ভাবন। এতে কেজিপ্রতি অতিরিক্ত লাভ ১০-১৫ টাকা।

পোলাও, বিরিয়ানি, ফিরনি, পায়েস প্রভৃতি রান্নায় যেসব দেশজ সুগন্ধি চাল ব্যবহার করা হয় তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে কালিজিরা, চিনিগুঁড়া, সাক্কর খোরা প্রভৃতি। এসব ধানের খেতের পাশ দিয়ে ধান পরিপক্ব হওয়াকালীন হেঁটে গেলে যে সুগন্ধ বের হতো তাতে প্রাণ জুড়িয়ে যেত। এসব ধানের চাল যেকোনো স্থানে রাখলে আশপাশের সবাই সুগন্ধের কারণে চালের অস্তিত্ব অনুভব করত। এসব নামের চাল এখন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান প্যাকেটজাত করে বিক্রি করছে। বাজার থেকে খোলা বা প্যাকেটজাত এসব চাল ক্রয় করলে চালের মধ্যে ও রান্নাকালীন বা রান্না-পরবর্তী আগের মতো সুগন্ধ পাওয়া যায় না। দোকানিদের সুগন্ধ না থাকার বিষয়ে জিজ্ঞেস করা হলে বলে, নতুনটায় সুগন্ধ থাকে আর পুরনো চালে সুগন্ধ না থাকলেও রান্নার পর পাওয়া যাবে। বাস্তবে পরীক্ষা করে দেখা গেল, দোকানিদের কথা আদৌ সত্য নয়। কোনো অবস্থাতেই সুগন্ধের অস্তিত্ব নেই। আজ থেকে ৪০-৫০ বছর আগে গ্রামীণ সমাজে মৃত্যুশয্যায় শায়িত ব্যক্তিকে শেষ বাসনার কথা জিজ্ঞেস করা হলে বলত সাক্কর খোরা চালের ভাত রান্না করে খাওয়াতে। বাসনা অনুযায়ী খাওয়াতে না পেরে নোয়াখালীর এক সদ্যবিধবা হওয়া বৃদ্ধাকে স্বামীর মৃত দেহ কবরে নেয়ার সময় বিলাপ করে বলতে শোনা গেছে- ‘হেতেন কইছিলো সাক্কর খোরা চাইলদি বাত রাইনতো’ (উনি বলেছিলেন সাক্কর খোরা চাল দিয়ে ভাত রান্না করতে)।

এসব চালে সুগন্ধের অনুপস্থিতি অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে অভিনব প্রতারণার তথ্য। প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, পাইজামের আতপ চালকে মেশিনের সাহায্যে চিকন করে চিনিগুঁড়া, কালিজিরা, সাক্কর খোরা প্রভৃতি নামে চালিয়ে দেয়া হচ্ছে। এতে কেজিপ্রতি অতিরিক্ত ২০-৩০ টাকা লাভ হয়। ভোজ্যতেলের মধ্যে আমাদের দেশে বর্তমানে সরিষা, সয়াবিন ও পামঅয়েল এ তিনটির ব্যবহার হতে দেখা যাচ্ছে। মূল্যের দিক থেকে পামঅয়েল, সয়াবিন ও সরিষা ক্রমান্বয়ে একটির চেয়ে অপরটি অধিক। এ অধিক দামের বিষয়টি মাথায় রেখে অসাধু ব্যবসায়ী ও প্রতারক চক্র পামঅয়েল দিয়ে সয়াবিন তেল আবার সয়াবিন তেল দিয়ে সরিষার তেল বানিয়ে ছলচাতুরীর মাধ্যমে সহজ সরল ভোক্তাদের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে।

যেসব মাছ সরাসরি বাতাস থেকে অক্সিজেন গ্রহণ করতে পারে না, ওই সব মাছ পানি থেকে ডাঙ্গায় তোলার অব্যবহিত পর মারা যায়। মাছ দ্রুত পচনশীল প্রাণী। মাছকে পচনশীলতা থেকে রক্ষা করার জন্য অসাধু ব্যবসায়ীরা ছোট মাছের ক্ষেত্রে মাছের বহিরাবরণে ফরমালিনযুক্ত পানি ছিটিয়ে এবং বড় মাছের ক্ষেত্রে সিরিঞ্জের মাধ্যমে মাছের অভ্যন্তরে ফরমালিনের প্রবেশ ঘটিয়ে পচনশীলতা রোধ করে কাক্সিক্ষত মুনাফা ধরে রাখতে সমর্থ হচ্ছে, কিন্তু এতে যে ভোক্তাদের সর্বনাশ ঘটছে, সে বিষয়ে তরা একেবারেই উদাসীন। আজিমপুর কবরস্থানের গোরখোদকদের সূত্রে প্রকাশ, আগে অসংরক্ষিত কবরের মৃতদেহের পচন প্রক্রিয়া তিন মাসে শেষ হয়ে কেবল মাথা ও হাড় অক্ষত থাকত, কিন্তু এখন ছয় মাসেও পচন প্রক্রিয়া শেষ হয় না। কারণ হিসেবে তাদের অভিমত, বিভিন্ন খাবারের মাধ্যমে শরীরের অভ্যন্তরে যে ফরমালিনের প্রবেশ ঘটছে তা পচন প্রক্রিয়াকে শ্লথ করে দিচ্ছে।

আটা বা ময়দা তৈরির ক্ষেত্রে গমই একমাত্র উপাদান হিসেবে ব্যবহৃত হয়। পার্থক্য হচ্ছে, আটা তৈরির সময় খোলসসহ চূর্ণ করা হয়। অপর দিকে ময়দার ক্ষেত্রে খোলস অপসারণপূর্বক চূর্ণ করা হয়। যে কারণে আটার রঙ একটু লালচে এবং ময়দা ধবধবে সাদা হয়। বিগত দু-এক বছর থেকে আমাদের দেশে যে ভুট্টা উৎপন্ন হয় তাতে অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটানোর পরও দু-তিন লাখ টন উদ্বৃত্ত থাকে। ভুট্টার বাজারদর তুলনামূলকভাবে গমের চেয়ে বেশ কম। মূল্যের এ পার্থক্য দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে খোলা ও প্যাকেটজাত আটা ব্যবসার সাথে জড়িত কিছু ব্যবসায়ী গমের সাথে ভুট্টার আটার সংমিশ্রণ করে বাজারজাত করছে। এতে দেখা যায়, ভুট্টামিশ্রিত আটা দিয়ে রুটি বা পরোটা বানালে আগুনে সেঁক দেয়ার পরক্ষণে তা কোমলতা হারিয়ে ফেলে এবং স্বাদের ক্ষেত্রেও ভিন্নতা পাওয়া যায়। কিন্তু তাতে অসাধু বা প্রতারক ব্যবসায়ীর কী আসে-যায়। তার পকেট ভরলেই তো হলো।

ফল ভিটামিনসমৃদ্ধ হওয়ায় মানবদেহকে রোগমুক্ত রাখার ক্ষেত্রে এর গুরুত্ব অপরিসীম। পৃথিবীর প্রতিটি অঞ্চলের জনমানুষের স্বাস্থ্যের উপযোগী ফল সে অঞ্চলে উৎপন্ন হয়। কিন্তু আমাদের ক্ষেত্রে স্বল্প রাজস্বে বিদেশী ফলের বিশেষত আপেল, আঙুর, আনার, কমলা, মোসম্বি প্রভৃতির অবাধ আমদানির সুযোগ দেয়ায় দেশীয় ফলের বাজার বিদেশী ফল দখল করে নিয়েছে। এসব বিদেশী ফলে রফতানি-পূর্ববর্তী বিশেষ পদ্ধতিতে ক্ষতিকারক রাসায়নিকের পানি ছিটানোর কারণে দেখা যায় ফ্রিজে না রাখলেও দীর্ঘ তিন মাসে ফলের সতেজতা নষ্ট হচ্ছে না। রোগীর পথ্য হিসেবে বিবেচিত ফল যে ক্যান্সারের মতো মরণব্যাধির জন্ম দিচ্ছে তা রোগী বুঝতে পারলে কি এ ফল আহার করত?

দেশীয় ফল যে রাসায়নিকমুক্ত ফল সে নিশ্চয়তাই বা কোথায়। দেশীয় ফলের মধ্যে কাঁঠাল, পেয়ারা, কুল, লটকন প্রভৃতি এখনো রাসায়নিকের ছোবলমুক্ত। রাসায়নিকমুক্ত আম খাওয়ার অভিপ্রায়ে ইদানীং অনেককে বলতে শোনা যায় রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, ঈশ্বরদী, দিনাজপুর ও সাতক্ষীরা থেকে রাসায়নিকমুক্ত আম এনেছি, নিশ্চিন্তে খেতে পারেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে আমার অনুজ এবং সৎ ও নির্দলীয় মেয়র প্রার্থী হিসেবে বহুল আলোচিত ড. তুহিন মালিক দেশে থাকাকালীন তার বাসায় গেলে যথেষ্ট আন্তরিকতার সাথে আপ্যায়ন করতে থাকল। আপ্যায়নের শেষ পর্বে ছিল আম। তুহিন বলে, ‘আমি ঈশ্বরদী থেকে রাসায়নিকমুক্ত আম আনাই নির্ভয়ে খান।’ কিন্তু তুহিনের মতো অনেকেই হয়তো জানে না, আমের মুকুল আসার পরক্ষণেই পরাগায়নের প্রাক্কালে গাছে রাসায়নিক ছিটিয়ে পরাগায়ন শতভাগ নিশ্চিত করার জন্য তাপ বৃদ্ধি করা হয়। এতে করে যে প্রাথমিক পর্যায়ে আমের অভ্যন্তরে রাসায়নিকের প্রবেশ ঘটে তার পরিসমাপ্তি ঘটে পরিপূর্ণতা লাভের পর আহারের মধ্য দিয়ে।

ভেজাল, দূষিত ও রাসায়নিকযুক্ত খাবার প্রতিনিয়ত আমাদের নশ্বর দেহের ওপর মরণবিধ্বংসীরূপে ক্রিয়াশীল হলেও আইনের শৈথিল্য ও প্রয়োগে শিথিলতায় এর ব্যাপকতা রোধ অসাধু ব্যবসায়ী ও প্রতারকদের অবৈধ প্রভাবের কাছে হার মানতে বসেছে। আর এভাবে হার মানলে ভেজাল, দূষিত ও রাসায়নিকযুক্ত খাবার হবে আমাদের নিত্য আহার্য।

লেখক : সাবেক জজ ও সাবেক রেজিস্ট্রার, সুপ্রিম কোর্ট
E-mail: [email protected]
ইকতেদার আহমেদ

জাতীয় শীর্ষ সংবাদ