সরকারি-বেসরকারি সব নিবন্ধিত সংস্থাকে করের আওতায় এনে তাদের আয়কর রিটার্ন নিশ্চিত করার পাশাপাশি যেসব প্রতিষ্ঠানের জাল অডিট রিপোর্ট দিচ্ছে তাদের ধরতে মাঠে নেমেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। এ জন্য এরই মধ্যে একটি উচ্চ পর্যায়ের টাস্কফোর্স গঠন করা হয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, এ কার্যক্রমের প্রাথমিক উদ্যোগ হিসেবে যেসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে জাল অডিট রিপোর্ট জমা দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে, তাদের তালিকা তৈরির কাজ ওই বিশেষ টিম এরই মধ্যে শুরু করেছে। একই সঙ্গে টিআইএন থাকা সত্ত্বেও যেসব প্রতিষ্ঠান রিটার্ন জমা দিচ্ছে না তাদের শনাক্ত করার জন্য প্রয়োজনীয় নথি সংগ্রহ করা হচ্ছে।
এনবিআরের অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ৫৬ শতাংশেরও বেশি প্রতিষ্ঠানের কর শনাক্তকরণ নাম্বার বা টিআইএন নেই। আবার টিআইএন থাকার পরও ৫৫ শতাংশেরও বেশি প্রতিষ্ঠান আয়কর দেয় না। আয়কর রিটার্নের সঙ্গে ‘ফিন্যান্সিয়াল অডিট রিপোর্ট’ জমা দেওয়া বাধ্যতামূলক হওয়ায় ৫০ শতাংশেরও বেশি প্রতিষ্ঠান আয়কর ফাঁকি দিতে জাল বা ভুয়া অডিট রিপোর্ট জমা দিচ্ছে।
রেজিস্ট্রার অব জয়েন্ট স্টক কোম্পানিজ অ্যান্ড ফার্মসের (আরজেএসসি) তথ্যানুসারে, ২০২০ সালের জুলাই পর্যন্ত মোট ১ লাখ ৭৯ হাজার ৪৬৪টি সরকারি-বেসরকারি কোম্পানি আরজেএসসি থেকে নিবন্ধন নিয়েছে। এনবিআর বলছে, এর মধ্যে কেবল ৭৮ হাজার প্রতিষ্ঠানের টিআইএন রয়েছে। আর ১ লাখ ১ হাজার ৪৬৫টি প্রতিষ্ঠানের কোনো টিআইএন নেই। আরজেএসসিতে নিবন্ধিত জুলাই পর্যন্ত লিমিটেড, পার্টনারশিপ, সোসাইটিসহ মোট প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ২ লাখ ৪৫ হাজার ৬৫৫টি। এনবিআর বলছে, টিআইএন থাকা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে গড়ে ৩৫ হাজার সংস্থা আয়কর রিটার্ন দাখিল করে। আয়কর আইন অনুসারে, আয়কর রিটার্ন জমা দেয়ার সময় নিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদন জমা দেওয়া বাধ্যতামূলক।
এনবিআরের কর্মকর্তারা বলেন, ভুয়া তথ্য ও পরিসংখ্যান দিয়ে তৈরি করা জাল অডিট রিপোর্টের কারণে কোম্পানিগুলোর প্রকৃত আয়ের চিত্র পাওয়া যায় না। মূলত কর ফাঁকি দেয়ার জন্য এসব প্রতিষ্ঠান এমন অনৈতিক কাজ করে। এতে সরকার বিপুল অঙ্কের রাজস্ব হারাচ্ছে। ওই কর্মকর্তা আরও জানান, যেসব প্রতিষ্ঠান ভুয়া অডিট রিপোর্ট জমা দেয় তাদের ধরতে ২০১৫ সালেই একবার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। বাংলাদেশ ব্যাংক, রেজিস্ট্রার অব জয়েন্ট স্টক কোম্পানিজ অ্যান্ড ফার্মস (আরজেএসসি) ও বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনসহ (বিএসইসি) সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর সহায়তায় ভুয়া অডিট রিপোর্ট চিহ্নিত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়। তবে যে কারণেই হোক এখনও ভুয়া অডিট রিপোর্ট জমা দেওয়া বন্ধ হয়নি।
বিভিন্ন কোম্পানির অডিট রিপোর্ট করে থাকেন এমন এক চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট নাম প্রকাশ না করে বলেন, আরজেএসসি থেকে নিবন্ধন নেওয়া কোম্পানির সংখ্যা দুই লাখের ওপরে। অথচ এসব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে মাত্র ৫৫ হাজার আয়কর রিটার্ন দেয়। আবার যেসব কোম্পানি রিটার্ন জমা দেয় তাদের বেশিরভাগ ভুয়া অডিট রিপোর্ট। অপরদিকে যোগ্যতাসম্পন্ন চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টরা যে অডিট রিপোর্ট অনুমোদন করেন তার মান নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে।
ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) এক পরিচালক জানান, একটি কোম্পানির ব্যালেন্স শিট অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ব্যালেন্স শিট দেখেই কোম্পানির বাস্তব চিত্র পাওয়া যায়। কিন্তু আমাদের বাজারে সৎ ও শক্তিশালী ব্যালেন্স শিটের সমস্যা রয়েছে। এ কারণে দুর্বল কোম্পানি পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হচ্ছে। অডিটররা কীভাবে এসব ব্যালেন্স শিট অনুমোদন করছেন তা ভেবে দেখা উচিত বলে মনে করেন তিনি।
এফআরসি’র সূত্রে জানা গেছে, দেশে বর্তমানে কোয়ালিফাইড অ্যাকাউন্ট্যান্ট আছেন তিন হাজার ১২২ জন। তাদের বাইরে কেউ অডিট রিপোর্ট সই করার যোগ্যতা রাখেন না। তাদের তথ্য অনুযায়ী, কোয়ালিফাইড অ্যাকাউন্ট্যান্টরা বছরে ২২ হাজারের মতো কোম্পানির অডিট রিপোর্ট করে থাকেন। অথচ এনবিআরের কাছে রিটার্ন জমা দেয় ৫৫ হাজার কোম্পানি। তাহলে বাকি ৩৩ হাজার কোম্পানির অডিট রিপোর্ট কারা সই করেন, এটা বুঝতে বিশেষজ্ঞ হওয়ার প্রয়োজন পড়ে না বলে মনে করে এফআরসি।
ফাইন্যান্সিয়াল রিপোর্টিং কাউন্সিলের (এফআরসি) সূত্রে জানা গেছে, শুধুমাত্র কোয়ালিফাইড অ্যাকাউন্ট্যান্টরাই অডিট রিপোর্টে সই করতে পারেন। তারা ছাড়া কারও অডিট রিপোর্ট অনুমোদন করার ক্ষমতা নেই। কোন কোন প্রতিষ্ঠান ভুয়া অডিট রিপোর্ট দিচ্ছে তা এনবিআরের জন্য ধরা খুবই সহজ। কোয়ালিফাইড অ্যাকাউন্ট্যান্টরা কোন কোন প্রতিষ্ঠানের অডিট রিপোর্ট দিয়েছেন তা তো উন্মুক্ত। সুতরাং তাদের তালিকার সঙ্গে রিটার্ন জমা দেওয়া প্রতিষ্ঠানগুলোর তালিকা এনবিআর মিলিয়ে দেখলেই সহজে বুঝা যাবে কারা অনিয়ম করছে।