দেলওয়ার হোসেন;
ডিসি-ইউএনওসহ মাঠ প্রশাসনের প্রত্যেক কর্মকর্তার কার্যক্রম নিবিড়ভাবে মনিটর করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। এজন্য বিভিন্ন সংস্থা থেকে প্রাপ্ত গোয়েন্দা প্রতিবেদনের তথ্য সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হবে। সম্প্রতি মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের জেলা ও মাঠ প্রশাসন অনুবিভাগের কর্মমূল্যায়ন ও অফিস ব্যবস্থাপনা-সংক্রান্ত সমন্বয় সভায় এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এ ছাড়া মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তাদের দৈনন্দিন কর্মমূল্যায়নের জন্য পৃথক পৃথক কমিটিও গঠন করা হয়েছে। সভার কার্যবিবরণী থেকে এই তথ্য জানা গেছে।
৩ সেপ্টেম্বরের ওই বৈঠকে মাঠ প্রশাসন-সংক্রান্ত বিভিন্ন সংস্থা থেকে পাওয়া গোয়েন্দা প্রতিবেদন পর্যালোচনার ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়। গোয়েন্দা প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে যথাসময়ে উপস্থাপন করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের অফিসে উপস্থিত থাকার বিষয়ে তদারকি নিশ্চিত করা, জেলা ও মাঠ প্রশাসন অনুবিভাগের প্রত্যেক কর্মকর্তাকে প্রতি তিন মাসে একটি করে বছরে নূ্যনতম চারটি জেলা ও উপজেলা পরিদর্শন করতে হবে।
সম্প্রতি জামালপুরের বিদায়ী জেলা প্রশাসক (ডিসি) আহমেদ কবীরের বিরুদ্ধে নারী কেলেঙ্কারির দুটি ভিডিও ভাইরাল হয়। ডিসির অনৈতিক সম্পর্কের ভিডিও ভাইরাল হওয়ায় পুরো প্রশাসনকে বিব্রতকর পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দেয়। যদিও বিষয়টি এখনও তদন্তাধীন, তবে ঘটনাটি প্রশাসনযন্ত্রকে বড় ধরনের ধাক্কা দিয়েছে। এ জন্য মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ ডিসি, ইউএনও, এসিল্যান্ডসহ মাঠ প্রশাসনের সার্বিক কর্মকাণ্ড শতভাগ কঠোর নজরদারির মধ্যে আনতে চায়। এজন্য কর্মকর্তাদের বিভিন্ন স্তরে মনিটরিংয়ের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (জেলা ও মাঠ প্রশাসন অনুবিভাগ) আ. গাফ্ফার খান সমকালকে বলেন, ডিসি-ইউএনওসহ মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তাদের বিভিন্ন গ্রুপে তদারকি করা হচ্ছে। প্রতিনিয়ত নজরদারি করার জন্য মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের কর্মকর্তাদের ধাপে ধাপে বিভাজন করে দেওয়া হচ্ছে। এতে ভালো ফিডব্যাকও পাওয়া যাচ্ছে। অনেক পরিবর্তন এসেছে। কর্মকর্তাদের উপস্থিতিও বেড়েছে। গোয়েন্দা প্রতিবেদনের বিষয়ে তিনি বলেন, তাদের প্রতিবেদন অবশ্যই গুরুত্ব দেওয়া হবে। কারণ, কোনো কাজই ফেলে দেওয়ার নয়। গণমাধ্যমে কোনো জেলার বিষয়ে জনগুরুত্বপূর্ণ সংবাদ প্রকাশ হলে তাৎক্ষণিকভাবে তা মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে ডিসির কাছে তার সরকারি মোবাইল ফোনে পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে বলেও জানান তিনি।
জানা যায়, বিদ্যমান নির্দেশনা অনুযায়ী ডিসিসহ মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তারা সকাল ৯টা থেকে ৯টা ৪০ মিনিট পর্যন্ত অফিসে অবস্থান করছেন কি-না সেটিও প্রতিদিন মনিটরিং হচ্ছে। এক্ষেত্রে ল্যান্ডফোনের মাধ্যমে বিভিন্ন দপ্তরে যোগাযোগ করা হয়। ডিসি বা ইউএনও ওই সময় বিশেষ জরুরি কোনো কাজে অন্য কোথাও থাকলে সেটিও যাচাই করে দেখা হচ্ছে।
গোয়েন্দা প্রতিবেদনের বিষয়ে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান সমকালকে বলেন, এ ধরনের সিদ্ধান্তে কোনো কোনো ক্ষেত্রে যৌক্তিকতা থাকতে পারে। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ঝুঁকি রয়েছে। কারণ, গোয়েন্দা প্রতিবেদনের ফলে পেশাগত দক্ষতা, নিরপেক্ষতা ও উৎকর্ষ বিকাশের মধ্যে প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়। অনেক ক্ষেত্রে দলীয়ভাবে হয়রানি হওয়ার সুযোগ থাকে। তবে কোনো কর্মকর্তা রাষ্ট্রীয় শাসনের পরিপন্থি কোনো কাজে জড়িত কি-না এজন্য প্রয়োজন হতে পারে।
রংপুরের জেলা প্রশাসক মো. আসিব আহসান সমকালকে বলেন, ডিসিদের কর্মমূল্যায়নের জন্য বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তি (এপিএ) ও গোপনীয় প্রতিবেদনসহ (এসিআর) বিভিন্ন মাধ্যম রয়েছে। সরকার এসবের মাধ্যমে ডিসিদের কর্মমূল্যায়ন করে থাকে। এ ছাড়া সম্প্রতি দৈনন্দিন কার্যক্রম তদারকি করছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। বরগুনার ডিসি মোস্তাইন বিল্লাহ সমকালকে বলেন, সরকারের সাম্প্রতিক নির্দেশনা অনুযায়ী মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে জেলা প্রশাসকদের তদারকি করা হচ্ছে। আর জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে ইউএনওদের তদারকি করা হচ্ছে। এভাবে প্রত্যেক দপ্তরপ্রধান অধস্তনদের তদারকি করছেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক ডিসি সমকালকে বলেছেন, গোয়েন্দা প্রতিবেদনের মাধ্যমে জনপ্রশাসনের কর্মকর্তারা সঠিকভাবে মূল্যায়িত হন না। এক্ষেত্রে সরকারের বিভিন্ন সংস্থার (গোয়েন্দা) প্রতিবেদনে বেশি গুরুত্ব না দিয়ে প্রশাসনের গোপনীয় প্রতিবেদনের (এসিআর) প্রতি সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন তারা। এর আগে ২০১৮ সালের জেলা প্রশাসক সম্মেলনে ডিসিরা গোয়েন্দা প্রতিবেদন মুক্ত পদোন্নতির প্রস্তাব দিয়েছিলেন।
তবে গোয়েন্দা প্রতিবেদন অপপ্রয়োগের মাধ্যমে প্রশাসনের কর্মকর্তাদের হয়রানি করার বহু অভিযোগ রয়েছে। সাবেক জনপ্রশাসনমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম নিজেও বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন। কারণ, এমন প্রতিবেদনের ভিত্তিতেই কর্মকর্তাদের ওপর দলবাজির তকমা পড়ে। সাবেক জনপ্রশাসনমন্ত্রী এসব অনিয়ম থেকে বের হয়ে এসে একটি স্বচ্ছ প্রশাসন গড়ে তোলার নির্দেশ দেন। কিন্তু সেই নির্দেশনা বাস্তবায়ন হয়নি আজও। বরং জনপ্রশাসনের কর্মকর্তাদের কর্মমূল্যায়নে অন্যান্য মাপকাঠির সঙ্গে এর চর্চা আরও বেড়েছে।