সাহাদাত হোসেন পরশ; ক্যাসিনো ঘিরে অবৈধ বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে অভিযান শুরুর পর সর্বত্র আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। যুবলীগের বহিস্কৃত নেতা খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া ও জি কে শামীম গ্রেফতারের পর বেরিয়ে আসছে অনেকের নাম। যার মধ্যে বেশ কয়েকজন রাঘববোয়ালও আছেন। ক্যাসিনো কারবার ছাড়াও মোটা কমিশন দিয়ে যাদের মাধ্যমে বড় কাজ বাগিয়ে নেওয়া হয়েছে, সেসব সরকারি কর্মকর্তার নাম ফাঁস হচ্ছে। বিষয়টি টের পেয়ে অনেকের চোখে এখন ঘুম নেই।
এমন প্রেক্ষাপটে ক্যাসিনো ছাড়াও অনিয়ম-দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত যাদের নাম বেরিয়ে এসেছে, তাদের গ্রেফতারে অভিযান অব্যাহত রাখবে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এ পরিস্থিতিতে যুবলীগের একাধিক নেতা বিদেশ থেকে দেশে ফিরছেন না। আবার কেউ কেউ দেশ ছাড়ার চেষ্টা করছেন। এমন কয়েকজনকে গোয়েন্দা নজরদারিতে রাখা হয়েছে। যারা অবৈধভাবে কোটি কোটি টাকার মালিক হয়েছেন তারা নগদ অর্থ নিয়ে রয়েছেন বিপাকে।
মঙ্গলবার সূত্রাপুরে অভিযান চালিয়ে দুই আওয়ামী লীগ নেতার বাসার ভল্টে কোটি কোটি টাকা ও স্বর্ণালঙ্কার পাওয়ার পর দুর্নীতিবাজদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে গ্রেফতার আতঙ্ক। রাজধানী ঘিরে ক্যাসিনোসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে সংঘবদ্ধ চাঁদাবাজ ও নিয়ন্ত্রণকারী গ্রুপ তৈরি হয়েছিল, তা এবারের অভিযানের পর স্পষ্ট হয়েছে। এসব জায়গা থেকে অনৈতিক সুবিধা নিত অনেকেই।
এদিকে, চাঁদাবাজিসহ আর্থিক দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) দুই সদস্যকে গতকাল স্ট্যান্ডরিলিজ করা হয়েছে। তারা হলেন- ডিবির পরিদর্শক কামরুল ইসলাম ও এএসআই নাসিম।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ডিএমপি কমিশনার শফিকুল ইসলাম সমকালকে বলেন, আর্থিক দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে ডিবির দুই সদস্যকে স্ট্যান্ডরিলিজ করা হয়েছে।
ডিবির দুই সদস্য কামরুল ইসলাম ও নাসিমের বিরুদ্ধে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে চাঁদা তোলার অভিযোগ রয়েছে। ক্যাসিনো থেকেও তারা চাঁদা তুলতেন। এই দুই সদস্যের বিরুদ্ধে এর আগেও
গুরুতর অপেশাদার কাজে সম্পৃক্ত থাকার অভিযোগ উঠেছিল। তাদের গাড়ি-ফ্ল্যাটসহ অনেক সম্পদের ব্যাপারেও রয়েছে গুঞ্জন।
যুবলীগ নেতা খালেদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ও মাদক আইনে করা মামলার তদন্তভার গতকাল বুধবার র্যাবের কাছে ন্যস্ত হয়েছে। জি কে শামীমের বিরুদ্ধে মামলার তদন্তভার র্যাবের কাছে যাচ্ছে।
এ ব্যাপারে র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক লে. কর্নেল সারওয়ার-বিন-কাশেম সমকালকে বলেন, খালেদের দুটি মামলা র্যাবে এসেছে। জি কে শামীমের মামলার তদন্তভার র্যাবের কাছে ন্যস্ত হওয়ার বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন। বিদেশি যেসব জুয়াড়ি পালিয়ে গেছে, তাদের ধরার চেষ্টাও অব্যাহত রয়েছে।
জানা গেছে, মতিঝিলের আলোচিত ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মমিনুল হক সাঈদসহ কয়েকজন দেশের বাইরে অবস্থান করছেন। ক্যাসিনোবিরোধী অভিযান শুরুর কারণে তারা দেশে ফিরছেন না। মমিনুল ওয়ান্ডারার্সসহ অন্তত চারটি ক্লাবের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত। তিনি দক্ষিণ যুবলীগের সভাপতি ইসমাইল হোসেন সম্রাটের আস্থাভাজন হিসেবে পরিচিত। তিনি বিদেশেও ক্যাসিনো চালাচ্ছেন।
সম্রাট ও খালেদ ছাড়া অন্য যাদের ব্যাপারে খোঁজ নেওয়া হচ্ছে তারা হলেন- কাউন্সিলর আনিসুর রহমান, যুবলীগ নেতা মেহরাব হোসেন স্বপন, গাজী সারওয়ার হোসেন বাবু, খায়রুল, উজ্জল, জামান, মুরসালিন, মনির হোসেন, রানা, শাহাদাত হোসেন, ৯ নম্বর ওয়ার্ড যুবলীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি হাসান উদ্দিন জামাল, ইমরান, তসলিম, জসীম উদ্দিন ও এটিএম গোলাম কিবরিয়া। তাদের বিরুদ্ধে রাজধানীর বিভিন্ন ক্লাবে ক্যাসিনো নিয়ন্ত্রণ করে চাঁদা তোলার অভিযোগ রয়েছে।
ক্যাসিনোর সঙ্গে জড়িত যুবলীগ উত্তরের সহসভাপতি এনামুল হক আরমানও রয়েছেন আতঙ্কে। এক সময় গুলিস্তানের হকার ছিলেন তিনি। ক্যাসিনোসহ চাঁদাবাজির টাকায় অল্প সময়ে কোটি কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। দামি হ্যারিয়ার ব্র্যান্ডের গাড়িতে চলাফেরা করেন তিনি। কোন ক্যাসিনোতে চাঁদার পরিমাণ কত হবে, তা এক প্রভাবশালী নেতার সঙ্গে আলোচনা করে ঠিক করে দিতেন আরমান। আরমানের গ্রামের বাড়ি নোয়াখালী। গুলিস্তানে হকারি ছাড়াও এক সময় তিনি লাগেজ ব্যবসা করতেন। বিএনপি আমলেই তিনি মতিঝিলপাড়ায় জুয়ার আসর বসাতেন। ওই সময় যুবলীগ নেতা সম্রাটের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতা হয়। মূলত আরমানের হাত ধরেই ক্যাসিনোতে পা বাড়ান সম্রাট। এলিফ্যান্ট রোডের অ্যাজাক্স ক্লাব নিয়ন্ত্রণ হতো যুবলীগ নেতা আরমান, তছলিম ও খোরশেদের নেতৃত্বে।
যুবলীগের আরেক সমালোচিত নেতা আনিসুর রহমানকেও খোঁজা হচ্ছে। ২০০১ সালে ঢাকায় এসে গার্মেন্টে চাকরি নিয়েছিলেন তিনি। ২০০৫ সালে পিয়নের চাকরি নেন যুবলীগের কার্যালয়ে। এরপর যেন আলাদিনের চেরাগ পান তিনি। অল্প সময়েই কোটি কোটি টাকার মালিক হন।
যুবলীগ দক্ষিণের বহিস্কৃত সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মগবাজার টিঅ্যান্ডটি কলোনির টপটেরর নাজির আরমান নাদিম ও শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসানের ঘনিষ্ঠ ছিলেন। চাঁদাবাজি ও ক্যাসিনো থেকে কামানো অর্থ ওমানে থাকা নাদিম ও জার্মানিতে অবস্থানরত জিসানের কাছে পাঠাতেন তিনি। বিদেশে থাকা শীর্ষ সন্ত্রাসীরা তার হয়ে টেন্ডার নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখত। যুবলীগ দক্ষিণের সভাপতি ইসমাইল চৌধুরী সম্রাটের ছত্রছায়ায় ঢাকার এক অংশের নিয়ন্ত্রণ আসে খালেদের হাতে।
যুবলীগের একাধিক নেতার ভাষ্য, ওয়ার্ড কাউন্সিলর মমিনুল ও আরমানের মাধ্যমে অন্ধকার জগতে পা বাড়িয়েছিলেন সম্রাট। তাদের কারণে অধিকাংশ সময় সম্রাটকে সমালোচনার মুখোমুখি হতে হয়েছে। সম্রাট এখন কোথায়- এ তথ্য জানতে চাইলে তারা বলেন, সম্রাট রাজধানীর একটি হাসপাতালে তার অসুস্থ মাকে দেখভাল করছেন। আপাতত তিনি গণমাধ্যমের মুখোমুখি হতে চান না। কারণ সম্রাটের একাধিক ‘বড় ভাই’ তাকে নির্দেশনা দিয়েছেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে মিডিয়ার সঙ্গে কোনো কথা না বলতে। সম্রাটের দেশত্যাগ-সংক্রান্ত নিষেধাজ্ঞা বিমানবন্দর ও স্থলবন্দরে পৌঁছার পর অনেক শ্রমিক লীগ নেতার মধ্যে আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। অনেকে ভয়ে বৈধ পথে বিদেশ যাওয়া থেকে বিরত আছেন।
ক্যাসিনোসহ অবৈধ কারবারে জড়িত থাকার অভিযোগ উঠেছে যুবলীগ দক্ষিণের একাধিক নেতার বিরুদ্ধেও। তবে গোয়েন্দারা বলছেন, উত্তর যুবলীগের কয়েকজন নেতাও ক্যাসিনোর সঙ্গে জড়িত। গুলশানের যুবলীগ নেতা মো. আলমের বিরুদ্ধে ক্যাসিনোর সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকার অভিযোগ রয়েছে। উত্তর যুবলীগ নেতা মো. ইসমাইল, মামুন সরকার, শ্রমিক লীগ নেতা কাজী জাকারিয়ার বিরুদ্ধে ক্যাসিনোর সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে। উত্তরা ১ নম্বরের সেক্টরের পূবালী ব্যাংক, কামাল আতাতুর্ক এভিনিউর আহমেদ টাওয়ার, হোটেল স্যারিনা, সুইট ড্রিমস, উত্তরার অ্যাপেক্স, ৯ নম্বর সেক্টরের আকাশ প্লাজাসহ বেশ কিছু জায়গায় তারা ক্যাসিনো ও জুয়ার আসর বসাত।
দায়িত্বশীল সূত্র বলছে, খালেদ ও জি কে শামীমের কাছ থেকে যারা কমিশন নিত তাদের ব্যাপারে ব্যাপারে তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। তাদের আয়-ব্যয়ের উৎস খতিয়ে দেখা হবে। এ ছাড়া মানি লল্ডারিং আইনে করা মামলার তদন্ত এগিয়ে নেওয়া হচ্ছে।