রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘ঐ মহামানব আসে’। বাঙালির জাতীয় জীবনে মহামানব হিসেবে এসেছিলেন বঙ্গবন্ধু। তিনি এসে আমাদের উপহার দিয়েছেন স্বাধীন-সার্বভৌম একটি দেশ, একটি জাতি। বাংলাদেশকে ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত সোনার বাংলায় রূপান্তরের স্বপ্ন দেখেছিলেন।
তাই তিনি পাকিস্তানের কারাগার থেকে দেশে ফিরেই দ্রুত যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ পুনর্গঠন শুরু করেন এবং সফলভাবে অর্থনৈতিক ও অন্যান্য খাতের গভীরে প্রোথিত বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করেন।
বঙ্গবন্ধু সদ্যস্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে দেখলেন গুদামে খাদ্য নেই, মাঠে ফসল নেই, কেন্দ্রীয় ব্যাংকে রিজার্ভ শূন্য। বস্তুত কোনো ব্যাংকের কার্যকারিতা নেই। সড়ক ও রেলপথ বিচ্ছিন্ন, নৌ ও সমুদ্রবন্দরগুলো বিধ্বস্ত। স্কুল-কলেজগুলো ছিল পরিত্যক্ত সেনাছাউনি। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী পরাজয় নিশ্চিত জেনে সম্ভাব্য সবকিছু ধ্বংস করে দিয়েছিল।
দেশীয় ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলের কিছু কুচক্রীমহল তখনও চাচ্ছিল দেশটি স্বাধীন হিসেবে না থাকুক অথবা তলাবিহীন ঝুড়িতে পরিণত হোক। তাই প্রথমেই তিনি গুরুত্ব দিয়েছেন জোটনিরপেক্ষ অবস্থান বজায় রেখে দ্রুততম সময়ের মধ্যে বিশ্বের বেশির ভাগ দেশের স্বীকৃতি আদায় এবং আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার সদস্যপদ লাভ করানোর বিষয়ে। এ কারণে তিনি ১৯৭৪ সালে পাকিস্তানে অনুষ্ঠিত ওআইসির দ্বিতীয় শীর্ষ সম্মেলনেও যোগ দিয়েছেন।
যে দেশ থেকে আমরা মাত্র কয়েক বছর আগে বিচ্ছিন্ন হয়েছি, সেই দেশেও তিনি গিয়েছেন, শুধু আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে এদেশের স্বীকৃতি আদায়ের জন্য। অনেকে এর সমালোচনাও করেন; কিন্তু বঙ্গবন্ধুর উদ্দেশ্য ছিল আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে আগে বাংলাদেশকে দাঁড় করানো। তার শাসনামলে মাত্র সাড়ে তিন বছর সময়ে জাতির পিতা বাংলাদেশকে ১১৬টি দেশের স্বীকৃতি এবং জাতিসংঘসহ ২৭টি আন্তর্জাতিক সংস্থার সদস্যপদ লাভ করিয়ে দিয়ে গেছেন।
মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসে পরিবহন ব্যবস্থা প্রায় সম্পূর্ণভাবেই বিধ্বস্ত হয়ে পড়ে। এর ফলে মুক্তিযুদ্ধ-উত্তর অর্থনীতি প্রায় অচল হয়ে পড়ে। খাদ্যশস্য, শিল্পে ব্যবহৃত কাঁচামাল, কৃষিজাত দ্রব্য এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র আমদানি ও বিতরণ প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। এমন এক পরিস্থিতিতে বঙ্গবন্ধু পুনর্গঠন কাজে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে বন্দরের সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা, নৌপরিবহন উন্নয়ন এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে ক্ষতিপূরণের উদ্যোগ নেন এবং বেসামরিক বিমান চলাচল শুরুর ওপর গুরুত্ব দেন। মুক্তিযুদ্ধে বিদ্যুৎ ব্যবস্থাও ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
বহু স্থানে উৎপাদন, বিতরণ ও সরবরাহ সম্পূর্ণভাবে বিধ্বস্ত হয়। দ্রুত সময়ের মধ্যে বঙ্গবন্ধু ট্রান্সমিশন ও বিতরণ লাইন নির্মাণের মাধ্যমে বিদ্যুৎ ব্যবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠার কাজে জোর দেন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, এ দুটি বিষয় যদি ঠিক না থাকে তাহলে একদিকে যেমন খাদ্য উৎপাদন করলেও সাপ্লাই চেইনের কারণে তা মানুষের কাছে পৌঁছাবে না, অন্যদিকে বিদ্যুৎ উৎপাদন এবং সঠিকভাবে বিতরণ করা না গেলে শিল্প-কারখানা, শিক্ষা কোনোটাই হবে না।
মুক্তিযুদ্ধের সময় কৃষি খাত মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এ খাতে যে ক্ষয়ক্ষতি হয়, প্রাথমিক হিসাব অনুযায়ী তার পরিমাণ সেই সময়ের টাকায় প্রায় ৩৭৯ কোটি ৫ লাখ। যুদ্ধবিধ্বস্ত এ দেশে যাতে একজন মানুষও না খেয়ে মারা না যায়, সেজন্য নানা ব্যবস্থা নিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। খাদ্য উৎপাদনে সবচেয়ে বেশি ভর্তুকি দিয়েছিলেন। চাষাবাদের ক্ষেত্রে নতুন যান্ত্রিক পদ্ধতি প্রবর্তনের লক্ষ্য স্থির করেন। কৃষি উৎপাদন বাড়াতে কৃষকের মাঝে সার, ওষুধপত্র ও উন্নতমানের বীজ প্রদান করেন। ১৯৭৩ সালে প্রতিষ্ঠা করেন বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল। এ প্রতিষ্ঠান জাতীয় প্রয়োজনের প্রতি লক্ষ রেখে কৃষিবিষয়ক ইন্সটিটিউট এবং সহযোগী সংগঠনগুলোর মাধ্যমে কৃষি সংক্রান্ত গবেষণা, পরিকল্পনা পরিচালনা, সমন্বয়, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন করে যাচ্ছে।
বঙ্গবন্ধু বুঝতে পেরেছিলেন, জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার উন্নয়নের অন্তরায়। তাই তখনই তিনি পরিবার পরিকল্পনার ওপর জোর দিয়েছিলেন। দেশের ১২ থানায় জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির পাইলটিং শুরু করেছিলেন তিনি। আমরা এখন সাত শতাংশের উপরে প্রবৃদ্ধি নিয়ে কথা বলি। অথচ বঙ্গবন্ধুর সময়ই বাংলাদেশে প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৭ দশমিক ৮ শতাংশ। তিনি তখনই বলতেন, বাংলাদেশ চিরদিন অনুন্নত থাকতে পারে না। অচিরেই উন্নত দেশের কাতারে যাবে।
শুধু জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি নেননি; এ জনসংখ্যাকে শিক্ষিত ও দক্ষ মানবসম্পদে পরিণত করার পরিকল্পনাও নিয়েছেন। সেজন্য তিনি জাতীয় শিক্ষা কমিশন গঠন করেন। স্কুল ও কলেজগুলোকে জাতীয়করণ করেন। উচ্চশিক্ষার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন গঠন করেন এবং ১৯৭০ সালেই তিনি বলেছিলেন, আমাদের শিক্ষা-স্বাস্থ্যে গুরুত্ব দিতে হবে। আমাদের মেডিকেল কলেজ এবং মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে তুলতে হবে। কারিগরি শিক্ষার দিকে জোর দিতে হবে।
১৯৭১ সালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ধ্বংসলীলায় শিল্পক্ষেত্রে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ৪০ কোটি টাকার বেশি। কাঁচামাল, বস্তুগত অবকাঠামো ও যন্ত্রপাতি এ ধ্বংসলীলার শিকার হয়। সরকারি খাতের অন্তর্গত পাটশিল্প, শিপইয়ার্ড ও ডিজেল প্লান্ট ইত্যাদির পুনর্গঠন ও পুনর্নির্মাণ অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়ে। এছাড়া বেসরকারি খাতের হাজার হাজার কুটিরশিল্প ধ্বংস হয়ে যায় যুদ্ধের ধ্বংসলীলায়।
এ ক্ষতি পূরণের জন্য জাতির পিতা নিরবচ্ছিন্নভাবে কাঁচামাল ও খুচরা যন্ত্রপাতি জোগানের লক্ষ্যমাত্রা স্থির করেন। তিনি ১৯৭২-৭৩ সালের লক্ষ্যমাত্রা স্থির করেন ৫৭৩ কোটি ৮১ লাখ টাকা। এ লক্ষ্য অর্জনের জন্য তিনি ফ্যাক্টরি, মেশিনপত্র, গুদাম ইত্যাদি মেরামতের জন্য দীর্ঘমেয়াদি ঋণদান, মূলধন বিনিয়োগে ‘ইকুইটি’ সহযোগিতা, কাঁচামাল ক্রয়, কারখানা চালু রাখতে ব্যয় সংকুলানের জন্য চলতি মূলধন বাবদ স্বল্পমেয়াদি ঋণ, আমদানিকৃত ও স্থানীয় কাঁচামাল নিয়মিত সরবরাহ, সেক্টরভিত্তিক সংস্থাগুলোর অধীনস্থ কলকারখানা ও উৎপাদন যন্ত্রগুলো সক্রিয় করার ব্যবস্থা করেন।
বিজ্ঞানবিষয়ক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতেও তিনি গভীর গুরুত্ব দিয়েছেন। আণবিক শক্তির শান্তিপূর্ণ ব্যবহারের মাধ্যমে জনস্বাস্থ্য, খাদ্য, কৃষি, শিক্ষা, শিল্পসহ জাতীয় অর্থনীতির বিভিন্ন খাতকে সহায়তা করার কথা ভেবে বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালে এবিষয়ক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার জন্য কর্মকর্তা নিয়োগ দেন। ১৯৭৩ সালে প্রতিষ্ঠা করেন বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশন। বঙ্গবন্ধুর প্রতিষ্ঠিত এ প্রতিষ্ঠান বর্তমানে দেশের বৃহত্তম বিজ্ঞান গবেষণা প্রতিষ্ঠান।
বাংলাদেশে বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণার উন্নয়ন, প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও প্রয়োগ এবং বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার ও শিল্প প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে তিনি ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশ কাউন্সিল অব সায়েন্টিফিক অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল রিসার্চ (বিসিএসআইআর) গঠন করেন। শুরুতেই ঢাকায় কেন্দ্রীয় গবেষণাসহ চট্টগ্রাম ও রাজশাহীতে আঞ্চলিক গবেষণাগার প্রতিষ্ঠা করেন। মুক্তিযুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের জন্য গৃহনির্মাণের কাজে তিনি হাত দিয়েছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন তার দেশের একজন মানুষও যাতে গৃহহীন না থাকে। তাই তিনি ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের জন্য গৃহনির্মাণ, পুনর্বাসন ও পুনর্গঠনে মনোযোগ দেন।
এছাড়া মাত্র সাড়ে তিন বছর সময়ে এদেশের প্রত্যেক মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে বিদ্যুৎ, কৃষি ও সমবায়, শিল্প ও বিজ্ঞান, গৃহনির্মাণ, অর্থনীতি ও বাণিজ্য ব্যবস্থাপনা, শিল্প ব্যবস্থাপনা জাতীয়করণ, শিক্ষা ও সংস্কৃতি, প্রযুক্তি, ভূমি ব্যবস্থাপনাসহ নানা কার্যক্রম বাস্তবায়ন করেছিলেন তিনি। আজও এ দেশে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে কোনো কাজ করতে গেলে আমরা দেখতে পাই হয় প্রতিষ্ঠানটি জাতির পিতা নির্মাণ করে দিয়ে গেছেন, না হয় প্রতিষ্ঠানটির যে প্রাতিষ্ঠানিক প্রক্রিয়ায়জাত করা হয়েছে তার শুরুটা জাতির পিতা করে দিয়ে গেছেন। তিনি অসংখ্য নীতি, পরিকল্পনা ও আইনের উদ্যোক্তা।
মাত্র সাড়ে তিন বছরের মধ্যে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ও চিকিৎসাবিজ্ঞানের সব ক্ষেত্রে একটি শক্ত নীতিমালা, পরিকল্পনা, অবকাঠামো রেখে গেছেন। ১৯৭২-এর ৮ অক্টোবর বঙ্গবন্ধু তৎকালীন আইপিজিএমআরে (বর্তমানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়) কেন্দ্রীয় রক্ত পরিসঞ্চালন বিভাগ ও নতুন মহিলা ওয়ার্ড উদ্বোধন করেন। অন্যসব ক্ষেত্রের মতো যুদ্ধের সময় সরকারি-বেসরকারি আবাস ও সম্পত্তির ব্যাপক ক্ষতি হয়। এ সমস্যা সমাধানে বঙ্গবন্ধু পুনর্গঠন কাজকে ১০টি সেক্টরে ভাগ করেন এবং প্রত্যেক সেক্টরের জন্য অর্থ বরাদ্দ দেন।
অধ্যাপক ড. মুনাজ আহমেদ নূর : উপাচার্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ডিজিটাল ইউনিভার্সিটি, বাংলাদেশ