রাজনীতিতে নিষ্প্রভ হয়ে পড়েছে একসময়ের আলোচিত বিকল্পধারা বাংলাদেশ। রাজনৈতিক কিংবা সাংগঠনিক- কোনোভাবেই আর তৎপর নেই দলটি; সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে আকস্মিক আলোচনা সভা ও গণমাধ্যমে বিবৃতি দেওয়ার ভেতর। প্রতিষ্ঠার ১৫ বছর পরও কোনো ব্যাপ্তি ঘটেনি এ দলের, হয়নি কাউন্সিলও।
অবশ্য ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের দলীয় প্রতীক নৌকা মার্কায় দু’জন এমপি নির্বাচিত হয়েছেন এই দল থেকে। তবে কোথাও তাদের সরব উপস্থিতি নেই। দলের জাতীয়তাবাদী আদর্শ পাশ কাটিয়ে আওয়ামী লীগের সঙ্গে সমঝোতার রাজনীতি নিয়ে বিকল্পধারার তৃণমূলে অসন্তোষ বিরাজ করছে। কেন্দ্রীয় নেতাদের মধ্যেও রয়েছে ক্ষোভ। তারা উপযুক্ত সময়ের জন্য অপেক্ষা করছেন বলে জানা গেছে।
বিকল্পধারা বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ ও সাবেক রাষ্ট্রপতি অধ্যাপক ডা. এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরী। এ ছাড়া মহাসচিব মেজর (অব.) আবদুল মান্নান এমপি, বি. চৌধুরীর ছেলে এবং দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য মাহী বি. চৌধুরী এমপিও দল পরিচালনায় প্রধান ভূমিকা রাখছেন।
ডা. এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরী সমকালকে জানান, বিকল্পধারা কোনো বড় দল নয়। তবে ছোট দল হলেও নীতির ভিত্তিতে কাজ করছে। দেশকে সন্ত্রাসমুক্ত, দুর্নীতিমুক্ত, মাদকমুক্ত করতে আর আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় দলটির নেতাকর্মীরা কাজ করছেন। সরকারের সঙ্গে তাদের সম্পর্কের বিষয়ে তিনি বলেন, আমরা সরকারের ইতিবাচক কাজকে সমর্থন করছি। এর মধ্য দিয়ে দেশে ইতিবাচক রাজনীতির ধারা চালু হয়েছে।
দলের গঠন প্রক্রিয়া ও নেতৃত্ব :২০০৪ সালের মার্চে বিকল্পধারা বাংলাদেশ গঠন করেন অধ্যাপক ডা. এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরী। তিনি বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের শাসনামলে উপপ্রধানমন্ত্রী ছিলেন। ২০০১ সালে বিএনপি রাষ্ট্রক্ষমতায় আসার পর তিনি প্রথমে পররাষ্ট্রমন্ত্রী হন। পরে ২০০১ সালের নভেম্বরে তিনি রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নেন। ২০০২ সালে এক বিতর্কিত ঘটনার জের ধরে তিনি রাষ্ট্রপতির পদ থেকে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন।
প্রতিষ্ঠার শুরু থেকেই বি. চৌধুরী বিকল্পধারার প্রেসিডেন্ট এবং মেজর (অব.) আবদুল মান্নান মহাসচিব হিসেবে ভূমিকা রাখছেন। পাশাপাশি বি. চৌধুরীর ছেলে মাহী বি. চৌধুরীকে শুরুতে সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব এবং একাদশ জাতীয় নির্বাচনের আগে দলটির প্রেসিডিয়াম সদস্য করা হয়েছে।
ভোটের রাজনীতি ও নির্বাচন :প্রতিষ্ঠার শুরুতেই বিকল্পধারা গণফোরামসহ আরও কয়েকটি দলের সঙ্গে যুক্তফ্রন্ট গঠন করে। তবে ক্ষমতাসীন বিএনপির নেতাকর্মীদের রোষানলে পড়ে তখন যুক্তফ্রন্টের কর্মসূচি থেকে নিষ্ফ্ক্রিয় হয়ে পড়েন ড. কামাল হোসেন। ২০০৬ সালের ২৬ অক্টোবর বিএনপির স্থায়ী কমিটির সাবেক সদস্য কর্নেল (অব.) অলি আহমদ দল থেকে বেরিয়ে লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এলডিপি) গঠন করেন। একই দিন বি. চৌধুরী তার দল বিকল্পধারাকে বিলুপ্ত করে এলডিপির সঙ্গে যৌথ নেতৃত্বে ঐক্যের রাজনীতি শুরু করেন। এ সময় তারা আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোটে যুক্ত হন। সে সময় জাতীয় সংসদ নির্বাচন উপলক্ষে মহাজোটের পক্ষ থেকে এলডিপিকে ২৮টি আসনও দেওয়া হয়। তবে পরে এ নির্বাচন স্থগিত হয়ে যায়। ওয়ান-ইলেভেনকালে জরুরি অবস্থায় ভাঙন দেখা দেয় এলডিপিতে। দুই শীর্ষ নেতার মতপার্থক্যে বি. চৌধুরী এলডিপি থেকে বেরিয়ে এসে আবারও বিকল্পধারাকে সক্রিয় করেন।
একাদশ সংসদ নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু করতে ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়া ও বি. চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন যুক্তফ্রন্ট বৃহত্তর জাতীয় ঐক্য গড়ার চেষ্টা করে। তবে বিকল্পধারার নানা শর্তের বেড়াজালে তা আর সম্ভব হয়ে ওঠেনি। বিকল্পধারাকে বাইরে রেখে বিএনপি, গণফোরাম, জেএসডি, নাগরিক ঐক্য এবং জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়াকে নিয়ে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠিত হয়। এর ফলে রাজনীতিতে কোণঠাসা হয়ে পড়ে বি. চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন বিকল্পধারা বাংলাদেশ।
এর আগে ২০০৮ সালের নির্বাচনে বিকল্পধারা এককভাবে অংশ নিয়ে কোনো আসনে জয়ী হতে পারেনি। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন বিএনপির মতো এ দলটিও বর্জন করেছিল। তবে ২০১৮ সালের নির্বাচনে অনেক নাটকীয়তার পর আওয়ামী লীগের সমর্থনে নৌকা প্রতীকে দুটি আসনে বিকল্পধারার দুই প্রার্থী জয়ী হন। সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন মেজর (অব.) আবদুল মান্নান এবং মাহী বি. চৌধুরী।
কোন্দল ও ভাঙন :একাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের রাজনীতিকে কেন্দ্র করে গত ১৮ অক্টোবর ভাঙনের মুখে পড়ে বিকল্পধারা বাংলাদেশ। দলের কেন্দ্রীয় সিনিয়র প্রেসিডিয়াম সদস্য ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক অধ্যাপক নুরুল আমিন বেপারীকে প্রেসিডেন্ট এবং দলের সাবেক সহসভাপতি অ্যাডভোকেট শাহ্ আহম্মেদ বাদলকে মহাসচিব করে বিকল্পধারার নতুন কমিটি গঠন করা হয়। এ সময়ে তাদের সঙ্গে অনেক নেতাকর্মীও দলত্যাগ করেন।
অন্যদিকে বি. চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন যুক্তফ্রন্ট থেকে বেরিয়ে গিয়ে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টে যুক্ত হয় জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জেএসডি ও নাগরিক ঐক্য। একই সময় বিএনপি থেকে পদত্যাগকারী সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান শমসের মবিন চৌধুরী এ দলে যোগ দিয়ে চমক সৃষ্টি করেন। তাকে দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য করা হয়। এর বাইরে ২০ দলীয় জোটের শরিক বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (বাংলাদেশ ন্যাপ) আর লেবার পার্টির খণ্ডিত অংশসহ আরও ৯টি ছোট দল নিয়ে নতুনভাবে যুক্তফ্রন্ট গঠন হয়। তবে এটির অস্তিত্বও এখন বিলীনের পথে।
জোট ও সংগঠনের দুর্বলতা :দলকে শক্তিশালী সাংগঠনিক ভিত্তির ওপর দাঁড় করাতে তেমন কোনো তৎপরতাই নেই বিকল্পধারার হাইকমান্ডের। সারাদেশে প্রায় ৭০টি সাংগঠনিক ইউনিট থাকলেও শুধু ঢাকা মহানগর বাদে অন্য কোনো কমিটির অস্তিত্ব নেই। দলের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, ২০টির মতো জেলা কমিটি রয়েছে। তবে বাস্তবে তা খুঁজে পাওয়া যায়নি। সর্বশেষ জাতীয় নির্বাচনের পর দলের কর্মসূচিতেও নেতাকর্মীদের উপস্থিতি একেবারে নেই বললেই চলে। নির্বাচনের আগে বিকল্পধারায় যোগ দেওয়া নেতাদের মধ্যে শমসের মবিন চৌধুরীকে মাঝেমধ্যে দেখা গেলেও সাবেক এমপি এমএম শাহীন, এইচএম গোলাম রেজাসহ অন্যদের দেখা মেলা ভার। ঢাকঢোল পিটিয়ে যুক্তফ্রন্ট গঠন করা হলেও এখন তার অস্তিত্ব নেই বললেই চলে।
এ সম্পর্কে জোটের শরিকরা জানান, যুক্তফ্রন্টের নির্বাচন-পরবর্তী বৈঠকে বি. চৌধুরীকে বলা হয়েছিল, যুক্তফ্রন্টের রাজনীতির কৌশল নির্ধারণ করতে হবে। কারণ শরিক নেতারা মনে করছেন, সরকারের পক্ষাবলম্বন করার জন্য তাদের পৃথক রাজনৈতিক মঞ্চ তৈরি হয়নি। কিন্তু বিকল্পধারা থেকে এসব বিষয়ে কিছু পরিস্কার করা হয়নি। এ কারণে যুক্তফ্রন্টের আর কোনো বৈঠকও হয়নি। বরং বাজেট সম্পর্কে শরিক নেতারা নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া দিলেও বিকল্পধারা থেকে সাধুবাদ জানানো হয়। এ সব বিষয় নিয়ে টানাপড়েন চলছে জোটটিতে।
আবার বিকল্পধারা থেকে দুর্নীতির বিরুদ্ধে স্লোগান দেওয়া হলেও দলটির মহাসচিব মেজর (অব.) আবদুল মান্নান এবং মাহী বি. চৌধুরী ও তার স্ত্রী লোপা চৌধুরীকে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) থেকে নোটিশ করা হয়েছে। এ নিয়ে হতাশ ও ক্ষুব্ধ শরিক নেতারা। তারা বলছেন, আওয়ামী লীগ-বিএনপির সঙ্গে বিকল্পধারারও কার্যত কোনো পার্থক্য নেই।
বিকল্পধারা বাংলাদেশ (একাংশ) :সর্বশেষ জাতীয় নির্বাচনের আগে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠন প্রক্রিয়ায় বিকল্পধারা বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ কোন্দলে দলের একটি অংশ বেরিয়ে গঠন করে পৃথক বিকল্পধারা। এ অংশের সভাপতি অধ্যাপক নুরুল আমিন বেপারী এবং মহাসচিব অ্যাডভোকেট শাহ্ আহম্মেদ বাদল। এ অংশটি ঐক্যফ্রন্টের শরিক।
এ প্রসঙ্গে নুরুল আমিন বেপারী জানান, দলের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্য তাদের সঙ্গে আছেন। তাদের মতামতের ভিত্তিতেই নতুন কমিটি গঠন করা হয়েছে। এখন তারা সারাদেশে কমিটি গঠনের কাজ করছেন।
শাহ্ আহম্মেদ বাদল বলেন, আগামী ডিসেম্বর তারা কেন্দ্রীয় কাউন্সিল করার পরিকল্পনা নিয়েছেন। এর মধ্যেই তারা তাদের কৃষক ধারা, ছাত্রধারা, মাইনোরিটি ধারাসহ অন্যান্য সংগঠন গুছিয়ে আনার কাজ প্রায় শেষ করে এনেছেন।