করোনা পরীক্ষায় ফি নির্ধারণসহ আটটি কারণে নমুনা পরীক্ষা কমেছে। ফি নির্ধারণের কারণে অনেকেই পরীক্ষা করানো থেকে দূরে থাকছেন। এতে সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়ছে।
২০ জুলাই স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সমন্বয় কমিটির সভার কার্যবিবরণীতে করোনা শনাক্তকরণ পরীক্ষা কমে যাওয়ার সম্ভাব্য কারণগুলো উল্লেখ করা হয়েছে। অধিদপ্তরের পর্যালোচনায় পরীক্ষার সংখ্যা কমে যাওয়ার আট কারণের প্রথমে আছে পরীক্ষার ফি নির্ধারণ। বাকি কারণগুলো হলো হাসপাতাল ছাড়ার আগে রোগীর শরীরে করোনার অস্তিত্ব জানতে পরপর দুটি পরীক্ষা না করানো; উপসর্গ নেই, এমন রোগীরা কম আগ্রহী হচ্ছেন; সার্বিকভাবে দেশে করোনার প্রকোপ কমে গেছে; জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে সামাজিকভাবে হেয়প্রতিপন্ন হওয়ার আশঙ্কায় অনেকে পরীক্ষা করাচ্ছেন না; জীবিকাসংকটের মুখে পড়েছেন বা পড়তে পারেন, এই আশঙ্কায় অনেকে পরীক্ষা করাচ্ছেন না; রোগী গুরুতর অসুস্থ না হলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বাড়িতে টেলিমেডিসিনের মাধ্যমে চিকিৎসা নেওয়ার জন্য উৎসাহিত করছে এবং বন্যার কারণে যোগাযোগব্যবস্থার অবনতি হওয়ায় কোথাও কোথাও পরীক্ষা কমে গেছে। কার্যবিবরণীতে দিনে ২৪ হাজার পরীক্ষা করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল, এমন কথার উল্লেখ আছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া অঞ্চলের সাবেক পরামর্শক মুজাহেরুল হক প্রথম আলোকে বলেন, পরীক্ষার জন্য ফি নির্ধারণের সিদ্ধান্ত ভুল ছিল। ফি, বন্যা ও রোগীর ছাড়পত্রের সময় পরীক্ষা না হওয়ার কারণে নমুনার সংখ্যা কমেছে। কিন্তু বাকি পাঁচটি কারণে পরীক্ষা কমেছে, এমন কোনো প্রমাণ স্বাস্থ্য অধিদপ্তর দেখাতে পারবে না।
একাধিক জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ মনে করেন, কোনো তথ্যপ্রমাণ ছাড়াই অনুমানের ওপর ভিত্তি করে ফি নির্ধারণ করেছিল স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। এখনো অনুমানের ওপর কথা বলছে তারা। মুজাহেরুল হক বলেন, মন্ত্রণালয়ের উচিত ফি বাতিল করা। ফি বাতিল করলেই করোনা পরীক্ষা বেড়ে যাবে।
করোনা শনাক্তকরণ পরীক্ষাকে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বা অধিদপ্তর কখনো প্রয়োজনীয় গুরুত্ব দেয়নি। করোনার সংক্রমণ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণে রোগ শনাক্তকরণ পরীক্ষা খুবই জরুরি বলে মনে করেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।
করোনাবিষয়ক জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির আহ্বায়ক অধ্যাপক মোহাম্মদ সহিদুল্লা বলেন, মহামারির সঠিক পরিস্থিতি জানতে হলে পর্যাপ্ত পরিমাণে রোগ শনাক্তকরণ পরীক্ষা হওয়া দরকার। তিনি বলেন, যাঁদের দরকার, এমন কেউ যেন পরীক্ষা থেকে বাদ না পড়েন, এমন উদ্যোগ এখনই দিতে হবে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও মহামারির শুরু থেকে পরীক্ষার গুরুত্বের কথা বলে আসছে। সংস্থাটি বলেছে, পরীক্ষা করুন, পরীক্ষা করুন, পরীক্ষা করুন। সন্দেহভাজন প্রতিটি মানুষকে পরীক্ষা করুন।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মানদণ্ডে বাংলাদেশের জনসংখ্যা অনুযায়ী দৈনিক ২৪ থেকে ২৫ হাজার নমুনা পরীক্ষা হওয়া দরকার। বাংলাদেশ এক দিনের জন্যও ২০ হাজার নমুনা পরীক্ষা করতে পারেনি। এ ব্যাপারে কারও জবাবদিহি করতে দেখা যায়নি।
জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত নমুনা পরীক্ষার দায়িত্বে ছিল সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) হাতে। কোনো কোনো দিন মাত্র একটি বা দুটি নমুনা পরীক্ষা করেছে আইইডিসিআর। আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র বাংলাদেশের (আইসিডিডিআরবি) মতো প্রতিষ্ঠানের উচ্চ মানসম্পন্ন ল্যাবরেটরি থাকার পরও তাদের নমুনা পরীক্ষার অনুমতি দিতে বিলম্ব করেছে। আরও একাধিক সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে একই আচরণ করেছে আইইডিসিআর।
কিন্তু আইইডিসিআরের কাছ থেকে পরীক্ষার নিয়ন্ত্রণ স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে যাওয়ার পর সমস্যা দেখা দেয় পরীক্ষার মান নিয়ে। এখন ৮০টি ল্যাবরেটরিতে নমুনা পরীক্ষা হচ্ছে। কিন্তু পরীক্ষার ফলাফল নিয়ে নানা অভিযোগের কথা গণমাধ্যমে এসেছে। যেমন বিলম্বে পরীক্ষার ফল পাওয়া, পরীক্ষার ফল জানতে না পারা, এক ব্যক্তিকে একই দিনে পজিটিভ ও নেগেটিভ ফল জানানো, পরীক্ষা করাননি, এমন ব্যক্তিকে রোগী বলে শনাক্ত করা। জেকেজি বা রিজেন্টের পরীক্ষার সনদ জালিয়াতির ঘটনাও প্রকাশ পেয়েছে। ল্যাবরেটরির যন্ত্রপাতি বা সক্ষমতা সরেজমিন যাচাই না করেই বেশ কিছু প্রতিষ্ঠানকে করোনা পরীক্ষার অনুমতি দিয়েছিল স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। সংবাদপত্রে প্রতিবেদন ছাপার পর এমন পাঁচটি প্রতিষ্ঠানের অনুমোদন বাতিলও করা হয়।
পরীক্ষার ফি নির্ধারণে সরকারের যুক্তি ছিল, বিনা মূল্যের সুযোগ নিয়ে প্রয়োজন নেই, এমন অনেকেই পরীক্ষা করাচ্ছেন। যদিও অপ্রয়োজনে কত মানুষ পরীক্ষা করাচ্ছেন, তার হিসাব স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বা অধিদপ্তরে ছিল না। বুথে বা হাসপাতালে নমুনা দিলে ২০০ টাকা এবং স্বাস্থ্যকর্মীরা বাড়িতে গিয়ে নমুনা সংগ্রহ করলে ৫০০ টাকা ফি বাধ্যতামূলক হয় জুলাই মাসের শুরু থেকে। তখন থেকেই দৈনিক পরীক্ষা কমতে দেখা যায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, ফি নির্ধারণের কারণে পরীক্ষা কমেছে।
গতকাল স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) অধ্যাপক সানিয়া তহমিনা বলেন, মূল্য নির্ধারণের সিদ্ধান্ত হয়েছে ওপর থেকে।
জুনের ২৬ তারিখ পরীক্ষার সংখ্যা বেড়ে হয়েছিল ১৮ হাজার ৪৯৮। এর তিন দিন পর ফি নির্ধারণ করে প্রজ্ঞাপন জারি করে সরকার। এক মাস পর, অর্থাৎ ২৫ জুলাই পরীক্ষা কমে হয় ৯ হাজার ৬১৫। ওই দিন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সংবাদ বুলেটিনের শুরুতে মানুষকে বুথে এসে নমুনা পরীক্ষা করার অনুরোধ জানানো হয়েছিল।