বাণিজ্যিক বিজ্ঞাপনের জন্য বেসরকারি খাতে ১০৬৭টি এলইডি বিলবোর্ড বরাদ্দ দিয়ে প্রায় ১৮৭ কোটি টাকার রাজস্ব গচ্চা দিয়েছে ডিএসসিসি। বার্ষিক ২০ হাজার টাকা মূল্যের প্রতি বর্গফুট বোর্ড বরাদ্দ দিয়েছে আটশ’ টাকায়। এহারে ২০১৬-১৭ থেকে ২০১৯-২০ অর্থবছর পর্যন্ত রাজস্ব আদায় হয়েছে। এতেই চার অর্থবছরে এই বিপুল অংকের অর্থ হারিয়েছে সংস্থাটি।
অভিযোগ উঠেছে ঢাকা দক্ষিণ সিটির তৎকালীন প্রভাবশালীরা এর সঙ্গে জড়িত। তারা নিজস্ব লোকজনকে অনির্দিষ্টকালের মেয়াদে বিলবোর্ডগুলো বরাদ্দ দেয়। এসব করতে গিয়ে ক্ষমতাধর চক্রটি বিধি ভেঙেছে। কৌশলে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের এ সংক্রান্ত অনুমোদন এড়িয়ে গেছে।
এরাই টাকাগুলো পকেটে পুরেছে। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) এ বিষয়ে তদন্তে মাঠে নেমেছে। সম্প্রতি ডিএসসিসির সাবেক প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তাকে দুদকে ডেকে এ বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে।
জানা যায়, ডিএসসিসির বরাদ্দকৃত এলইডি বিলবোর্ডের মোট আয়তন ২৪ হাজার ৩৩৭ বর্গফুট। বিধিমোতাবেক প্রতি বর্গফুট এলইডির ভাড়া ২০ হাজার টাকা। এই দামে প্রতি বছর ভাড়া আদায় হওয়ার কথা ৪৮ কোটি ৬৭ লাখ ৪০ হাজার টাকা।
সে হিসেবে চার অর্থবছরে ডিএসসিসির কোষাগারে জমা হওয়ার কথা ১৯৪ কোটি ৬৯ লাখ ৬০ হাজার টাকা। কিন্তু গত চার বছরে জমা হয়েছে সাত কোটি ৭৮ লাখ ৬৮ হাজার ৮০০ টাকা। এতে ডিএসসিসির গচ্চা গেছে ১৮৬ কোটি ৯০ লাখ ৯১ হাজার ২০০ টাকা।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, চলতি অর্থবছর ডিএসসিসির রাজস্ব বিভাগ থেকে বিধিমোতাবেক প্রতি বর্গফুট ২০ হাজার টাকা ভাড়া পরিশোধ করতে ইজারাদারদের চিঠি দেয়া হয়েছে।
তবে এসব চিঠিতে চার বছরের অপরিশোধিত ভাড়া দেয়ার ব্যাপারে কিছু বলা হয়নি। ডিএসসিসির রাজস্ব বিভাগ কীভাবে বিশাল অঙ্কের এ আর্থিক ক্ষতি মেনে নেয় এটা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
এ প্রসঙ্গে ডিএসসিসির প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা আরিফুল হক যুগান্তরকে বলেন, ‘বিধিমালা অনুযায়ী এলইডি স্ক্রিন বলে কিছু নেই। আমি দায়িত্ব গ্রহণের আগে এ বিভাগ থেকে এলইডি সাইনকে এলইডি স্ক্রিন বলে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। বিধিমালার চেয়ে অনেক কম মূল্যে ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছে। অনেকে সেসব ভাড়াও পরিশোধ করেনি।’
তিনি আরও বলেন, ‘চলতি অর্থবছর বিধিমালা মোতাবেক এলইডি স্ক্রিনকে এলইডি সাইন হিসেবে ঘোষণা করে প্রতি বর্গফুট ২০ হাজার টাকা করে ভাড়া নির্ধারণ করে সংশ্লিষ্টদের চিঠি দেয়া হয়েছে। এরপর ওইসব প্রতিষ্ঠান নিজেদের বিজ্ঞাপন বোর্ডগুলো সরিয়ে নিয়েছে। তাদের কাছ থেকে বকেয়া আদায়ের চেষ্টা চলছে। অনেককে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।’
এ বিষয়ে এলইডি বরাদ্দ সংক্রান্ত কমিটির সদস্য ও ডিএসসিসির সিস্টেম এনালিস্ট মো. আবু তৈয়ব রোকন যুগান্তরকে বলেন, ‘বিধিমালায় এলইডি স্ক্রিন না থাকায় টেকনিক্যাল কমিটি গঠন করা হয়। ওই কমিটির সুপারিশে এসব বরাদ্দ দেয়া হয়।’ এলইডি সাইনকে কেন এলইডি স্ক্রিন দেখিয়ে ডিএসসিসির রাজস্ব ক্ষতির সুপারিশ করা হল- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এগুলো আমাদের কমিটির সিদ্ধান্ত ছিল। তবে সেটা মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনক্রমে বাস্তবায়ন করার কথা ছিল। পরে কী হয়েছে আমার ভালো জানা নেই।’
এ প্রক্রিয়ার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ডিএসসিসির এক কর্মকর্তা জানান, ‘তৎকালীন শীর্ষ কর্তাকে তুষ্ট রাখতে অনেক কর্মকর্তা মরিয়া ছিলেন। কোনো কিছুর প্রতি তিনি আগ্রহ প্রকাশ করামাত্রই তারা সেটা বাস্তবায়ন করতেন। এ ক্ষেত্রে আইনের কোনো তোয়াক্কা করা হতো না। এলইডি বিলবোর্ড বরাদ্দের ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটেছে।’ সে সময় মন্ত্রণালয় বিধিমালা লঙ্ঘন করে ভাড়া কমানোর প্রস্তাব অনুমোদনও করেনি। কিন্তু ডিএসসিসি মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন ছাড়াই কম ভাড়া কার্যকর করেছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, ডিএসসিসির বর্তমান মেয়র দায়িত্ব গ্রহণের আগে বিশেষ ব্যক্তিদের এলইডি সাইনকে এলইডি স্ক্রিন দেখিয়ে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। এসব বরাদ্দের আগে নিয়মানুযায়ী বিধিমালা সংশোধন করার কথা। কিন্তু সেটা না করে টেকনিক্যাল কমিটি গঠনের মাধ্যমে তাদের মতের ভিত্তিতে এটা করা হয়েছে।
এ বিষয়ে একটি গোয়েন্দা সংস্থা বিস্তারিত অনিয়ম তুলে ধরে সরকারের উচ্চপর্যায়ে প্রতিবেদন দেয়। তখন ডিএসসিসির পক্ষ থেকে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে বিধি ভেঙে বরাদ্দ দেয়া এলইডির বর্গফুটপ্রতি ভাড়া কমানোর প্রস্তাব পাঠায়। এতে স্থানীয় সরকার বিভাগ থেকে কোনো সাড়া পায়নি ডিএসসিসি। পরে ডিএসসিসি আবারও স্থানীয় সরকার বিভাগে একই প্রস্তাব পাঠায়। তখনও কোনো সাড়া দেয়নি মন্ত্রণালয়। এরপর চুপ হয়ে যায় ডিএসসিসি। কিন্তু তারা বিধি অনুযায়ী প্রতি বর্গফুটের ভাড়া ২০ হাজার টাকা আদায়ও করেনি।
অপর এক কর্মকর্তা বলেন, এলইডি বিলবোর্ডগুলো বরাদ্দের চিঠিতে কোনো মেয়াদ উল্লেখ নেই। কতদিনের জন্য বরাদ্দ দেয়া হচ্ছে, সে বিষয়েও কিছু বলা হয়নি। প্রতি অর্থবছর রাজস্ব পরিশোধ করতে হবে সে বিষয়েও সুনির্দিষ্ট করে বলা হয়নি। বিধি ভেঙে বরাদ্দ দেয়া এলইডি বোর্ডের প্রস্তাবিত ভাড়া সরকার অনুমোদন না করলে পরিশোধ করতে হবে, সেটাও বরাদ্দপত্রে উল্লেখ নেই।
তবে ৩০০ টাকা নন-জুডিশিয়াল স্ট্যাম্পে অঙ্গীকারনামা নেয়া হয়েছে, দুর্ঘটনার দায়দায়িত্ব এবং নতুন করে সরকার নির্ধারিত ভাড়া হিসেবে বকেয়া পরিশোধ করতে বাধ্য থাকবেন। এ অঙ্গীকারনামা থাকলেও তারা সেসব বাস্তবায়নে আগ্রহ দেখাচ্ছেন না।
এ প্রসঙ্গে ডিএসসিসির ১৯টি এলইডি বিলবোর্ডের ইজারাদার এবং মেসার্স জনতা এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী সৈয়দ ওমরান আহমেদ যুগান্তরকে বলেন, ‘নতুন করে ভাড়া ধার্য করায় আমরা আর এলইডি বিলবোর্ড নবায়ন করব না বলে ডিএসসিসিকে জানিয়ে দিয়েছি। এর বেশি কিছু বলতে চাই না।
বাকি বিষয় জানতে ডিএসসিসির সঙ্গে কথা বলুন।’ একই বিষয়ে বেস্ট ওয়ানের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. আল-মামুন যুগান্তরকে বলেন, ‘ডিএসসিসি এলইডি বিলবোর্ডের নতুন করে ভাড়া ধার্য করে চিঠি দিয়েছে। আমি নবায়ন করব বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছি। দ্রুততম সময়ের মধ্যে আমি নতুন করে নির্ধারিত ট্যাক্স পরিশোধ করব।’
কারা ইজারাদার : ডিএসসিসি এক হাজার ৬৭টি এলইডি বিলবোর্ড ইজারা নেয় ১২টি প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে রয়েছে- জি-টেক ৭১টি পুলিশ বক্স, মিডিয়া ভিশন পাঁচটি স্থানে, ভিশন ওয়ার্ল্ড দুটি, অ্যাড ওয়ার্ল্ড ৩টি স্থানে, বৈশাখী ট্রেডার্স ৫০০টি, নূর ট্রেডার্স ১টি, বেস্ট ওয়ান ১টি, টিসিএল অপটোইলেকট্রনিক্স ৪৬১টি, মেসার্স জনতা এন্টারপ্রাইজ ১৯টি, টপটেন মার্ট ১টি, ডিজিটাল টেক লিমিটেড দুটি এবং পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় ১টি।