কাউন্সিলর হয়ে জসিম শতকোটিপতি

নিজস্ব প্রতিবেদক, চট্টগ্রাম

২০০৭ সালে মাত্র আড়াই হাজার টাকা বেতনে একটি বেসরকারি কারখানায় সুপারভাইজার পদে চাকরি করতেন তিনি। ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর চাকরি ছেড়ে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে এলাকায় প্রভাব বিস্তার করেন। ২০১৫ সালে আওয়ামী লীগের টিকিট নিয়ে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের (চসিক) কাউন্সিলর নির্বাচিত হন। এক যুগ পর এখন তিনি শত শত কোটি টাকার মালিক। নগরীর আলোচিত এই কাউন্সিলর হলেন ৯ নম্বর উত্তর পাহাড়তলী ওয়ার্ডের জহুরুল আলম জসিম।

এলাকায় মাদক কারবার, দখলবাজি, শত শত একর পাহাড় কেটে সরকারি খাস জায়গা অবৈধভাবে বিক্রি, কবরস্থান দখল করে জায়গা বিক্রি, অটোরিকশা ও বাসস্ট্যান্ড থেকে চাঁদা আদায়ের অভিযোগ আছে জসিমের বিরুদ্ধে। স্থানীয় একাধিক আওয়ামী লীগ নেতা জানান, কাউন্সিলরের পদে থেকে দখলবাজি, পাহাড় কাটা, জমি দখলসহ নানা অপরাধ করছেন জসিম। এর মাধ্যমে গত চার বছরে অবৈধভাবে শত শত কোটি টাকার মালিক হয়েছেন তিনি।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, কাউন্সিলর জসিমের বিরুদ্ধে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের (সিএমপি) পশ্চিম বিভাগের উপকমিশনারের (ডিসি) দপ্তরে অভিযোগ রয়েছে ১১৫টি। তাঁর বিরুদ্ধে সিএমপির বিভিন্ন থানায় ২০টির বেশি চাঁদাবাজি, দখলবাজি, পাহাড় কাটা ও অস্ত্র মামলা আছে।

কাউন্সিলর জসিম বর্তমানে ৯ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের যুগ্ম আহ্বায়ক। ছাত্রজীবনে পাহাড়তলী ওয়ার্ড ছাত্রলীগের নেতা ছিলেন তিনি। তাঁর বিরুদ্ধে সন্দ্বীপের চিহ্নিত সন্ত্রাসী ছাত্রদলের ক্যাডার বেলাল উদ্দিন জুয়েলকে আকবর শাহ থানা এলাকার যুবলীগের নেতা বানানোর অভিযোগ রয়েছে, যার মাধ্যমে এলাকায় বিভিন্ন সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড করানো হয় এবং তাঁর ছত্রচ্ছায়ায় একাধিক কিশোর গ্যাংয়ের সদস্য এলাকায় নানা অপরাধমূলক কাজে লিপ্ত।

গত ৩০ জুন নগরের পাহাড়তলী এলাকায় যুবলীগের প্রতিপক্ষের কর্মী মহসিনকে বেধড়ক পেটানোর ভিডিও ভাইরাল হয়। ওই ঘটনার মূল নায়ক বেলাল উদ্দিন জুয়েল ওয়ার্ড কাউন্সিলর জসিমের অনুসারী।

এলাকাবাসী জানায়, গত সেপ্টেম্বরে দেশজুড়ে দুর্নীতিবিরোধী অভিযান শুরু হওয়ার পর গাঢাকা দেন কাউন্সিলর জসিম। ওমরাহ পালনের জন্য সৌদি আরবে গিয়েছিলেন বলে এলাকায় গুঞ্জন রয়েছে। সম্প্রতি অভিযান বন্ধ থাকায় আবারও এলাকায় ফিরেছেন তিনি।

এলাকাবাসী বলছে, জসিমের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ থাকলেও ২০১৫ সালে ওয়ার্ড কাউন্সিলর নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে এলাকায় ব্যাপক উন্নয়নকাজ করেছেন তিনি। আগে যাঁরা কাউন্সিলর ছিলেন তাঁরা এলাকার উন্নয়নে তেমন একটা ভূমিকা রাখতে পারেননি।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০০৮ সালের আগে ইস্পাহানি মিলস লিমিটেডে সুপারভাইজার পদে আড়াই হাজার টাকা বেতনে চাকরি করতেন জহুরুল আলম জসিম। ২০১৫ সালের ২৮ এপ্রিল চসিক নির্বাচনের পর প্রশাসনের ছত্রচ্ছায়ায় তিনি এলাকায় মাদক কারবার, দখলবাজি, শত শত একর পাহাড় কেটে সরকারি খাস জায়গা অবৈধভাবে বিক্রয়, বিশ্বব্যাংক হাউজিং এস্টেটের কবরস্থান দখল করে জায়গা বিক্রয়, অটোরিকশা-বাসস্ট্যান্ড থেকে প্রতিদিন চাঁদা আদায়, কৈবল্যধাম হাউজিং এস্টেটের ১৬০টি দোকানঘর দখলসহ নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড চালিয়ে আসছেন।

বর্তমানে নামে-বেনামে তাঁর ৩০০-৪০০ কোটি টাকার স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি রয়েছে। এর মধ্যে বিশ্বব্যাংক কলোনিতে ১৭টি প্লট, যার বাজারমূল্য আনুমানিক ১৫ কোটি টাকা; ফিরোজ শাহ কলোনিতে ছয়টি প্লট ও দুটি ছয়তলা বাড়ি, যার বাজারমূল্য আনুমানিক ৩০ কোটি টাকা; গিরিধারা হাউজিংয়ে সাত কাঠা সমমানের চারটি প্লট, যার বাজারমূল্য আনুমানিক ১০ কোটি টাকা; জয়ন্তিকা আবাসিকে ১৩টি প্লট, যার বাজারমূল্য আট থেকে ১০ কোটি টাকা; লেকসিটি হাউজিংয়ে ছয়টি প্লট, যার বাজারমূল্য আনুমানিক পাঁচ কোটি টাকা; লেকসিটি হাউজিংয়ের পাশে অবৈধভাবে পাহাড় কেটে বিভিন্ন দাগে মোট ২০ কানি (৪০০ গণ্ডা) জায়গা দখল, যার বাজারমূল্য ৮০-৯০ কোটি টাকা; হারবাতলী শাপলা আবাসিক এলাকায় অন্তত ২০ কোটি টাকার সম্পত্তি দৃশ্যমান।

এ ছাড়া সেভেন মার্কেট বাজার, যা কৈবল্যধাম হাউজিং এস্টেটের মালিকানাধীন, সেখানে ১৬০টি দোকান কাউন্সিলর জসিমের দখলে রয়েছে। প্রতিটি দোকানের দখল এককালীন এক লাখ টাকা করে মোট এক কোটি ৬০ লাখ টাকায় হস্তান্তর করেছেন। এসব দোকানের প্রতিটি থেকে প্রতিদিন ১৫০ টাকা করে আদায় হয়। অর্থাৎ মাসে আট থেকে ৯ লাখ টাকা আদায় হয়। সেভেন মার্কেট অটোরিকশা স্ট্যান্ড থেকে প্রতিদিন ১০ হাজার টাকা চাঁদা তোলেন জসিম। মাসে যার পরিমাণ দাঁড়ায় তিন লাখ টাকা। জসিম তাঁর কিশোর গ্যাং দিয়ে এলাকায় দখলবাজি, প্রভাব বিস্তার করেন বলেও অভিযোগ রয়েছে।

জানা গেছে, লেকসিটি প্রকল্পের বাইরে প্রশাসনের ছত্রচ্ছায়ায় শত শত একর পাহাড় কেটে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন কাউন্সিলর জসিম। এ ছাড়া সেখানে গড়ে তুলেছেন ব্যক্তিগত বিশাল ডেইরি ফার্ম। ২০১৭ সালে পরিবেশ অধিদপ্তর পাহাড় কাটার একটি মামলায় জসিমকে অভিযুক্ত করে অভিযোগপত্র দিয়েছে। মামলাটি এখন বিচারাধীন।

আকবর শাহ থানার দ্বিতীয় কর্মকর্তা ইমদাদ হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, কাউন্সিলর জহুরুল আলম জসিমের বিরুদ্ধে ওই থানায় চারটি মামলা রয়েছে। মামলাগুলো তদন্ত পর‌্যায়ে আছে। পাহাড় কাটার অভিযোগে জসিমের বিরুদ্ধে এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেন কর্তৃপক্ষ একটি মামলা করেছে।

এ ছাড়া পাহাড়তলী থানায় পাঁচটি, খুলশী থানায় পাঁচটি, পাঁচলাইশ থানায় একটি এবং আদালতে দায়ের করা আরো কয়েকটি মামলা রয়েছে কাউন্সিলর জসিমের বিরুদ্ধে।

স্থানীয় একাধিক আওয়ামী লীগ নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে কালের কণ্ঠকে বলেন, কাউন্সিলর জসিম দলের নাম ভাঙিয়ে দলের সুনাম নষ্ট করছেন। কাউন্সিলরের পদে থেকেও দখলবাজি, পাহাড় কাটা, জমি দখলসহ নানা অপরাধ করছেন। এর মাধ্যমে গত চার বছরে অবৈধভাবে শত শত কোটি টাকার মালিক হয়েছেন তিনি।

প্রধানমন্ত্রীর কাছে অনুরোধ জানিয়ে আওয়ামী লীগের ওই নেতারা বলেন, এই কাউন্সিলরের বিরুদ্ধে সঠিক তদন্ত করে তাঁকে যেন আইনের আওতায় আনা হয়।

বিভিন্ন অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে কাউন্সিলর জহুরুল আলম জসিম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এসব অভিযোগ মিথ্যা ও বানোয়াট। কাউন্সিলর নির্বাচিত হওয়ায় পর আমার প্রতিপক্ষের লোকজন এসব মামলা ও অভিযোগ করে আমাকে হেয় করতে চাইছে।’

কাউন্সিলর জহুরুল আলম জসিমের পক্ষে তাঁর ভাই আকবর হোসেন খোকন গতকাল সোমবার এক চিঠিতে দাবি করেন, জসিমের বিরুদ্ধে ১৯৯০ সালে পুলিশ জিডি করেছিল পাহাড়তলী থানায়। এরপর ১৯৯১ থেকে ১৯৯৬ এবং ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত বিএনপি সরকারের আমলে বিভিন্ন মামলা হয়। এগুলো রাজনৈতিক হয়রানিমূলক মামলা। পুলিশ বাদী হওয়া মামলা। এসব মামলায় জসিম খালাস পেয়েছেন। ৩০ বছরের রাজনৈতিক জীবনে কোনো ব্যক্তি সুনির্দিষ্ট কোনো অভিযোগ আনতে পারেনি। তিনি কোনো দিন জামায়াত-বিএনপিকে সহায়তা করেননি। তিনি সব সময় মাদক, সন্ত্রাস ও সব ধরনের অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে আসছেন।

খোকন আরো দাবি করেন, তাঁর ভাই কোনো সম্পত্তি দখল বা সরকারি জমি দখল করেননি। লেকসিটি নামের প্রকল্প করতে সিটি করপোরেশন পাহাড় কর্তন করে, যার সঙ্গে তাঁর ভাই বা তাঁদের পরিবারের সম্পৃক্ততা নেই। সেভেন মার্কেট তিনি দখল করেননি, কাউকে দখল করতেও তিনি বলেননি। রাস্তার কাজ করতে গিয়ে এলাকার বিভিন্ন হকার উচ্ছেদ হলে তারা হাউজিংয়ের পড়ে থাকা খালি জায়গায় শামিয়ানা টানিয়ে দোকান করে, এর থেকে কোনো টাকা তাঁর ভাই নেন না।

শীর্ষ সংবাদ সারাদেশ