স্বাস্থ্য খাতের মাফিয়ারা এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরেই রয়েছেন। মাঝেমধ্যে আবজাল হোসেনের মতো কিছু চুনোপুিট ধরা পড়ে কারাগারে গেলেও মাফিয়ারা সব সময়ই থাকেন বহাল তবিয়তে। আবজাল যদি কয়েক শ কোটি টাকার মালিক হন, তাহলে তার আশ্রয়দাতা মাফিয়ারা কী পরিমাণ অর্থ লুট করেছেন—এমন প্রশ্ন সবার মুখে মুখে। দুর্নীতির দুষ্টচক্রে পড়েছে স্বাস্থ্য খাত। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দুর্নীতি দেশের চিকিত্সাব্যবস্থাকে নাজুক করে দিচ্ছে।স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, বিভাগীয় পরিচালক (স্বাস্থ্য), জেলা পর্যায়ে সিভিল সার্জন কার্যালয়, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স—এভাবে পুরো স্বাস্থ্যকাঠামোতে গড়ে উঠেছে দুর্নীতিবাজদের শক্তিশালী সিন্ডিকেট। এ কারণে প্রতি বছর স্বাস্থ্য খাতে সরকার বড় অঙ্কের বরাদ্দ দিলেও তার সিংহভাগ লুটেরা চক্রের পকেটে যায় এমন অভিযোগ ওপেন সিক্রেট। দুর্নীতির নিকৃষ্ট জীবেরা যে স্বাস্থ্যব্যবস্থা পঙ্গু করে ফেলেছে, সেই সত্য স্পষ্ট হয়ে উঠেছে করোনাকালে। প্রতারণার আখড়া ভুয়া হাসপাতালকে করোনা টেস্ট ও চিকিত্সার অনুমতি দেওয়ার কৃতিত্বও দেখিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে জেঁকে বসা আরব্য উপন্যাসে বর্ণিত থিফ অব বাগদাদের চেয়েও বড় চোরেরা। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে আবজালের মতো আরো ২৩ কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছিল দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। কিন্তু আবজাল ছাড়া আর কারোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। বরং এসব দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তার অনেকে পেয়েছেন পদোন্নতি। দুদকে যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল, তাদের একজন পরিচালককে বদলি করে পুরস্কৃত করা হয়েছে। এভাবে দুর্নীতিবাজদের উত্সাহিত করা হচ্ছে। একজন প্রশাসনিক কর্মকর্তা আছেন, তাকে বদলি করা হলেও যান না। কথায় কথায় টাকা পাওয়া যায় বলে এখানে থাকেন। মন্ত্রণালয়ের একশ্রেণির কর্মকর্তা দুর্নীতিতে জড়িত থাকায় তাদের কিছুই হয় না। আর তাই আবজালদের সম্মুখে দেখা যায়। তাদের পেছনে যারা আছেন তাদের দেখা যায় না।
দুদক বলেছে, মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতা ছাড়া স্বাস্থ্য খাতের দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে শাস্তি নিশ্চিত করা সম্ভব হবে না। ১৩ জন শীর্ষ দুর্নীতিবাজকে কালো তালিকাভুক্ত করার জন্য বলা হয়েছিল ৯ মাস আগে। কিন্তু মন্ত্রণালয় ৯ মাস পর্যন্ত তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়নি। করোনাকালের দুর্নীতি সবার নজরে এলে ঐ সব দুর্নীতিবাজের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। মাস্ক, পিপিইসহ বিভিন্ন কেনাকাটায় কাগজপত্র পর্যন্ত নেই।
দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ ইত্তেফাককে বলেন, স্বাস্থ্য খাতের দুর্নীতিবাজদের শাস্তি নিশ্চিতে উপযুক্ত তথ্য-প্রমাণসহ তাদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হবে। কিন্তু মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতা ছাড়া দুর্নীতিবাজদের শাস্তি নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। মন্ত্রণালয় সহযোগিতা না করলে পর্যাপ্ত প্রমাণের অভাবে দুর্নীতিবাজরা ছাড়া পেয়ে যাবেন।
অবৈধ সম্পদ অর্জনের দুই মামলায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মচারী আবজাল হোসেনের জামিন নামঞ্জুর করে কারাগারে পাঠিয়েছে ঢাকার একটি আদালত। আবজাল গতকাল ঢাকা মহানগর জ্যেষ্ঠ বিশেষ জজ কে এম ইমরুল কায়েশের আদালতে আইনজীবী শাহিনুর ইসলামের মাধ্যমে আত্মসমর্পণ করে জামিনের আবেদন করেন। দুদকের পক্ষে মাহমুদ হোসেন জাহাঙ্গীর জামিনের বিরোধিতা করেন। শুনানির একপর্যায়ে বিচারক কাঠগড়ায় দাঁড়ানো আবজালকে তার পদ-পদবি কী জিজ্ঞেস করলে আসামি জানান, তিনি হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা। তখন বিচারক বলেন, ‘আপনি তো কেরানি। তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী, কর্মকর্তা হলেন কী করে? বিচারকের সঙ্গেও মিথ্যা কথা বলেন।’ বিচারকের এ কথায় এজলাসে হাস্যরসের সৃষ্টি হয়। শুনানি শেষে বিচারক জামিন নামঞ্জুর করে তাকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন।
এর আগে গত ২৩ আগস্ট আইনজীবীর মাধ্যমে আদালতে আত্মসমর্পণ করে জামিনের আবেদন দিয়েও তুলে নিয়েছিলেন আবজাল হোসেন। মামলা দুইটির মধ্যে একটিতে আবজাল হোসেন একা এবং অন্যটিতে তার স্ত্রী রুবিনা খানম যৌথভাবে আসামি। গত বছর ২৭ জুন দুদকের উপপরিচালক তৌফিকুল ইসলাম দুদকের সমন্বিত জেলা কার্যালয় ঢাকা-১ এ অবৈধ সম্পদ অর্জন, মুদ্রা পাচার এবং দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনে মামলা দুটি করেন। মামলা দুটিতে আবজাল দম্পতির বিরুদ্ধে ৩৬ কোটি ৩০ লাখ ৬১ হাজার ৪৯৩ টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জন ও ভোগদখলে রাখার অভিযোগ আনা হয়েছে। এছাড়া দীর্ঘ সময় ধরে স্থানান্তর, রূপান্তর ও হস্তান্তরের মাধ্যমে ২৮৪ কোটি ৫১ লাখ ১৩ হাজার ২০৭ টাকা পাচারের অভিযোগও আনা হয়েছে।
বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) মহাসচিব ডা. এহতেশামুল হক চৌধুরী দুলাল বলেন, দুদকে মামলা থাকা অবস্থায় কারোর পদোন্নতি বা বদলি করা যায় না। কিন্তু এখানে সম্ভব হচ্ছে। তিনি বলেন, স্বাস্থ্য খাতে দুর্নীতিতে জড়িতদের শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। একই সঙ্গে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, বিভাগীয় পরিচালক (স্বাস্থ্য), জেলা পর্যায়ে সিভিল সার্জন, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে এই পুরো চেইনকে জবাবদিহিতা করতে হবে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলেন, দুর্নীতিবাজদের কাছে আমরা জিম্মি। ব্যবস্থা নিতে পারি না। এদের ক্ষমতা অনেক বেশি। স্পর্শ করা সম্ভব হয় না। তাদের কাছে আমরা অসহায়।