সরকারি, বেসরকারি ও বিদেশি মিলিয়ে দেশে ৫৮টি ব্যাংক রয়েছে ব্যাংকে টাকা রাখলে কমে যাওয়ার শঙ্কা

সাধারণ আমানতকারীরা ব্যাংকে টাকা রাখে মুনাফা পাওয়ার আশায়। কিন্তু কম সুদহার আর মূল্যস্ফীতির ঊর্ধগতির কারণে বছর শেষে টাকা পাওয়া যাবে তাতে প্রকৃত আয় কমে যেতে পারে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এর ফলে মানুষের সঞ্চয় প্রবণতা কমবে। সরকারি, বেসরকারি, বিদেশি মিলিয়ে বাংলাদেশে ৫৮টি ব্যাংক রয়েছে। তাদের প্রত্যেকের ভিন্ন ভিন্ন সুদহারে আমানতের প্যাকেজ আছে। এর মধ্যে ১৬টি ব্যাংকের গড় সুদহার ৫ ভাগের নিচে। ৩১টি ব্যাংকই সুদ দিচ্ছে ছয় ভাগের কম। সরকারি ব্যাংকগুলোর মধ্যে অগ্রণী, জনতা, রূপালি ও সোনালী ব্যাংকের গড় সুদহার চার থেকে সাড়ে চার ভাগের মতো। খবর ডয়চে ভেলের

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, সব মিলিয়ে দেশে ব্যাংক খাতে আমানতের বিপরীতে গড় সুদহার পাঁচ দশমিক সাতভাগ। অন্যদিকে সার্বিক মূল্যস্ফীতির হারও দাঁড়িয়েছে সাড়ে পাঁচ ভাগের বেশি। এ কারণে ব্যাংকে টাকা রেখে সঞ্চয়কারীরা এখন আর প্রকৃত অর্থে লাভবান হতে পারছেন না। বরং তাদের জমা করা টাকার মূল্যমান বা আয় কমে যাওয়ার শঙ্কা রয়েছে। ধরুন ব্যাংকে কেউ ১০০ টাকা জমা রেখেছেন। সুদহার ছয় ভাগ হলে বছর শেষে তিনি ১০৬ টাকা পাবেন। কিন্তু মূল্যস্ফীতির হারও যদি ছয় ভাগ হয় তাহলে ১০০ টাকায় এখন যেই পণ্য বা সেবা পাওয়া যায় বছর শেষে তার জন্য ১০৬ টাকা খরচ করতে হবে। সেক্ষেত্রে ব্যাংকে টাকা জমা রেখে সেই টাকা থেকে কোনো আয় হবে না আমানতকারীদের।

এ অবস্থাকে সঞ্চয়ের জন্য মোটেও অনুক‚ল নয় বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘এর অর্থ হলো মানুষের টাকা নাই হয়ে যাচ্ছে। দরিদ্র, মধ্যবিত্ত তাদের মূল সম্পদ হচ্ছে টাকা। তাদের সঞ্চয়ের অভ্যাস কমে যাবে। ইনক্লুসিভ ফাইন্যান্স যাকে বলছি, সেটা কমে যাবে।’

এখন ব্যাংকগুলো তাদের নিজেদের ব্যবসায়িক নীতি অনুযায়ী সুদহার নির্ধারণ করে। এপ্রিল থেকে সেই সুযোগও তারা হারাবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী, তখন কোনো ব্যাংকই আমানতকারীদের ছয় ভাগের বেশি হারে সুদ দিতে পারবে না। এর ফলে সঞ্চয়কারীদের আরো ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘প্রথমত সুদের হার বেঁধে দেয়াটা কোনোভাবেই যৌক্তিক না। বলতে পারত স্প্রেড (আমানত ও ঋণের সুদহারের ব্যবধান) কমাও। এর প্রভাব পড়বে আমাদের সঞ্চয়ের ওপর। এটা সামগ্রিকভাবে আমাদের বিনিয়োগে প্রভাব ফেলবে।’ তবে অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান অর্থনীতিবিদ জায়েদ বখত মনে করেন, ‘মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে থাকলে (আমানতকারীর) রিয়েল ইনকাম কমবে না। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে না থাকলে অবশ্যই তাদের প্রকৃত আয়টা তখন কমে যাবে।’

শেয়ারবাজারে আস্থার সঙ্কট : বিশ্বের অনেক দেশেই শেয়ারবাজার শক্তিশালী। সেখানে ব্যাংকে টাকা রাখার বদলে মানুষ আয়ের জন্য বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শেয়ার কিনে লাভবান হওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু বাংলাদেশে শেয়ারবাজার কখনোই শক্তিশালী ভিত্তির ওপর দাঁড়ায়নি। তার ওপর আছে কারসাজি করে দাম বাড়ানো কিংবা কমানোর অভিযোগ। এর ফলে শেয়ারবাজারে টাকা খাটিয়ে বরং পথে বসতে হয়েছে অনেক সাধারণ বিনিয়োগকারীকে। সাম্প্রতিক সময়ে দেশের শেয়ারবাজারের পরিস্থিতি আরো নাজুক হয়েছে।

এক বছর আগে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের বাজার মূলধন ছিল প্রায় চার লাখ ১৪ হাজার ৫৩০ কোটি টাকা। ১৮ ফেব্রুয়ারিতে এসে তা তিন লাখ ৫৬ হাজার ১৬০ কোটিতে দাঁড়িয়েছে। অর্থাৎ এক বছরেই বাজার থেকে উধাও হয়েছে ৫৮ হাজার ৩৭০ কোটি টাকা। গত কয়েকদিনে কিছুটা ঘুরে দাঁড়ালেও এক বছরের ব্যবধানে সূচকের পতনটাও উল্লেখ করার মতো। গত বছর একই দিনে ডিএসইএক্স যেখানে পাঁচ হাজার ৭২৪ পয়েন্ট ছিল এখন তা নেমে এসেছে চার হাজার ৭৪০-এ।

সঞ্চয়পত্রে বাধা : ব্যাংকের সুদহারের সাথে বড় ধরনের তফাতে গত কয়েক বছরে সাধারণ মানুষের টাকা জমা রাখার নির্ভরযোগ্য মাধ্যম হয়ে উঠেছিল সঞ্চয়পত্র। গত কয়েকটি অর্থবছরে এর বিক্রি সরকারের বাজেটে ধরা লক্ষ্যমাত্রাকে ছাড়িয়ে যেতে থাকে। রাষ্ট্রের কোষাগার থেকে তাই বছর বছর সুদ পরিশোধের চাপও বাড়ে। এমন অবস্থায় সঞ্চয়পত্র বিক্রির রাশ টানার পদক্ষেপ নেয় সরকার। জুলাই থেকে সঞ্চয়পত্র কেনার ক্ষেত্রে টিআইএন ও ব্যাংক হিসাব বাধ্যতামূলক করা, অনলাইনে আবেদনের পাশাপাশি উৎসে করের হার পাঁচ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১০ শতাংশ করা হয়।

সরকারের এসব পদক্ষেপের প্রভাব পড়েছে সঞ্চয়পত্রের বিক্রিতে। চলতি অর্থবছরে যেখানে ২৭ হাজার কোটি টাকার লক্ষ্যমাত্রা ধরেছিল সরকার, সেখানে বছরের অর্ধেকে ৫ হাজার ৪৩৩ কোটি টাকা এসেছে এই খাত থেকে। অথচ গত অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসেই বিক্রি হয়েছিল ৪৩ হাজার ৫৩৯ কোটি ২৯ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র।

এরপরও সম্প্রতি ডাকঘর সঞ্চয় স্কিমের সুদহার অর্ধেকে নামিয়ে আনার ঘোষণা দিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের সাধারণ মানুষের সঞ্চয়ের আস্থার একটি জায়গা ছিল এই স্কিমটি। এখন তারা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। অর্থনীতিবিদ জায়েদ বখত বলেন, ‘একটা নির্দিষ্ট অঙ্কের ওপর ডিপোজিট রাখতে গেলে সেটার ব্যাপারে কড়াকড়ি আরোপ করা যেত। কিন্তু ক্ষুদ্র সঞ্চয়কারীরা, যারা যেসব জায়গায় ডাকঘর ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে, তারা যদি এখানে সঞ্চয় করে থাকে, সেই ক্ষেত্রে এই ক্ষুদ্র সঞ্চয়কারীরা সুদের হার এক লাফে অর্ধেক করে ফেলার কারণে অবশ্যই বিপাকে পড়বেন।’

অন্যদিকে সালেহউদ্দিন আহমেদ মনে করেন, সরকারের রাজস্ব আয় কম দেয়ার মাশুল গুনতে হচ্ছে গরিব মানুষকে। যুক্তি দেয়া হচ্ছে, এর পেছনে সরকারের ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে। কিন্তু এই টাকা তো সাধারণ মানুষের ট্যাক্স বা রাজস্ব আয় থেকেই যাচ্ছে। তাহলে আপনি দরিদ্র মানুষকে কেন এজন্য শাস্তি দেবেন। রাজস্ব আয় কমে যাওয়ার দোষ তো আর তাদের না।

তার মতে, সঞ্চয়পত্র অনেকে অপব্যবহার করেছে, সেটা হয়তো সংশোধন করা যেত। কিন্তু তার মানে এই নয়, সুদের হার কমিয়ে দিতে হবে। এক্ষেত্রে সাধারণ মানুষের যে টাকা রাখার প্রবণতা আর নির্দিষ্ট আয়ের মানুষের উপার্জনের বিষয়টি মোটেও বিবেচনায় নেয়া হয়নি।

সাধারণ মানুষ কোথায় টাকা রাখবেন : এমন অবস্থায় সাধারণ মানুষ আসলে কোথায় টাকা খাটাবেন সেটি বড় প্রশ্ন হয়ে দেখা দিচ্ছে। সুদ যত কমই হোক এই মুহূর্তে ব্যাংকে টাকা রাখা ছাড়া মানুষের সামনে আর কোনো সুযোগ নেই বলে মনে করেন জায়েদ বখত। তিনি বলেন, ‘মানুষের হাতে আর কোনো অপশন নেই। মানুষ তো ঘরে টাকা ফেলে রাখবেন না। বিভিন্ন ব্যাংকিং সার্ভিসও নেয়ার বিষয় আছে। এটা যে খুব একটা বেশি সঞ্চয় ডাইভার্ট করবে তা মনে হয় না। কারণ ডাইভার্ট করে সঞ্চয় তো অন্য জায়গায় নেয়ার সুযোগ নেই।

তবে তার সঙ্গে একমত নন সালেহউদ্দিন আহমেদ। তিনি মনে করেন, সাধারণ মানুষের এখন টাকা রাখার জায়গা কোথাও নেই। এ কারণে বাংলাদেশের মানুষের সঞ্চয়ের প্রবণতা কমবে। তারা ব্যাংকে টাকা রাখার উৎসাহ হারাবেন। বেছে নেবেন টাকা রাখার প্রথাগত পদ্ধতিগুলো, যা শেষ পর্যন্ত তৈরি করবে তারল্য সঙ্কট, নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে বেসরকারি খাতের বিনিয়োগে।

অর্থ বাণিজ্য জাতীয় শীর্ষ সংবাদ