শ-জাপানিসহ সেলিম প্রধানের তিন স্ত্রী, রাতে ফ্ল্যাটে বসতো সুন্দরীদের হাট

 

নিজস্ব প্রতিবেদক;

দেশে আরেক মাফিয়ার সন্ধান পেয়েছে র‌্যাব। সেলিম প্রধান নামের ওই মাফিয়া বছরের বেশির ভাগ সময় বিদেশে অবস্থান করতেন। দেশে এলেও বিন্দুমাত্র ছন্দপতন ঘটত না তার লাইফস্টাইলের। প্রতি রাতেই সুন্দরী রমণীদের হাট বসত রাজধানীর অভিজাত এলাকায় তার বিভিন্ন ফ্ল্যাটে। প্রভাবশালী অনেকের নিয়মিত যাতায়াত ছিল সেখানে। এমপি না হলেও সেলিমের গাড়িতে ছিল ‘সংসদ সদস্য’ ছাপানো স্টিকার। গাড়িবহরের সামনে-পেছনে থাকত সশস্ত্র পাহারাদার। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা তার বহরে তল্লাশির সাহস পেতেন না। গত সোমবার হযরত শাহজালাল (রহ.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের রানওয়েতে থাকা একটি ফ্লাইট থেকে সেলিমকে আটকের পর গুলশান-২ নম্বরে তার বাসা এবং বনানীর একটি অফিসে দীর্ঘ ১৮ ঘণ্টা অভিযান চালায় র‌্যাব। উদ্ধার করে প্রায় পৌনে ১ কোটি টাকা সমমূল্যের বিদেশি মুদ্রা, বাংলাদেশি মুদ্রায় ২৯ লাখ টাকা, দুটি হরিণের চামড়া ও বিপুল পরিমাণ মদের বোতল। আটক করে সেলিমের অন্যতম সহযোগী মো. আক্তারুজ্জামান ও মো. রোমান নামে আরও দুজনকে। র‌্যাব বলছে, সেলিম অনলাইন ক্যাসিনোর মাধ্যমে অর্জিত অর্থ নিয়মিত পাচার করতেন বিদেশে। একটি অংশ যেত লন্ডনের একটি ঠিকানায়।

র‌্যাব বলছে, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদেই সেলিম অনেক চাঞ্চল্যকর তথ্য দিয়েছেন। তবে এগুলোর যাচাই-বাছাইয়ের জন্য আরও সময় প্রয়োজন। জানা গেছে, সেলিম প্রধান ‘প্রধান গ্রুপ’ নামে একটি ব্যবসায়ী গ্রুপের চেয়ারম্যান। এই গ্রুপের ‘পি-২৪ গেইমিং’ নামের একটি কোম্পানি আছে, যাদের ওয়েবসাইটেই ক্যাসিনো ও অনলাইন ক্যাসিনো ব্যবসার তথ্য রয়েছে। প্রধান গ্রুপের কোম্পানি জাপান বাংলাদেশ সিকিউরিটি প্রিন্টিং অ্যান্ড পেপারসের নাম রয়েছে ঢাকা চেম্বারের সদস্যদের তালিকায়। থাইল্যান্ডের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে ক্যাসিনো, শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ড, বেশ কয়েকটি স্পা ও বিউটি স্যালুন। থাই এয়ারওয়েজের একটি ফ্লাইট থেকে সেলিমকে গত সোমবার দুপুরে নামিয়ে আনে র‌্যাব-১-এর অধিনায়ক লে. কর্নেল সারোয়ার বিন কাশেমের নেতৃত্বাধীন একটি দল। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের পর রাতে তাকে নিয়ে গুলশান-২ এর ৯৯ নম্বর সড়কের ১১ নম্বরের মমতাজ ভিশনে অভিযানে যায় র‌্যাব। ওই বাসার তৃতীয়তলায় সেলিম তার তৃতীয় স্ত্রীকে নিয়ে বাস করেন। চতুর্থ তলায় প্রধান গ্রুপের কার্যালয়। চতুর্থ তলায় ঢুকেই চোখ কপালে উঠে র‌্যাব সদস্যদের। জব্দ করা হয় অনেক গুরুত্বপূর্ণ নথিপত্র। সেলিমের তথ্য অনুযায়ী, বনানী ২ নম্বর সড়কের ২২ নম্বর বাসায় অভিযান চালিয়ে আক্তারুজ্জামান নামের এক ব্যক্তিকে আরও গুরুত্বপূর্ণ নথিসহ আটক করা হয়। ওই বাসা থেকে জব্দ করা হয় প্রায় ২১ লাখ টাকা। র‌্যাব সূত্র জানায়, অনলাইনে বিশ্বের সুপরিচিত ক্যাসিনোগুলোর সঙ্গে জুয়াড়িদের যুক্ত করার কাজ করতেন সেলিম। তিনি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান ‘প্রধান গ্রুপ’-এর কর্ণধার। দেশে তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে জাপান-বাংলাদেশ সিকিউরিটি প্রিন্টিং অ্যান্ড পেপারস লিমিটেড, পি২৪ ল ফার্ম, এ ইউ এন্টারটেইনমেন্ট, পি২৪ গেমিং, প্রধান হাউস ও প্রধান ম্যাগাজিন। এর মধ্যে পি২৪ গেমিংয়ের মাধ্যমে তিনি জুয়াড়িদের ক্যাসিনোয় যুক্ত করতেন।
সেলিমের কোম্পানির ওয়েবসাইটের তথ্য অনুযায়ী, পি২৪ গেমিং শুরুতে বিনোদনমূলক সফটওয়্যার তৈরি ও প্রকাশ করত। এখন তারা এশিয়ায় দ্রুত বড় হতে থাকা ক্যাসিনো কারবারে সক্রিয় ভূমিকা রাখছে। এশিয়ার লাইভ ক্যাসিনো মার্কেটে প্রতিষ্ঠানটি যেন এক নম্বরে যেতে পারে, সেই চেষ্টা আছে তাদের। ২০১৬ সালে তারা শুধু কম্পিউটার গেমস বাজারে আনত। পরে অনলাইন জুয়া ও ক্যাসিনো কারবারে জড়িয়ে পড়ে। পি২৪-এর সঙ্গে বাংলাদেশে ১৫০টি অপারেটর এবং ক্যাসিনো যুক্ত আছে। অনলাইনে বিশ্বের সবচেয়ে প্রচলিত ক্যাসিনোর সঙ্গে যুক্ত করে দেওয়ার ক্ষমতা আছে তাদের। জুয়াড়িদের মুঠোফোনে লাইভ ক্যাসিনোতে যুক্ত করে দেওয়ার সুবিধা তারা এনেছেন গত বছরের ৭ ডিসেম্বর। জানা গেছে, জাপানে থাকাকালে সেলিম বিয়ে করেন প্রভাবশালী জাপানি পরিবারের মেয়েকে। ওই সংসারে তার ২১ বছর বয়সী এক মেয়ে রয়েছে। দেশে এসে বিয়ে করেন ঢাকার চকবাজারের এক তরুণীকে। এই সংসারে তার কোনো সন্তান না হলেও সেলিম তৃতীয় বিয়ে করেন এক রাশিয়ান তরুণীকে। তার রাশিয়ান স্ত্রী এখন সন্তানসম্ভবা। স্ত্রীরা দেশে এলে তার গুলশানের ফ্ল্যাটেই অবস্থান করতেন। এ নিয়ে কোনো প্রতিবাদ করতে সাহস পেতেন না সেলিমের দ্বিতীয় স্ত্রী। জানা গেছে, সেলিম প্রধানের সঙ্গে আর্থিক খাতের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। সেলিম প্রধানের জাপান-বাংলাদেশ সিকিউরিটি প্রিন্টিং অ্যান্ড পেপারসে বিভিন্ন ব্যাংকের চেক বই ছাপা হয়। পাশাপাশি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের অফিসের নথিপত্রও ছাপানো হয়। তার এই প্রতিষ্ঠান রূপালী ব্যাংকের শীর্ষ ঋণখেলাপিদের একটি। ২০১৮ সালে ঋণটি পুনঃতফসিল করা হয়। সেলিমের কাছে ব্যাংকের পাওনা প্রায় ১০০ কোটি টাকা। র‌্যাব-১ এর অধিনায়ক লে. কর্নেল সারোয়ার বিন কাশেম বলেন, সেলিম প্রধান উত্তর কোরিয়ার নাগরিক মি. ইয়াংসিক লির সঙ্গে যৌথভাবে বাংলাদেশে অনলাইন ক্যাসিনো খুলে বিপুল পরিমাণ অর্থ হাতিয়ে নিয়েছেন। আমরা এরই মধ্যে একটি গেটওয়েতে গত এক মাসে ৯ কোটি টাকা উত্তোলনের প্রমাণ পেয়েছি। তবে এই সিন্ডিকেটের আরও কোনো গেটওয়ে আছে কি না তা নিয়ে আমরা কাজ করছি। অনলাইন ক্যাসিনোর বিবরণ দিয়ে তিনি বলেন, এটা ভার্চুয়াল ক্যাসিনো। অনলাইনে টাকা দিয়ে এগুলো খেলতে হয়। নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা জমা রেখে মোবাইলে সফটওয়্যার ইনস্টল করার পর (পি-২৪) ভিসা, মাস্টার কার্ড, বিকাশে রাখা অর্থ দিয়ে অ্যাকাউন্ট খুলতে হবে। এটিতে অ্যাকাউন্ট খুলতে হয়। কেউ টাকা জিতলে নির্দিষ্ট অ্যাকাউন্টে টাকা আসবে। হারলে টাকাগুলো একটি গেটওয়ের মাধ্যমে তিনটি ব্যাংকের অ্যাকাউন্টে যেত। সপ্তাহে একদিন সব টাকা এক ব্যাংকে দেওয়া হতো। সারোয়ার বলেন, আক্তারুজ্জামান তার গেমিং সাইটটি চালাত এবং টাকা সংগ্রহ করে অন্য ব্যাংকে জমা করত। এরপর কোরীয় নাগরিক এসে এই টাকাগুলো নিয়ে যেত। এটি সরাসরি মানি লন্ডারিং আইনের লঙ্ঘন। তাই তাকে চারটি অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়েছে। প্রথমত মানি লন্ডারিং, মাদকদ্রব্য, ফরেন কারেন্সি অ্যাক্ট এবং বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইনের লঙ্ঘন। গুলশানে সেলিমের বাড়ি ও অফিসে অভিযানের বিষয়ে র‌্যাব অধিনায়ক বলেন, সেলিম বর্তমানে কারাগারে থাকা ব্যবসায়ী গিয়াসউদ্দিন আল মামুনের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। তিনি মামুনকে একটি বিএমডব্লিউ গাড়িও উপহার দিয়েছিলেন বলে জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছেন। এ ছাড়া সেলিম বিভিন্ন সময় লন্ডনে টাকা পাঠিয়েছেন বলে স্বীকারোক্তি দিয়েছেন। কয়েকটি সুনির্দিষ্ট অভিযোগে আমরা তাকে গ্রেফতার করি। লন্ডনে তিনি কাকে টাকা পাঠাতেন? সাংবাদিকদের এ প্রশ্নের জবাবে র‌্যাবের অধিনায়ক বলেন, ‘লন্ডনে কোথায় পাঠাতেন, সমীক্ষা করে জানাব।’ র‌্যাবের এই কর্মকর্তা বলেন, এক মাস ধরে র‌্যাবের সাইবার মনিটরিং সেলের মাধ্যমে জানতে পারি কিছু অসাধু ব্যবসায়ী অনলাইনে ক্যাসিনো গেমিংয়ে নিজেদের নিয়োজিত রেখেছেন। আমরা জানতে পাই যে, ওই চক্রের প্রধান সমন্বয়ক/দলনেতা/অধিনায়ক সেলিম প্রধান বাংলাদেশ থেকে চলে যাচ্ছেন। তাড়াতাড়ি সিদ্ধান্ত নিয়ে তাকে বিমান থেকে নামিয়ে আনতে সক্ষম হই এবং প্রাথমিকভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করে তার বাসা ও অফিসে অবস্থান নেই। সারারাত পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও বিভিন্ন জিনিসপত্র পেয়েছি।
তিনি বলেন, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে সেলিম র‌্যাবকে জানান, তার জন্ম ১৯৭৩ সালে, ঢাকায়। ১৯৮৮ সালে ভাইয়ের মাধ্যমে জাপানে গিয়ে জাপানিদের সঙ্গে গাড়ির ব্যবসায় নিয়োজিত হন। পরে জাপানিদের সঙ্গে থাইল্যান্ড গিয়ে শিপ ব্রেকিং ব্যবসা করেন। পরে মি. দু নামের এক কোরীয় ব্যক্তি তাকে অনলাইন ক্যাসিনো খোলার উপদেশ দেন। এর ফলে তিনি ২০১৮ সালের পি-২৪ এবং টি-২১ হিসেবে দুটি গেমিং সাইট খোলেন। সেখান থেকে তিনি অনলাইন ক্যাসিনো পরিচালনা করতেন। তার কাগজপত্র যাচাই করে দেখা গেছে, ওই কোরীয় ও সেলিমের ৫০-৫০ অনুপাতে মুনাফা ভাগাভাগির চুক্তি হয়েছিল।

সেলিম প্রধানের সব ব্যাংক হিসাব স্থগিত : এদিকে, সেলিম প্রধানের সব ব্যাংক হিসাবের লেনদেন স্থগিত করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর ফলে তার নিজের ও প্রতিষ্ঠানের হিসাব থেকে আর কোনো টাকা উত্তোলন করা যাবে না। গতকাল বাংলাদেশ ফিন্যানশিয়াল ইনটেলিজেন্স ইউনিট-বিএফআইইউ সব ব্যাংকের কাছে এ নির্দেশনা দিয়ে একটি চিঠি পাঠিয়েছে। চিঠিতে সেলিমের গুলশান-২-এর ১১/এ সড়কের মমতাজ ভিশন, কারওয়ান বাজারের সোনারগাঁও রোডের প্ল্যানার্স টাওয়ার ও নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের ভুলতার প্রধান বাড়ির ঠিকানা দেওয়া হয়েছে।

জাতীয় শীর্ষ সংবাদ