ব্যাংকঋণের সুদহার এক অংকে নামিয়ে আনার ঘোষণা দিয়েছে সরকার। আগামী ১ এপ্রিল থেকে সব ঋণের ক্ষেত্রে (ক্রেডিট কার্ড ছাড়া) এটি কার্যকর হবে। সরকারের এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে এরই মধ্যে বেশিরভাগ ব্যাংক আমানতের (এফডিআর) সুদহার কমাতে শুরু করেছে। ব্যাংকগুলো এখন আমানতের সুদহার ৬ শতাংশ হারে নিচ্ছে। যারা এখনো কার্যকর করেনি তারা চলতি মাসের মধ্যেই তা কার্যকর করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
গত ২৮ জানুয়ারি ব্যাংক নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) বৈঠকে ঋণের সুদহার এক অংকে নামিয়ে আনতে ১ ফেব্রম্নয়ারি থেকে দেশের কোনো ব্যাংকই ৬ শতাংশের বেশি সুদে আমানত না নেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। যেসব আমানতের মেয়াদ শেষ হবে, সেগুলোর মেয়াদ বৃদ্ধির ক্ষেত্রেও এ সিদ্ধান্ত কার্যকর করে।
গত সপ্তাহে যায়যায়দিন দেশের ৩০টির বেশি ব্যাংকের (এফডিআর) তথ্য সংগ্রহ করেছে। এর মধ্যে সাতটি ব্যাংক তাদের আমানতের সুদের হার ৬ শতাংশে এখনো নামিয়ে আনেনি। সাতটি ব্যাংক হলো- মার্কেন্টাইল ব্যাংক, সাউথইস্ট ব্যাংক, ট্রাস্ট ব্যাংক, এবি ব্যাংক, আইএফআইসি ব্যাংক, প্রিমিয়ার ব্যাংক এবং ন্যাশনাল ব্যাংক। তবে চলতি মাসের মধ্যে তারা কার্যকর করবেন বলে জানিয়েছেন।
এদিকে, একাধিক ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীরা জানিয়েছেন, রাতারাতি আমানতের জন্য সুদের হার ৬ শতাংশ নির্ধারণ করা একটি কঠিন কাজ। কারণ তারা যখন এই আমানত নিয়েছেন তখন ৮-৯ শতাংশ হারে নিয়েছেন।
ন্যাশনাল ব্যাংকের (এনবিএল) অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক এএসএম বুলবুল বলেছেন, তাদের ব্যাংক ইতিমধ্যে এপ্রিলের আগে এফডিআরগুলো ৬ শতাংশে নামিয়ে আনার উদ্যোগ নিয়েছে। ব্যাংক ইতিমধ্যে তিন মাসের এফডিআরের জন্য ৬ শতাংশ সুদের হার নির্ধারণ করেছে। এনবিএল তাদের ছয় মাস থেকে এক-বছরের এফডিআরের জন্য যথাক্রমে ৯ দশমিক ৫০ শতাংশ সুদ পাচ্ছে। মার্কেন্টাইল ব্যাংকও তিন মাসের এফডিআরের ৬ শতাংশ সুদ নির্ধারণ করেছে।
এদিকে, ব্যাংক ঋণের সুদহার এক অংকে নামিয়ে আনার কথা হচ্ছে প্রায় দুই বছর ধরে। বিভিন্ন সময়ে অর্থমন্ত্রী, ব্যাংক উদ্যোক্তাদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকসসহ (বিএবি) সংশ্লিষ্টরা এ ঘোষণা দিয়ে আসছিলেন। যদিও ঋণের সুদহার না কমে উল্টো আরও বাড়ে। এ অবস্থায় ঋণের সুদহার কমানোর বিষয়ে হস্তক্ষেপ করেন প্রধানমন্ত্রীও। সর্বশেষ আগামী ১ এপ্রিল থেকেই ক্রেডিট কার্ড ছাড়া দেশের সব ধরনের ব্যাংকঋণের সুদহার এক অংকে নামিয়ে আনার সময়সীমা বেঁধে দেয়া হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেই সুদহার কমানোর বিষয়টি দেখভাল করছেন।
ব্যাংকঋণের সুদহার এক অংকে নামিয়ে আনার ঘোষণা বাস্তবায়নের জন্য সরকারি আমানতের সর্বোচ্চ সুদহার বেঁধে দিয়ে এরই মধ্যে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে অর্থ মন্ত্রণালয়। ২০ জানুয়ারি জারি করা ওই প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, সরকারি আমানত বেসরকারি ব্যাংকে জমা রাখলে সর্বোচ্চ সুদহার হবে ৬ শতাংশ। আর রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকে রাখলে এ আমানতের সর্বোচ্চ সুদহার ৫ দশমিক ৫০ শতাংশের বেশি হবে না। একই সঙ্গে সরকারি আমানতের ৫০ শতাংশ বাধ্যতামূলকভাবে বেসরকারি ব্যাংকগুলোতে রাখার বিষয়েও নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) এবং পরিচালন বাজেটের আওতায় প্রাপ্ত অর্থ, স্বায়ত্তশাসিত ও আধা স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা এবং সরকারি মালিকানাধীন কোম্পানির নিজস্ব তহবিলের উদ্বৃত্ত অর্থ বেসরকারি ব্যাংকে রাখলে এর সর্বোচ্চ সুদহার হবে ৬ শতাংশ। একই আমানত সরকারি ব্যাংকে সর্বোচ্চ সাড়ে ৫ শতাংশ সুদে রাখা যাবে। তবে প্রতিষ্ঠানগুলোর ভবিষ্যৎ তহবিলের অর্থ, পেনশন তহবিলের অর্থ এবং এন্ডাউমেন্ট ফান্ডের অর্থ এর আওতাবহির্ভূত থাকবে।
সরকারি নির্দেশনা জারির পর এরই মধ্যে অনেক ব্যাংক ব্যক্তি খাতসহ সব ধরনের আমানতের সর্বোচ্চ সুদহার ৬ শতাংশে নামিয়ে এনেছে। যদিও সুদহার কমানোয় অনেক বেসরকারি ব্যাংক থেকে এরই মধ্যে আমানত বেরিয়ে বেশি সুদে অন্য ব্যাংকে চলে গেছে। বিষয়টি নিয়ে ব্যাংক নির্বাহীসহ অন্য ব্যাংকার ও পরিচালকদের মধ্যে মনোমালিন্যের ঘটনাও ঘটেছে। এ অবস্থায় সব ব্যাংকের আমানতের সুদহার ৬ শতাংশে নামিয়ে আনার জন্যই ২৮ জানুয়ারি বৈঠকে বসেছিল এবিবি।
এ বিষয়ে এবিবির জ্যেষ্ঠ সহ-সভাপতি ও এনআরবি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মো. মেহমুদ হোসেন বলেন, ব্যাংকঋণের সুদহার কমানোর বিষয়ে সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী অনেক ব্যাংকই এরই মধ্যে আমানতের সুদহার কমিয়ে এনেছে। অর্থ মন্ত্রণালয়ও এরই মধ্যে সরকারি আমানতের সুদহার বেঁধে দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে। ব্যাংকগুলোকে ১ এপ্রিলের মধ্যে ঋণের সুদহার ৯ শতাংশে নামিয়ে আনতে হলে অবশ্যই কস্ট অব ফান্ড কমিয়ে আনতে হবে। তবে কোনো ব্যাংক কী পন্থায় আমানতের সুদহার কমাবে, সেটি একান্তই সে ব্যাংকের নিজস্ব বিষয়।
তবে এনবিআরের একটি প্রজ্ঞাপন নিয়ে ব্যাংক এমডিদের অসন্তোষ রয়েছে। সম্প্রতি বিভিন্ন ধরনের ব্যাংক আমানত ও সঞ্চয় স্কিমের সুদের ওপর উৎসে কর কর্তন ও জমাদান বিষয়ে একটি প্রজ্ঞাপন জারি করে এনবিআর। ওই প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজার থেকে নেয়া ধার বা কলমানির সুদের ওপর ১০ শতাংশ হারে কর কর্তনের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। আমানতকারী টিআইএনধারী হলে ১০ শতাংশ অন্যথায় ১৫ শতাংশ হারে কর কর্তন করতে বলেছে এনবিআর। এছাড়া সব ধরনের কর অব্যাহতিপ্রাপ্ত ফান্ডের (পেনশন, গ্র্যাচুইটি, প্রভিডেন্ট ফান্ডসহ অন্যান্য ফান্ড) আমানতের সুদের ওপর ৫ শতাংশ হারে উৎসে কর কর্তনের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। আমানতের সুদ প্রদান অথবা হিসাবে ক্রেডিট করার সময় উৎসে কর কর্তন প্রযোজ্য হবে বলেও নির্দেশ দিয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড। এক্ষেত্রে শুধু চূড়ান্ত প্রদানের সময় কর কর্তন না করে প্রতিবার সুদ ক্রেডিট প্রদানকালে উৎসে কর কর্তন ও জমাদানের বাধ্যবাধকতা আরোপ করা হয়েছে। এনবিআরের এ প্রজ্ঞাপনকে ব্যাংক ও গ্রাহকদের স্বার্থবিরোধী বলে দাবি করেছেন ব্যাংক নির্বাহীরা। এ নিয়ে ক্ষোভও প্রকাশ করেছেন তারা।
এ বিষয়ে এবিবির সাবেক চেয়ারম্যান ও মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের এমডি সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, কলমানি কখনই ব্যাংকের আমানত নয়। দৈনন্দিন প্রয়োজন মেটানোর জন্যই আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজার থেকে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো অর্থ ধার করে। কলমানির সুদের ওপর ১০ শতাংশ কর আরোপ অনৈতিক। একই সঙ্গে স্থায়ী আমানতের ওপর প্রতিবার সুদ ক্রেডিট করার সময় কর কর্তনের নির্দেশটিও সঠিক নয়। কারণ অনেক গ্রাহকই স্থায়ী আমানতের মেয়াদ পূর্ণ না করে টাকা তুলে নেন। এক্ষেত্রে কর কর্তনে জটিলতা তৈরি হবে। এ বিষয়ে তারা সহসাই বাংলাদেশ ব্যাংকে যাবেন।
কর্মকর্তারা মনে করেন, সিঙ্গেল ডিজিট সুদে ঋণ দিতে গেলে ব্যাংকের মুনাফা কমে যাবে। আর মুনাফা কমে গেলে ব্যাংকের কর্মকর্তাদের বেতন-ভাতায় বিরূপ প্রভাব পড়বে।
তবে অর্থনীতিবিদরা বলছেন, খেলাপি ঋণ না কমিয়ে সিঙ্গেল ডিজিট তথা ৯ শতাংশ সুদে ঋণ বিতরণের জন্য চাপ দেওয়ার কারণে এর বড় আঘাতটা আসবে সীমিত আয়ের মানুষের ওপর। কারণ, এটা করতে ব্যাংকের তহবিল ব্যয় কমানোর প্রয়োজন হবে।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘সবাই ৯ শতাংশ সুদে ঋণ পাবেন না। ব্যাংকিং খাতে যাদের প্রভাব আছে, কেবল তারাই ৯ শতাংশ সুদে ঋণ পাবেন।’ তিনি উলেস্নখ করেন, এটা করতে ব্যাংকের তহবিল ব্যয় কমানোর প্রয়োজন হবে। এতে বড় আঘাতটা আসবে অল্প আয়ের মানুষের ওপর। সীমিত আয়ের সঞ্চয়কারীর ক্ষতির মুখে পড়বেন।
তিনি বলেন, ‘ঋণে ৯ শতাংশ সুদের কথা বলে আমানতকারীদের কাছ থেকে কম সুদে ডিপোজিট নেওয়ায় আমানতকারীরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। আসল কথা হলো সাধারণ ভোক্তা বা ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তারা ৯ শতাংশ সুদে ঋণ পাবেন না। একটি প্রভাবশালী গোষ্ঠীকে সুবিধা দিতে গিয়ে উল্টো এসএমই ও অন্যান্য খাতে ঋণের সুদ হার আরও বাড়তে পারে।
অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) সাবেক চেয়ারম্যান নুরুল আমিন জানান, একবারে সব খাতের সুদহার ৯ শতাংশে নামিয়ে আনা ঠিক হবে না। ধাপে ধাপে করা যেতে পারে। কর্পোরেট গভর্নেন্স, ব্যাংকারদের অভিজ্ঞতাসহ নীতিগত জায়গাগুলোতে এখনো নাজুক অবস্থায় ব্যাংকিং খাত। প্রস্তুতি ছাড়া এত বড় সিদ্ধান্ত কতটুকু বাস্তবায়ন হবে তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে।