দখল, মাদক, জুয়া, চাঁদাবাজি, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডসহ নানা অভিযোগে ঢাকার দুই সিটির ১৮ কাউন্সিলর ও তাদের সম্পদ গোয়েন্দা নজরদারিতে। তাদের বিরুদ্ধে স্থানীয়ভাবে ওঠা অভিযোগ আমলে নিয়ে সরকার বিস্তারিত তদন্ত শুরু করেছে। তাদের কেউ যেন হঠাৎ দেশত্যাগ করতে না পারেন, সেজন্য সতর্কতার পাশাপাশি নেয়া হয়েছে বিশেষ ব্যবস্থাও।
এদিকে কাউন্সিলরদের অনিয়ম ও দুর্নীতি তদন্তে দুই সিটি মেয়রের কাছে সহযোগিতা চাইবেন দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থার সদস্যরা। দুই মেয়র জানিয়েছেন, শুদ্ধি অভিযানে যে কোনো ধরনের সহযোগিতা করতে প্রস্তুত রয়েছেন তারা। অন্যদিকে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, শুধু ১৮ কাউন্সিলর নন, তারা অন্য কাউন্সিলরদের কার্যক্রম ও গতিবিধিও পর্যবেক্ষণ করছেন।
সূত্র জানায়, নজরদারিতে আছেন ঢাকা উত্তর সিটির (ডিএনসিসি) ৯ এবং দক্ষিণ সিটির (ডিএসসিসি) ৯ কাউন্সিলর। তাদের মধ্যে ডিএসসিসির ৫ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর মো. আশ্রাফুজ্জামান (ফরিদ), ১৩ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর মোস্তফা জামান পপি, ২০ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর ফরিদ উদ্দিন আহমেদ রতন, ২২ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর হাজী তরিকুল ইসলাম সজীব, ২৬ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর হাসিবুর রহমান মানিক, ৩০ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর মো. হাসান, ৩৯ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর ময়নুল হক মঞ্জু এবং ৭৪ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর মো. আবুল কালাম।
এছাড়া ডিএনসিসির কাউন্সিলরদের মধ্যে রয়েছেন- ৪ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও প্যানেল মেয়র মো. জামাল মোস্তফা, ৬ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর মো. রজ্জব হোসেন, ৭ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর মো. মোবাশ্বের হোসেন, ২৭ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর ফরিদুর রহমান খান (ইরান), ২৮ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর ফোরকান হোসেন, ৩০ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর আবুল হাসেম (হাসু), ৩১ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর মো. শফিকুল ইসলাম সেন্টু এবং ৩৩ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর তারেকুজ্জমান রাজিব।
এছাড়া নজরদারিতে থাকাবস্থায় গ্রেফতার হয়েছেন ডিএনসিসির ৩২ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর হাবিবুর রহমান (মিজান)। সম্প্রতি ভারতে পালিয়ে যাওয়ার সময় সিলেট থেকে র্যাবের হাতে গ্রেফতার হয়েছেন তিনি। বর্তমানে জেলহাজতে রয়েছেন।
ডিএসসিসির ৯ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর একেএম মমিনুল হক সাঈদ সিঙ্গাপুর পালিয়ে গেছেন। জবরদখল ও ক্যাসিনো ব্যবসার সঙ্গে জড়িত থাকার ঘটনা ফাঁস হওয়ায় গ্রেফতারের ভরে দেশে ফিরছেন না। এদিকে কাউন্সিলর সভায় অনুপস্থিত থাকা এবং ছুটি ছাড়া দেশের বাইরে যাওয়ার অভিযোগে তার বিরুদ্ধে তদন্ত হয়েছে।
ইতিমধ্যে সে তদন্ত প্রতিবেদন জমা পড়েছে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় (এলজিআরডি) মন্ত্রণালয়ে। শিগগিরই তিনি বরখাস্ত হতে পারেন বলে জানা গেছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, তালিকাভুক্ত কাউন্সিলরদের বেশির ভাগই গা ঢাকা দিয়েছেন। অফিস বা বাসায় তাদের পাওয়া যাচ্ছে না। সেবাগ্রহীতারাও তাদের সাক্ষাৎ পাচ্ছেন না। ওয়ার্ড সচিব বা কাউন্সিলের ঘনিষ্ঠজনদের মাধ্যমে চলছে সেবা কার্যক্রম।
মঙ্গলবার নজরদারিতে থাকা কাউন্সিলরের মধ্যে ৮ জনের মোবাইল ফোন নম্বর বন্ধ পাওয়া যায়। তারা হলেন- ডিএসসিসির ৩, ৩৯ ও ৭৪ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর এবং ডিএনসিসির ৬, ৭, ২৭, ৩১ ও ৩৩ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর।
২ জন ফোন রিসিভ করেননি। তারা হলেন- ডিএসসিসির ৫ এবং ডিএনসিসির ২৮ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর। আর এ তালিকার ১ জন কারাগারে, ছুটি ছাড়া ১ জন বিদেশে পলাতক রয়েছেন। বাকি ৬ জনের সঙ্গে কথা হয়েছে যুগান্তরের। তারা হলেন- ডিএসসিসির ২০, ২২, ২৬, ৩০ এবং ডিএনসিসির ৪ ও ৩০ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর।
ডিএসসিসির ২০ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর ফরিদ উদ্দিন আহমেদ রতন সতর্ক হয়ে চলাচল করলেও ফোন রিসিভ করছেন। এ কাউন্সিলরের বিরুদ্ধে ডিএসসিসির মার্কেটে দখল, চাঁদাবাজিসহ বহুবিধ অভিযোগ রয়েছে। দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা তার কার্যক্রম নিবিড়ভাবে ক্ষতিয়ে দেখছেন।
র্যাবের হাতে আটক হওয়া যুবলীগ নেতা খালেদ, জি কে শামীম ও সম্রাটের সঙ্গে তার সখ্য এবং ব্যবসায়িক সম্পর্ক খতিয়ে দেখা হচ্ছে। এ বিষয়ে ফরিদ উদ্দিন আহমেদ রতন যুগান্তরকে বলেন, ‘ঠিকাদারি ব্যবসা করি। জবরদখল, মাদক, সন্ত্রাস, জুয়ার আসরের সঙ্গে জড়িত নই।’ তিনি আরও বলেন, ‘উদ্দেশ্যমূলকভাবে কেউ আমার ব্যাপারে মিথ্যাচার করছে।’
হাজারীবাগ কোম্পানিঘাট মসজিদ মার্কেট দখল করে ভাড়া-বাণিজ্য, ব্যবসায়ীদের জিম্মি করে মোটা অঙ্কের চাঁদা আদায়, ফুটপাত থেকে চাঁদাবাজি এবং মাদক ব্যবসায়ীদের আশ্রয়প্রশ্রয় দেয়ার অভিযোগ ডিএসসিসির ২২ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর হাজী তারিকুল ইসলাম সজীবের বিরুদ্ধে।
এ অভিযোগ প্রসঙ্গে তিনি যুগান্তরকে বলেন, ‘আমি কোনো অনিয়মের সঙ্গে জড়িত নই। সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন পত্রিকায় আমাদের নাম ছাপা হচ্ছে। সে কারণে গোয়েন্দা বিভাগ থেকে সেসব অভিযোগ খতিয়ে দেখছে বলে শুনেছি।’
ডিএসসিসির ২৬ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর হাসিবুর রহমান মানিকের বিরুদ্ধে অভিযোগ গুরুতর। ডিএসসিসির প্রকল্পের কাজে বাধা দিয়ে ঠিকাদারের কাছ থেকে বড় অঙ্কের অর্থ আদায়, এলাকার দোকান, মার্কেটসহ বিভিন্ন স্থাপনা থেকে চাঁদা আদায় ও মাদক ব্যবসায় সহযোগিতা করাসহ বহুবিধ অভিযোগ আমলে নিয়ে তদন্ত করছেন সংশ্লিষ্টরা।
একই সঙ্গে এই কাউন্সিলরের আশ্রয়প্রশ্রয়দাতাদের ব্যাপারে খোঁজখবর নেয়া হচ্ছে। এ বিষয়ে তিনি যুগান্তরকে বলেন, ‘আমি কোনো অনিয়ম করি না, চাঁদাবাজি করি না। অনেক কষ্ট করে চলি। আমার বিষয়ে মিথ্যাচার করা হচ্ছে।’
ডিএসসিসির ৩০ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর মো. হাসানের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি সোয়ারিঘাট এলাকার লঞ্চঘাট, দোকান, ফুটপাত এবং বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকে চাঁদাবাজি করেন।
অভিযোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘এসব অভিযোগ সঠিক নয়। আমার প্রতিপক্ষরা আমার বিরুদ্ধে মিথ্যাচার করছে।’ ডিএনসিসির ৪ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর জামাল মোস্তফার বিরুদ্ধে মাদক ব্যবসার পৃষ্ঠপোশকতা এবং চাঁদবাজির অভিযোগ রয়েছে। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে তদন্ত করে কেউ কিছুই পাবে না।’
ডিএনসিসির ৩০ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর আবুল হাসেমের (হাসু) বিরুদ্ধে বিস্তর অভিযোগ পেয়েছেন তদন্ত সংশ্লিষ্টরা। এসব অভিযোগের মধ্যে আছে- প্রভাবশালীদের নাম ভাঙিয়ে এলাকায় জনগণকে ভীতি প্রদর্শন, মাদক, জবরদখল ও চাঁদাবাজির পৃষ্ঠপোশকতা করা। অভিযোগ প্রসঙ্গে তিনি জানান, ‘এসব অভিযোগ মিথ্যা। তদন্তে কোনো অভিযোগেরই সত্যতা মিলবে না।’
এ প্রসঙ্গে ডিএসসিসির মেয়র মো. সাঈদ খোকন যুগান্তরকে বলেন, ‘কোনো কাউন্সিলর যদি আইনশৃঙ্খলাবিরোধী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত থাকে, তবে তারা অবশ্যই আইনের আওতায় আসবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘এক্ষেত্রে তদন্ত সংশ্লিষ্ট সরকারি সংস্থাগুলো কোনো ধরনের সহযোগিতা চাইলে অবশ্যই সেটা করা হবে।’
ডিএনসিসির মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, ‘সরকারের শুদ্ধি অভিযান প্রশংসিত হচ্ছে। কাউন্সিলরদের কেউ যদি কোনো অনিয়ম করে থাকে, তারাও আইনের আওতায় আসবে। এক্ষেত্রে সরকারি কোনো সংস্থা সহযোগিতা চাইলে তাদের সব ধরনের সহযোগিতা করা হবে।’