নগদ লেনদেনের ধারণা পাল্টে দেয়ার কথা বলে বাজারে এসেছিল দেশের প্রথম অনলাইন পেমেন্ট সার্ভিস প্রোভাইডার (পিএসপি) ‘আইপে সিস্টেমস লিমিটেড’। বেশ হাঁকডাক দিয়েই শুরু হয়েছিল প্রতিষ্ঠানটির কার্যক্রম। বিনিয়োগও হয়েছিল ৭০ কোটি টাকার বেশি। কিন্তু আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরুর তিন বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই মুখ থুবড়ে পড়েছে ‘আইপে’।
এরই মধ্যে প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) জাকারিয়া স্বপনের সঙ্গে বিনিয়োগকারীদের টানাপড়েন শুরু হয়েছে। ধারাবাহিক লোকসান দেয়া প্রতিষ্ঠানটির বেশির ভাগ কর্মী চাকরিচ্যুত হয়েছেন। নিয়মিত বেতন-ভাতা পাচ্ছেন না চাকরিতে বহাল থাকা কর্মীরাও। স্থবিরতা নেমে এসেছে প্রতিষ্ঠানটির কার্যক্রমে। ঘুরে দাঁড়াতে বিনিয়োগকারীরা নতুন সিইও খুঁজছেন।
অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে প্রতিষ্ঠানটিকে নতুনভাবে ঢেলে সাজানোর পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন আইপের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. শহিদুল আহসান। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, আইপের সিইও ভালো পড়েনি। তার উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনা ও বিপুল অপব্যয়ের কারণে প্রতিষ্ঠানটি এগোতে পারেনি। বিনিয়োগকারী হিসেবে আমরা ৭০-৮০ কোটি টাকা তাকে দিয়েছি। কিন্তু এ অর্থের যথার্থ ব্যবহার হয়নি। এ অবস্থায় আমরা আইপেকে নতুন করে ঢেলে সাজানোর পরিকল্পনা নিয়েছি। শিগগিরই প্রতিষ্ঠানটিতে নতুন সিইও নিয়োগ দেয়া হবে। গ্রাহকদের উদ্দেশে আমাদের বার্তা হলো, ‘আইপে’ আবারো নব উদ্যমে কার্যক্রম শুরু করবে।
দেশের প্রথম ডিজিটাল ওয়ালেট সার্ভিস হিসেবে আইপের যাত্রা হয়েছিল ২০১৫ সালে। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই এর সিইও হিসেবে দায়িত্বে ছিলেন প্রযুুক্তিবিদ জাকারিয়া স্বপন। এতে বড় বিনিয়োগ করেছিল আহসান গ্রুপ, আরএসআরএম এবং বস্ত্র ও পোশাক খাতের প্রতিষ্ঠান দিশারী। আইপের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদে দায়িত্ব নেন আহসান গ্রুপের কর্ণধার মো. শহিদুল আহসান। ২০১৮ সালে আইপের উপদেষ্টা হিসেবে যোগ দেন এনসিসি ও মেঘনা ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মোহাম্মদ নুুরুল আমিন। প্রতিষ্ঠানটির দুর্দশা দেখে এরই মধ্যে পদত্যাগও করেছেন তিনি।
এ প্রসঙ্গে নুরুল আমিন বণিক বার্তাকে বলেন, দেশে করোনাভাইরাস সংক্রমণের পর থেকে আমি বাসায় ছিলাম। জুন পর্যন্তও আমি আইপের কোনো কাজে লাগছিলাম না। এজন্য পদত্যাগ করেছি। আমি আইপেতে যোগদানের বহু আগেই প্রতিষ্ঠানটির কেনাকাটা থেকে শুরু করে সব ধরনের পরিকল্পনা তৈরি হয়েছিল। আমার কাজ ছিল করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে চুক্তিসহ সম্প্রসারণের বিষয়ে পরামর্শ দেয়া। আমার দায়িত্ব আমি পালন করার চেষ্টা করেছি। তবে শেষ পর্যন্ত আইপে প্রত্যাশা অনুযায়ী সাফল্য পায়নি।
নগদ অর্থ ছাড়াই যেকোনো ধরনের লেনদেন, বিল পরিশোধ, বিভিন্ন ব্যাংক অ্যাকাউন্টে টাকা পাঠানো, কাউকে টাকার অনুরোধ পাঠানো, ইউটিলিটি বিল, মোবাইল টপআপসহ বিভিন্ন ধরনের সেবা দেয়ার লক্ষ্য নিয়ে যাত্রা আইপের। তিন বছর পরীক্ষামূলকভাবে চলার পর এর আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরু হয় ২০১৮ সালের মার্চে। ২০১৮ সালের ২১ মার্চ বড় আয়োজনে আইপের উদ্বোধন করেন সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত।
শুরুতে বেশ আলোচনায় এসেছিল আইপে। কিন্তু আড়াই বছরেও ব্যবসায়িক সাফল্য না আসায় প্রতিষ্ঠানটির সিইও জাকারিয়া স্বপনের সঙ্গে বিনিয়োগকারীদের টানাপড়েন শুরু হয়েছে। এ পরিস্থিতিতে বিনিয়োগকারীরা নতুন সিইও খোঁজার তথ্য দিলেও জাকারিয়া স্বপন বলছেন ঠিক উল্টোটা। আইপেতে বিনিয়োগ করার জন্য নতুন বিনিয়োগকারী খোঁজা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন তিনি। এ বিষয়ে বণিক বার্তাকে জাকারিয়া স্বপন বলেন, নানা কারণে আমরা পরিকল্পনা অনুযায়ী চলতে পারিনি। বাংলাদেশ এখনো মোবাইল ওয়ালেটভিত্তিক লেনদেনের জন্য উপযুক্ত হয়ে ওঠেনি। এজন্য অনেক পরিকল্পনা যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। প্রতিষ্ঠানের কর্মী সংখ্যা কমিয়ে আনা হয়েছে। তবে বর্তমান পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য আমরা নতুন বিনিয়োগকারী খুঁজছি। নতুন বিনিয়োগ পেলে আইপে ঘুরে দাঁড়াবে।
আনুষ্ঠানিক যাত্রার পর অ্যাপল বা গুগল প্লে স্টোর থেকে ১০ লাখের বেশি আইপে অ্যাপটি ডাউনলোড করা হয়েছে বলে প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে দাবি করা হয়। সেই সঙ্গে দেশের ৩ হাজার ৫০০ ব্যবসা ও ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি হয়েছে বলেও জানিয়েছেন আইপের চেয়ারম্যান। আইপের সঙ্গে চুক্তি হয় দেশের ৫৭টি বাণিজ্যিক ব্যাংকেরও।
আইপের সঙ্গে চুক্তি করা একাধিক ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহী বণিক বার্তাকে বলেন, নানা কারণে আইপের সঙ্গে চুক্তি হয়েছিল। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটির ওয়ালেটের মাধ্যমে ব্যাংকের গ্রাহকদের লেনদেন খুবই কম। একটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, আমরা ভুলেই গেছি যে আইপে নামের একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি হয়েছিল।
প্রযুক্তির আধুনিকায়নের ফলে বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয়তা পেয়েছে ই-ওয়ালেট। যখন তখন ব্যাংক হিসাব থেকে অর্থ স্থানান্তরসহ যাবতীয় কেনাকাটায় ই-ওয়ালেট ব্যবহূত হয়। বাংলাদেশে ই-ওয়ালেট সেবা দেয়ার জন্য পেমেন্ট সার্ভিস প্রোভাইডার হিসেবে লাইসেন্স নিতে হয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে। দেশের প্রথম পিএসপি প্রতিষ্ঠান হিসেবে আইপেকে লাইসেন্স দেয়া হয়েছিল। এরপর আরো দুটি প্রতিষ্ঠানকে পিএসপি লাইসেন্স দেয়া হয়। বর্তমানে পিএসপি হিসেবে সেবা দেয়া অন্য প্রতিষ্ঠান হলো ‘ডি মানি বাংলাদেশ লিমিটেড’। সম্প্রতি কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ‘রিকারশন ফিনটেক লিমিটেড-কে পিএসপি লাইসেন্স দেয়া হয়। ‘ক্যাশ বাবা’ নামে প্রতিষ্ঠানটি ই-ওয়ালেট সেবা দেবে।
তবে দেশের ব্যাংকগুলো বর্তমানে নিজেরাই অ্যাপস বা ওয়ালেট নিয়ে আসছে। ব্যাংকগুলো নিজেদের গ্রাহকদের অনলাইনভিত্তিক লেনদেন সেবা দেয়ার জন্য অ্যাপস চালু করছে। সে হিসেবে পেমেন্ট সার্ভিস প্রোভাইডার প্রতিষ্ঠানের জনপ্রিয়তা ও চাহিদা কমে আসছে গ্রাহকদের কাছে। এছাড়া যখন তখন অর্থ লেনদেনের জন্য দেশে বর্তমানে জনপ্রিয়তার শীর্ষে আছে মোবাইল ব্যাংকিং সেবা। বর্তমানে মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস (এমএফএস) হিসেবে দেশে কার্যক্রম পরিচালনা করছে ১৫টি ব্যাংক বা ব্যাংকের সবসিডিয়ারি প্রতিষ্ঠান। মোবাইল ব্যাংকিংয়ে গ্রাহকসংখ্যা ৯ কোটি ২৯ লাখ। আগস্টে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে ৪১ হাজার কোটি টাকার বেশি লেনদেন হয়েছে।