জামিউল আহসান সিপু ও দিদারুল আলম;
প্রায় সাড়ে তিন বছর আগে গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে ঘটেছিল নারকীয় জঙ্গি হামলার ঘটনা। বাংলাদেশে খিলাফত কায়েমের লক্ষ্যে বহু বিদেশি হত্যা করে জনমনে আতঙ্ক তৈরি ও আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠন আইএসএর দৃষ্টি আকর্ষণই ছিল ঐ হামলার মূল উদ্দেশ। নির্মম ও নিষ্ঠুর ঐ হামলার মূল পরিকল্পনা করেছিলেন নব্য জেএমবির প্রধান সমন্বয়ক তামিম চৌধুরী, নুরুল ইসলাম মারজান ও সারোয়ার জাহান।
বেকারিতে হামলা ও হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছিলেন পাঁচ জঙ্গি যারা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিশেষ অভিযানে নিহত হন। হামলা প্রচেষ্টায় জড়িত ছিলেন নব্য জেএমবির সাত জঙ্গি। এই সাত জঙ্গিকে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন ঢাকার সন্ত্রাসবিরোধী বিশেষ ট্রাইব্যুনালের বিচারক মো. মজিবুর রহমান। রায় শুনে দণ্ডিত আসামিরা কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে ‘আল্লাহু আকবর’ ধ্বনি দেন। একই সঙ্গে বলেন, ‘আমরা কোনো অন্যায় করিনি’। এ সময় তাদের অনেককে হাসতেও দেখা যায়। রায়ে বিচারক বলেন, পরিকল্পনাকারী তিন জন ও অভিযুক্ত সাত জঙ্গির একই অভিপ্রায় ছিল যে পাঁচ জঙ্গি রোহান ইবনে ইমতিয়াজ, মীর সামেহ মোবাশ্বের, নিরবাস ইসলাম, মো. খায়রুল ইসলাম পায়েল ও মো. শফিকুল ইসলাম উজ্জ্বলকে দিয়ে মূল হামলাকারী গুলশানের কূটনৈতিক এলাকায় বড়ো ধরনের হামলা করে বহু দেশি-বিদেশি মানুষকে হত্যা করেন। সেই অভিপ্রায় বাস্তবায়নের জন্য আসামিদের মধ্যে কেউ পরিকল্পনা, কেউ অস্ত্র সংগ্রহ , কেউ প্রশিক্ষণ ও প্ররোচনা এবং কেউ পরিকল্পনা অনুমোদন দিয়ে ঐ হামলা সংঘটিত করেন। এ কারণে ঐ হামলার মূল পরিকল্পনাকারী, সমন্বয়কারী এবং ঐ হামলাকারী ও হামলা প্রচেষ্টায় জড়িত কারো ভূমিকা ছোটো বা বড়ো করে দেখার সুযোগ নেই। সকলেই একই অভিপ্রায় নিয়ে ঐ নারকীয় হামলা প্রচেষ্টায় অংশগ্রহণ করে একই অপরাধ করেছেন।
এদিকে রায় ঘোষণাকে কেন্দ্র করে পুরান ঢাকার আদালত পাড়ায় নেওয়া হয় কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা। মোতায়েন করা হয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অতিরিক্ত সদস্য। ছিলেন গোয়েন্দাদের কড়া নজরদারি। সকালে আসামিদের কড়া নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে গাজীপুরের কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালত ভবনের হাজতখানায় আনা হয়। সেখান থেকে বেলা ১২টার আগে তাদেরকে সন্ত্রাসবিরোধী ট্রাইব্যুনালের কাঠগড়ায় নেওয়া হয়। এর আগেই আদালত কক্ষ পূর্ণ হয়ে যায় আইনজীবী, দেশি-বিদেশি সাংবাদিক ও পর্যবেক্ষক দ্বারা। আসামিদের কাঠগড়ায় আনার কয়েক মিনিটের মধ্যেই এজলাসে আসেন বিচারক। এ সময় আদালত কক্ষে ছিল হইচই। এ অবস্থায় সবাইকে নীরব থাকার নির্দেশ দিয়ে বিচারক বলেন, রায় ঘোষণার পর মামলার পক্ষগণ প্রতিক্রিয়া দেখাবেন এটাই স্বাভাবিক। তবে আমি সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি ন্যায়বিচার নিশ্চিতের জন্য। সবকিছু বিবেচনা করেই রায় দেওয়া হয়েছে। এরপরই জনাকীর্ণ আদালতে রায় ঘোষণা করেন তিনি।
সাত জঙ্গির কার কি দায়
রায়ে বিচারক বলেন, তামিম চৌধুরী, মারজান ও সারোয়ার জাহানের পরিকল্পনায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত সাত আসামির মধ্যে জাহাঙ্গীর হোসেন ওরফে রাজীব গান্ধী পরিকল্পনা ও প্রশিক্ষণ দিয়ে সদস্য রিক্রুট এবং অস্ত্র সংক্রান্ত তথ্য প্রদান করেন। রাকিবুল হাসান রিগেন মূল হামলাকারীদের প্রশিক্ষণ ও প্ররোচনা দেন। আব্দুস সবুর খান হামলার পরিকল্পনা ও অনুমোদন দেন। আসলাম হোসেন ওরফে র্যাশ অস্ত্র ও গুলি আনা নেওয়া করেন এবং হামলার জন্য বসুন্ধরায় ভাড়া বাসার ব্যবস্থা করেন। মামুনুর রশিদ অস্ত্র সরবরাহ করেন এবং আসামি শরিফুল ইসলাম খালেদ হামলার পরিকল্পনা করে প্রচেষ্টা গ্রহণ করে দেশি-বিদেশি ২৩ জনকে হত্যা, গুরুতর জখম এবং অন্যদের আঘাত করে সন্ত্রাসবিরোধী আইনের ৬(২)(অ) ধারায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেছেন যা সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করতে পেরেছে রাষ্ট্রপক্ষ। এজন্য সাত জঙ্গিকে সন্ত্রাসবিরোধী আইনের ঐ ধারায় দোষী সাব্যস্ত করে তাদেরকে মৃত্যুদণ্ডের পাশাপাশি ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করা হলো। তাদের মৃত্যু নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত গলায় ফাঁসি দিয়ে ঝুলিয়ে রেখে মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের নির্দেশ দেওয়া গেল। মৃত্যুদণ্ডের এ রায়ের সত্যায়িত অনুলিপি পাওয়ার এক মাসের মধ্যে হাইকোর্টে আপিল করার সুযোগ পাবেন দণ্ডিতরা।
এদিকে হামলার সাড়ে তিন বছরের মধ্যে চাঞ্চল্যকর এ হামলা মামলার রায় ঘোষণার পর সরকারের শীর্ষ মহল থেকে সন্তোষ প্রকাশ করা হয়েছে। খোদ আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, বাংলাদেশে এ রকম হত্যাকাণ্ড হলে তার বিচার অত্যন্ত দ্রুত হয় এবং সব আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ করে সেই বিচার সম্পন্ন করার দৃষ্টান্ত আমরা বিশ্ববাসীর সামনে প্রমাণ করতে পেরেছি। তবে আসামি পক্ষের আইনজীবীরা বলছেন, তারা ন্যায়বিচার পাননি, রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করবেন।
বড়ো মিজানই মিজানুর রহমান সেটা প্রমাণিত হয়নি : ট্রাইব্যুনাল
রায়ে সাত জনকে সর্বোচ্চ শাস্তি দেওয়া হলেও বেকসুর খালাস পেয়েছেন মো. মিজানুর রহমান নামের এক আসামি। তার বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবিরোধী আইনের আটটি ধারায় অভিযোগ আনা হলেও তা প্রমাণ করতে পারেনি রাষ্ট্রপক্ষ। এ প্রসঙ্গে বিচারক রায়ে বলেন, আসামি জাহাঙ্গীর হোসেনের দোষ স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে উল্লেখিত বড়ো মিজানই এই মামলার আসামি মো. মিজানুর রহমান তা কোনো সাক্ষ্য হতে দেখা যায়নি। আসামিরা তাদের দোষ স্বীকারের জবানবন্দিতে এও উল্লেখ করেননি যে মিজানুর রহমান হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলার ঘটনার বিষয়ে জানত বা কোনোভাবে জড়িত ছিল। রাষ্ট্রপক্ষ হলি আর্টিজানে হামলার বিষয়ে মিজানকে জড়িয়ে কোনো সাক্ষ্য প্রদান করেনি। মিজানের দোষ স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি এবং অন্যান্য সাক্ষ্য হতে দেখা যায় না যে, মো. মিজানুর রহমান ঐ হামলার সঙ্গে জড়িত কিংবা হামলা সম্পর্কে অবগত ছিল। কাজেই তার বিরুদ্ধে ৬(২)(অ) ধারার আনীত অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি। এ কারণে তাকে খালাস দেওয়া হলো।
রায়ে সাত জঙ্গিকে সন্ত্রাসবিরোধী আইনের ৮ ধারায় ছয় মাস এবং ৯ ধারায় পাঁচ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেয় ট্রাইব্যুনাল। এছাড়া ঐ আইনের ৭ ধারায় আসামি মামুনুর রশিদ ব্যতীত অপর ছয় জঙ্গিকে ১০ বছর সশ্রম কারাদণ্ড ও ১০ লাখ টাকা অর্থদণ্ড এবং অনাদায়ে আরো দুই বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়।
মূল পরিকল্পনাকারী ও সমন্বয়কারী হলেন তামিম
রায়ে বলা হয়, তামিম চৌধুরীর নেতৃত্বে এ হামলা সংঘটিত হয়। আসামি আসলাম হোসেন র্যাশের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে এ তথ্য উঠে এসেছে।
২০১৬ সালের পহেলা জুলাই রাতে হলি আর্টিজানে হামলা চালিয়ে জঙ্গিরা দেশি বিদেশি নাগরিকসহ ২৩ জনকে হত্যা করেন। পরে সেনাবাহিনীর কমান্ডো অভিযানে নিহত হন হামলাকারী পাঁচ জঙ্গি। এ ঘটনায় গুলশান থানায় দায়ের করা হয় সন্ত্রাসবিরোধী আইনে মামলা।
রায়ে সাত জঙ্গিকে সন্ত্রাসবিরোধী আইনের ৮ ধারায় ছয় মাস এবং ৯ ধারায় ৫ বছরের সশ্রম কারাদন্ড দেয় ট্রাইব্যুনাল। এছাড়া ওই আইনের ৭ ধারায় আসামি মামুনুর রশিদ ব্যাতীত অপর ছয় জঙ্গিকে দশ বছর সশ্রম কারাদণ্ড ও দশ লাখ টাকা অর্থদন্ড এবং অনাদায়ে আরো দুই বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেয়া হয়।
এক নজরে বিচার
হামলা :১ জুলাই ২০১৬ রাত পৌনে ৯টা। মামলা দায়ের : ২০১৬ সালের ২ জুলাই, সন্ত্রাস দমন আইনে, গুলশান থানায়। অভিযোগপত্র দাখিল : ২০১৮ সালের ২৩ জুলাই। অভিযোগ গঠন : ২০১৮ সালের ২৬ নভেম্বর, ঢাকার সন্ত্রাসবিরোধী বিশেষ ট্রাইব্যুনালে। সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু : ২০১৮ সালের ৩ ডিসেম্বর। সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ : ২০১৯ সালের ২৭ অক্টোবর। যুক্তিতর্ক শেষ : ২০১৯ সালের ১৭ নভেম্বর।