সরকার আলুর দর পুনর্নির্ধারণ করে দেওয়ার চার দিন পরও রাজধানীসহ দেশের কোথাও সেই নির্ধারিত দরে আলু বিক্রি হচ্ছে না। খোদ সরকারেরই বিপণন প্রতিষ্ঠান ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) গতকাল শুক্রবার তাদের দৈনন্দিন বাজারদরের প্রতিবেদনে জানিয়েছে, এখনো প্রতি কেজি আলু বিক্রি হচ্ছে ৪০ থেকে ৪৫ টাকায়। এই হিসাবে কৃষি বিপণন অধিদপ্তর নির্ধারিত খুচরা দরের চেয়ে তা এখনো কেজিপ্রতি ৫ থেকে ১০ টাকা বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে। শুধু তাই নয়, অভিযোগ রয়েছে—হিমাগারগুলোতেও সরকারনির্ধারিত দরে আলু বিক্রি হচ্ছে না।
তাহলে কাদের স্বার্থে আবার আলু দর পুনর্নির্ধারণ করা হলো? আগের নির্ধারিত দর থেকেই-বা কেন সরে আসা হলো? এসব প্রশ্ন এখন সংশ্লিষ্টদের।
কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মোহাম্মদ ইউসুফ সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, গত কয়েক বছর ধরে আলুচাষি ও ব্যবসায়ীরা আলুর দাম পাননি। এবার চাহিদার কারণে দাম বেড়েছে। আর হিমাগারে রাখা সিংহভাগ আলুই কৃষকের। তাই কৃষকের স্বার্থ বিবেচনা করেই আগের নির্ধারিত দাম থেকে সরে আসা হয়েছে। আলুর দাম বাড়ানো হয়েছে।
কিন্তু আলুর এই বাড়তি দরের কতটুকু সুবিধা পাচ্ছেন প্রান্তিক কৃষকেরা। কিংবা হিমাগারে আদৌ তাদের কোনো আলু আছে কি? সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, হিমাগারে প্রান্তিক কৃষকের খাদ্য হিসেবে বিক্রি করার মতো কোনো আলু নেই। যা আছে তা বীজআলু। কারণ, প্রান্তিক কৃষকেরা এতই গরিব যে, তারা ঋণ করে চাষাবাদ করেন। ফলে নতুন আলু ওঠার পরপরই তা বিক্রি করে দিতে বাধ্য হন। হিমাগার মালিক ও ব্যবসায়ীরা এই আলু কিনে হিমাগারে মজুত রাখেন। দেশে সবচেয়ে বেশি আলু উত্পাদন হয় মুন্সীগঞ্জ জেলায়। আমাদের মুন্সীগঞ্জ প্রতিনিধি বাছির উদ্দিন জুয়েল জানান, জেলায় এবার প্রায় সাড়ে ৩৭ হাজার হেক্টর জমিতে ১৩ লাখ ২৭ হাজার ২৭ মেট্রিক টন আলু উত্পাদন হয়েছে। মুন্সীগঞ্জে সচল ৬৬টি হিমাগারে সংরক্ষিত এসব আলুর বেশির ভাগেরই মালিক ব্যবসায়ীরা। মুন্সীগঞ্জ মুক্তারপুর রিভারভিউ কোল্ডস্টোরেজের ম্যানেজার মো. রেজাউল করিম জানান, এই কোল্ডস্টোরেজে ১ লাখ ৫০ হাজার বস্তা আলু মজুত ছিল। ইতিমধ্যেই ১ লাখ ২ হাজার বস্তা আলু বিক্রি হয়েছে। বর্তমানে ৪৮ হাজার বস্তা আলু মজুত রয়েছে। এর মধ্যে কৃষকের বীজআলু রয়েছে ২০ হাজার বস্তা। বাকি ২৮ হাজার বস্তা ব্যবসায়ীদের আলু।
কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের তথ্য মতে, প্রতি কেজি আলু উত্পাদনে খরচ হয় আট টাকা ৩২ পয়সা। মৌসুমের সময় ক্রয়মূল্য, হিমাগার ভাড়া ও অন্যান্য সব খরচ মিলিয়ে হিমাগার গেটে প্রতি কেজি আলুর দাম পড়ে ১৮ টাকা ৯৯ পয়সা। প্রথমে গত ৭ অক্টোবর হিমাগার পর্যায়ে প্রতি কেজিতে ৪ টাকা মুনাফা ধরে আলুর দাম নির্ধারণ করা হয় ২৩ টাকা। শতাংশের হিসাবে প্রায় ২১ শতাংশ মুনাফা। কিন্তু হিমাগার মালিক ও মধ্যস্বত্বভোগী ব্যবসায়ীরা এই মুনাফায় খুশি নন। তারা আবার গত ২০ অক্টোবর কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের সঙ্গে বৈঠক করে হিমাগার পর্যায়ে আলুর দর পুনর্নির্ধারণ করে। এবার হিমাগার পর্যায়ে প্রতি কেজি আলুর দর নির্ধারণ করা হয় ২৭ টাকায়। অর্থাত্ আগের নির্ধারিত দরের চেয়ে কেজিতে আরো চার টাকা বেশি। এ হিসেবে তাদের মোট মুনাফা দাঁড়ায় কেজিতে আট টাকা। শতাংশের হিসেবে যা ৪২ শতাংশ। যদি শুধু পরের নির্ধারিত অতিরিক্ত মুনাফার হিসাব ধরা হয় তাহলেও শুধু হিমাগার পর্যায়েই ব্যবসায়ীরা ৪০০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন। এই হিসাব শুধু দাম নির্ধারণের পর ১০ লাখ টন আলুর মুনাফার হিসাব করে দেওয়া হয়েছে।
উল্লেখ্য, গত মৌসুমে ১ কোটি ৯ লাখ টন আলু উত্পাদন হলেও হিমাগার মালিকেরা বলেছেন, উত্পাদিত আলুর ৪০ লাখ টন হিমাগারগুলোতে সংরক্ষণ করা হয়েছে। এর মধ্যে দাম নির্ধারণের আগপর্যন্ত ৫৫ শতাংশ আলু হিমাগারগুলো থেকে বের করা হয়েছে। অর্থাৎ তখনো ১৮ লাখ টন আলু হিমাগারে ছিল। এর মধ্যে বীজআলু হিসেবে আট লাখ টন বাদ দিলেও আরো ১০ লাখ টন আলু থাকে।
এই হিসেবে পাইকারি পর্যায়েও নতুন নির্ধারিত দাম অনুযায়ী অতিরিক্ত ৫০০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে একশ্রেণির ব্যবসায়ীরা। একইভাবে খুচরা ব্যবসায়ীরাও অতিরিক্ত প্রায় ১ হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন। সবমিলিয়ে এই সিন্ডিকেট আলু থেকেই কয়েক হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক ইত্তেফাককে বলেছেন, এ বছর আলুর বাড়তি চাহিদার সুযোগ নিচ্ছেন ব্যবসায়ী ও হিমাগার মালিকেরা। তিনি বলেন, এখন তো প্রান্তিক কৃষকের হাতে আলু নেই। আলুর দাম বাড়ায় নিম্ন আয়ের মানুষ, শ্রমিক তাদের অনেক কষ্ট হয়েছে বলে জানান তিনি। এক প্রশ্নের জবাবে কৃষিমন্ত্রী বলেন, সরকার নির্ধারিত দরেই ব্যবসায়ীদের আলু বিক্রি করতে হবে।