ফাইলেরিয়া হাসপাতাল নির্মাণে নজিরবিহীন জালিয়াতি

ব্যাংক গ্যারান্টি, পে-অর্ডার, প্রত্যয়নপত্র থেকে শুরু করে ব্যাংক কর্মকর্তার স্বাক্ষর এবং সিলমোহর সবকিছুই জাল। এমনকি ট্রেড লাইসেন্স, নিজের ছবি ও ঠিকানাও ভুয়া।

হাসপাতাল নির্মাণের কাজ পেতে এমন অবিশ্বাস্য জালিয়াতির আশ্রয় নেন সংশ্লিষ্ট ঠিকাদার। চাঞ্চল্যকর ঘটনাটি ঘটেছে সাভারে বিশেষায়িত ফাইলেরিয়া অ্যান্ড জেনারেল হাসপাতালের নির্মাণ কাজে। জালিয়াতির মাধ্যমে কাজ পেয়ে নির্মাণ সমাপ্ত না করেই শতভাগ বিল তুলে চম্পট দেন ঠিকাদার।

গুণধর ঠিকাদারের নাম হাবিবুর রহমান। জালিয়াতির অন্যতম প্রধান সহযোগী তার স্ত্রী নাসিমা আক্তার ওরফে কিরন। রাকাব ট্রেড কর্পোরেশন নামে সাইনবোর্ডসর্বস্ব ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান খুলে হাসপাতাল নির্মাণের কাজ বাগিয়ে নেয়া হয়। সম্প্রতি প্রতারক ঠিকাদারের খোঁজে মাঠে নেমেছে র‌্যাব। বিষয়টি দুদকের শীর্ষ পর্যায়কেও জানানো হয়েছে। প্রসঙ্গত, দুরারোগ্য গোদ রোগের চিকিৎসার জন্য ৫০ শয্যার ফাইলেরিয়া অ্যান্ড জেনারেল হাসপাতাল নির্মাণে প্রায় ১২ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয় সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়।

সরকারের সঙ্গে যৌথ অংশীদারিত্বে হাসপাতালটি নির্মাণের উদ্যোক্তা আইসিএবি (ইন্সটিটিউট অব অ্যালার্জি অ্যান্ড ক্লিনিক্যাল ইমিউনলজি বাংলাদেশ) নামের একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান। রাজধানীর অদূরে সাভারের জিনজিরা এলাকায় নির্মাণাধীন হাসপাতালটিতে বর্তমানে সীমিত পরিসরে রোগীদের চিকিৎসা কার্যক্রম চলছে। ২০১১-১২ সালে হাসপাতাল নির্মাণের কার্যক্রম শুরু হলেও তা এখনও শেষ হয়নি।

উল্লেখ্য, ফাইলেরিয়া একটি মশাবাহিত রোগ। ফাইলেরিয়ার জীবাণুবাহী মশার কামড়ে মানুষের হাত, পা এবং অন্যান্য অঙ্গ অস্বাভাবিক ফুলে যায়। স্থানীয়ভাবে এটিকে গোদ রোগ বলা হয়। বাংলাদেশের ৫৬টি জেলায় গোদ রোগের প্রাদুর্ভাব রয়েছে।

এদিকে ভবন নির্মাণকাজ শেষ করতে দীর্ঘ ৮ বছর ধরে ঠিকাদারের পেছনে ঘুরছে সমাজসেবা কার্যালয় এবং হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। কিন্তু ঠিকাদারের সাড়া মিলছে না। উল্টো মাস্তান বাহিনী দিয়ে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে হুমকি দেয়া হচ্ছে।

অসমাপ্ত নির্মাণকাজ নিয়ে বেশি বাড়াবাড়ি করলে আইএসিআইবি’র চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. মোয়াজ্জেম হোসেনকে সম্প্রতি হত্যার হুমকিও দেয়া হয়। এ পরিপ্রেক্ষিতে হাসপাতাল চত্ব¡রে অতিরিক্ত নিরাপত্তা প্রহরীও বসানো হয়েছে।

সমাজসেবা অধিদফতরের তদন্ত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, হাসপাতালের ভবন নির্মাণ ও মেডিকেল সরঞ্জাম সরবরাহের জন্য ভিন্ন নামে মোট সাতটি প্রতিষ্ঠান দরপত্র জমা দেয়। ভবন নির্মাণের কাজ পায় রাকাব ট্রেড কর্পোরেশন। বাকি প্রতিষ্ঠানগুলো মেডিকেল ও অফিস সরঞ্জাম সরবরাহ করে। কিন্তু তদন্তে উঠে আসে, টেন্ডারে অংশ নেয়া সাতটি প্রতিষ্ঠানের সবগুলোরই মালিক মূলত হাবিবুর রহমান।

একচেটিয়াভাবে সব কাজ পেতে সাইনবোর্ডসর্বস্ব প্রতিষ্ঠান খোলা হয়। রাকাব ট্রেড ছাড়া অন্য প্রতিষ্ঠানগুলো হল- উপকূল ট্রেডার্স, তাহিয়া এন্টারপ্রাইজ, সারা ট্রেড কর্পোরেশন, সাব্বির অ্যান্ড আর্ক কনস্ট্রাকশন, ম্যাক ট্রেডার্স অ্যান্ড করপোরেশন এবং আর আর এন্টারপ্রাইজ। খাতাপত্রে প্রতিষ্ঠানগুলোর ভিন্ন ভিন্ন মালিক দেখানো হলেও প্রতিষ্ঠানগুলোর স্বত্বাধিকারীদের সবাই হাবিবের ভাই, বোন এবং ঘনিষ্ঠ আত্মীয়।

তদন্তে উঠে আসে, ঠিকাদারি কাজের টেন্ডারে অংশ নিতে জাল ব্যাংক গ্যারান্টি জমা দেয়া হয়। ৩০০ টাকার ব্যাংক গ্যারান্টিকে ঘষেমেজে রূপান্তর করা হয় ৩০ লাখে। এছাড়া ৭টি কোম্পানির প্রতিটির বিপরীতে ২০-৩০ কোটি টাকার লেনদেন সংক্রান্ত বিভিন্ন ব্যাংকের সলভেন্সি সার্টিফিকেটও ভুয়া।

এছাড়া ব্যাংক স্টেটমেন্ট, বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের নাম, স্বাক্ষর, ট্রেড লাইসেন্স, ছবি, অডিট রিপোর্ট, প্রতিষ্ঠানের জনবলের তথ্য ও বায়োডাটা, সত্যায়নকারী কর্মকর্তার স্বাক্ষর ও সিল, ট্যাক্স-ভ্যাটের চালানও ভুয়া বলে প্রমাণিত হয়।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, জালিয়াতির মাধ্যমে কাজ পাওয়ার পর ঠিকাদার নানা ধরনের অনিয়ম শুরু করেন। ভবন নির্মাণে নিুমানের সামগ্রী ব্যবহার, নকশাবহির্ভূত কাজ করা এবং এক পর্যায়ে কাজ অসমাপ্ত রেখে শতভাগ বিল তুলে নেন। কিন্তু ব্যাংক গ্যারান্টিসহ আনুষঙ্গিক কাগজপত্র জাল হওয়ার কারণে ঠিকাদাররের কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ আদায় করা সম্ভব হচ্ছে না।

গত ৮ মার্চ সাভার সমাজসেবা কার্যালয় থেকে সরেজমিন তদন্ত করে উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা মোহাম্মদ শিবলীজ্জামান প্রতিবেদন জমা দেন। এতে বলা হয়, টেন্ডার সিডিউল অনুযায়ী হাসপাতালের অনেক কাজ এখনও অসমাপ্ত। এর মধ্যে সীমানাপ্রাচীর, প্রধান ফটক, বেইজমেন্ট, হাসপাতাল ভবনের সামনে জায়গা পাকাকরণসহ অনেক কাজ করা হয়নি।

এছাড়া ৬০টি শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র (এসি), ৩৩৬টি সিলিং ফ্যান সরবরাহ করা হয়নি। এছাড়া টাইলস, মোজাইক, দেয়াল ও দরজার রংসহ সব মিলয়ে প্রায় ৫ কোটি টাকার কাজ এখনও বাকি।

সরেজমিন হাসপাতাল ভবনে গিয়ে দেখা যায়, ১১ তলা ভিত্তির ওপর নির্মানাধীন ভবনের ৪ তলা পর্যন্ত কাজ শেষ হয়েছে। প্রতিদিন ১ থেকে দেড়শ’ জন রোগী বহির্বিভাগে চিকিৎসা নিচ্ছেন। বেশ কিছু জটিল রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসাধীন। যাদের বেশির ভাগই ফাইলেরিয়া এবং থেলাসেমিয়া আক্রান্ত। কিন্তু ভবনের সীমানা প্রাচীর না থাকায় রোগী ও চিকিৎসা সরঞ্জামের যথাযথ নিরাপত্তা নিশ্চিত হচ্ছে না।

ইতোমধ্যে ভবনসহ যেটুকু কাজ শেষ করা হয়েছে তা খুবই নিুমানের। দেয়াল এবং ছাদে ফাটল ধরেছে। হাসপাতালের সামনের খোলা চত্বরে গজিয়ে উঠেছে আগাছা। টিনের প্রধান ফটকটি জং ধরে খসে পড়ার উপক্রম। বাইরে থেকে যে কেউ এসে দেখলে পরিত্যক্ত হাসপাতাল বলে মনে করবে। অথচ দেশের অন্য কোথাও ফাইলেরিয়ার উন্নত চিকিৎসা না থাকায় সারা দেশ থেকেই এখানে রোগী এসে ভর্তি হন।

জাতীয় শীর্ষ সংবাদ