সায়েমা খাতুন;
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি পূর্বনির্ধারিত আলোচনায় যোগ দেওয়ার জন্য জাহাঙ্গীরনগর যাইনি, দুর্নীতির বিরুদ্ধে চলমান আন্দোলন কর্মসূচিতে আজ যোগ দেওয়া হয়নি। আমার শিক্ষক ও সহকর্মী নৃবিজ্ঞান বিভাগের সভাপ্রধান অধ্যাপক সাঈদ ফেরদৌসের ফোন পেলাম যে তাঁদের ওপর ছাত্রলীগের হামলা হচ্ছে। এর কিছুক্ষণের মধ্যেই আরও হামলার খবর পেলাম এবং একের পর এক হামলার আরও ছবি আসতে থাকল। দেখলাম একজন ছাত্রীকে লাথি মারা হয়েছে, যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে মেয়েটি। ছবিতে আরও দেখলাম শান্তিপূর্ণভাবে উপাচার্য ভবন অবরোধকারী শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগের সশস্ত্র সহিংস হামলা, যেখানে তাঁদের সঙ্গে সংঘবদ্ধ হয়ে হামলায় তদারকি করছিলেন উপাচার্যের পক্ষের শিক্ষক বাহিনী। আশ্চর্য হয়ে ভিডিওতে জাহাঙ্গীরনগরে আমার একজন শ্রদ্ধাভাজন বিশিষ্ট বিজ্ঞানীকে দেখালাম এর পুরোভাগে, এক তরুণ শিক্ষক নেত্রীকে দেখলাম আন্দোলনকারীদের উদ্দেশ্যে গলা ফুলিয়ে বারবার চিৎকার করে বলছেন ‘প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন করতে এখানে এসেছি’, ‘ক্লাস নিয়েছি, ক্লাস নিয়েছি’ ইত্যাদি!
নিয়মতান্ত্রিকভাবে অহিংস আন্দোলনকারীদের ওপর শারীরিকভাবে বলপ্রয়োগ করা, সংঘবদ্ধভাবে হামলা করা, ছাত্রলীগের সশস্ত্র ক্যাডার লেলিয়ে দিয়ে ৩৫ জন শিক্ষক-শিক্ষার্থীকে আহত করা তাহলে প্রশাসনিক কাজের আওতায় পড়ে? এই ক্লাস কি শেখানোর ক্লাস? অধ্যাপক আনোয়ারুল্লাহ ভূঁইয়াকে আহত অবস্থায় একটা ছবিতে দেখা যাচ্ছে, সেখানে ছাত্রলীগের এক কর্মীর হাতে আগ্নেয়াস্ত্র, অধ্যাপক সাঈদ ফেরদৌস মাটিতে পড়ে আছেন, অধ্যাপক মীর্জা তাসলিমার পায়ে ব্যান্ডেজ লাগানো হয়েছে, দেখালাম অধ্যাপক রায়হান রাইন আহত। এঁরা সবাই আমাদের একান্ত প্রিয় ও শ্রদ্ধাভাজন সহকর্মী ও পথপ্রদর্শক। এঁদের দৃঢ় মনোবল, সাহস ও প্রজ্ঞা আমাদের শক্তি ও অনুপ্রেরণা। এই ন্যক্কারজনক হামলার প্রতিবাদে জাহাঙ্গীরনগরের শিক্ষক সমিতির বিস্ময়কর নীরবতার জন্য সম্পাদকসহ চারজন পদত্যাগ করেছেন।
উপাচার্য পরিস্থিতি সামাল দিতে না পেরে বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিষ্টকালে জন্য বন্ধ ঘোষণা করেছেন এবং ছাত্রাবাসগুলো ছেড়ে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। কিন্তু শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাস ছাড়তে অস্বীকার করে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। পত্রিকায় দেখলাম, উপাচার্য ফারজানা ইসলাম ছাত্রলীগের কাছে এই হামলা করার জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন এবং বলেছেন তিনি আজ অত্যন্ত খুশি। ছাত্রনামধারী এক পেটোয়া বাহিনীর কাছে একজন উপাচার্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে পারেন, জেনে বিস্মিত হওয়ার ক্ষমতাও হারিয়ে ফেলেছি। এই নির্লজ্জতা যেন দিকশূন্য অন্ধকারের মতো সীমা হারিয়ে ফেলেছে। তিনি কি ভাবছেন এভাবে পেশিশক্তির সাহায্যে কোনো বিশ্ববিদ্যালয় চালিয়ে যাওয়া যায়? এই কি বিশ্ববিদ্যালয় ‘ম্যানেজ’ করার কায়দা? বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাদেশ ভূলুণ্ঠিত করে, সব ধরনের একাডেমিক রীতি-রেওয়াজ লঙ্ঘন করে, শিক্ষা-সৌজন্য-শিষ্টাচারের সব ধরনের নীতি পরিহার করে ইনি বলপ্রয়োগ করে বিশ্ববিদ্যালয়ে পদ আঁকড়ে অবৈধ উপায়ে কেবল টাকাপয়সা, সুযোগ-সুবিধা, ক্ষমতার সুখ ভোগ করতে চান?তিন মাস ধরে ‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে জাহাঙ্গীরনগর’–এর ব্যানারে শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা জাহাঙ্গীরনগরে ১৪৪৫ কোটি টাকার উন্নয়ন মহাপরিকল্পনার স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির জন্য আন্দোলন করে আসছিলেন এবং দুর্নীতিমুক্ত গণতান্ত্রিক উন্নয়নের রূপরেখার আলোচনা নিয়ে আসছিলেন। এর মধ্যে পত্রিকায় ছাত্রলীগের ফোনালাপ ফাঁস থেকে জানা গেল উপাচার্য স্বয়ং কোটি টাকার অবৈধ অর্থ নিজের গাড়ি করে ছাত্রলীগের নেতাদের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন। ছাত্রলীগ নেতারা নিজেরা এই অর্থের প্রাপ্তি স্বীকার করেছেন এবং তদন্তের জন্য নিজেরাই পরামর্শ দিয়েছেন যে তাঁদের ওই তারিখের কললিস্ট দেখলেই ভিসির স্বামী ও পুত্রের সঙ্গে তাঁদের কথোপকথনের প্রমাণ পাওয়া যাবে। অদ্যাবধি এই ছোট্ট সহজ তদন্তটি কেন করা হলো না, কেউই বুঝতে পারছে না। বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থ উপাচার্য কীভাবে নিজের ইচ্ছামতো ব্যয় করতে পারেন? বিশ্ববিদ্যালয়ের বাজেট, ফাইন্যান্স কমিটি, বৃহৎ প্রকল্পের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি কি তাহলে লোক দেখানো পরিহাস মাত্র? ২ কোটি টাকা যদি ছাত্রলীগকে কেবল চাঁদাই দিয়ে থাকেন, তাহলে নিজের পরিবার ও দলবলের জন্য কত কোটি রাখতে পারেন? হাজার কোটি টাকার দীর্ঘমেয়াদি প্রকল্পে তাহলে কারা কত টাকা বখরা পাচ্ছেন? ইত্যাদি অসংখ্য প্রশ্নের সুরাহা না করে, কোনো প্রকার তদন্ত না করে এই দীর্ঘ সময় ধরে একটি বিশ্ববিদ্যালয়কে অস্থিতিশীল করে রাখা হয়েছে কার স্বার্থে? শিক্ষা ও গবেষণা সব পরিবেশ ধ্বংস করে কাউকে ক্ষমতার টিকে থাকতে হবে কেন?দুর্নীতির উত্থাপিত অভিযোগের তদন্ত করতে উপাচার্যকে সাময়িকভাবে অপসারণ করার জন্য টিআইবির রিপোর্টে সুপারিশ করা হয়েছে এই জন্যে যে উপাচার্য পদে বহাল থাকলে তাঁর দ্বারা তদন্তকাজ প্রভাবিত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। বুয়েটে আবরার হত্যার পর জাহাঙ্গীরনগরেও হলে হলেও গণরুম, টর্চার সেলের ভিডিও ও ছবি এবং ভুক্তভোগী ও প্রত্যক্ষদর্শীর সাক্ষ্য-বিবরণী প্রকাশ পেয়েছে। যৌন নিপীড়ন সেলের বিরুদ্ধে অভিযুক্তকে হয়রানি ও নিপীড়ককে আশ্রয়-প্রশ্রয় দেওয়ার ঘটনায় অনাস্থা এসেছে, নিয়োগ-বাণিজ্য ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্পদের ব্যক্তিগত ব্যবহারের খবর প্রকাশ পেয়েছে। উপাচার্য নিজে বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী চাইলে আমি পদত্যাগ করব। এত কিছুর পরও তাহলে প্রধানমন্ত্রী চাইছেন না কেন? দুর্নীতির প্রশ্নে কাউকে ছাড় না দেওয়ার নীতি জাহাঙ্গীরনগরের ক্ষেত্রে কোথায়? মাথা থেকে পা পর্যন্ত দুর্নীতিগ্রস্ত এই উপাচার্য ক্ষমতা আঁকড়ে থাকার জন্য যে ন্যক্কারজনক হামলাকে স্বাগত জানিয়েছেন, নির্লজ্জভাবে আনন্দ প্রকাশ করেছেন, ছাত্রলীগের কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন, তা নিকট ইতিহাসের সব নজিরকে হার মানিয়েছে। পুলিশ বাহিনী মোতায়েন করে বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিষ্টকাল বন্ধ করে দিয়ে জমিদারী কায়দায় তিনি এই ক্যাম্পাসে আর থেকে যেতে পারবেন না।
ক্যাম্পাস থেকে উপাচার্য বিদায় নেবেন, শিক্ষার্থীরা নন!