মাদকের ভয়াবহতা কমাতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একের পর এক অভিযানে ইয়াবা ও ফেনসিডিল বিক্রি কিছুটা কমে এলেও ছড়িয়ে পড়ছে নিত্য নতুন মাদক। প্রতিদিনই যোগ হচ্ছে মাদকের ধরন ও বিক্রির কৌশল। সম্প্রতি নতুন মাদক আইস বা ক্রিস্টালমেথ আমদানির কারণে কপালে দুশ্চিন্তার ভাঁজ পড়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর। ‘এমডিএমএ’, ‘আইস’ ডিমেথ, মেথান ফিটামিন বা ক্রিস্টালমেথ নামে পরিচিত অত্যন্ত দামি এই মাদক বাজারে ছড়িয়ে পড়ছে। ‘সেন্ট্রাল নার্ভাস সিস্টেম স্টিমুলেটিং ড্রাগস’ নামে পরিচিতি এই মাদক ইয়াবার চেয়ে শতগুণ ক্ষতিকারক বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। অধিক দামে ক্রয় করে এই মাদক সেবনের ফলে ধ্বংস হচ্ছে অভিজাত ও উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তানেরা। গত বছর ২৬ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর মোহাম্মদপুরে ‘আইস’ পিল তৈরি ল্যাবের সন্ধান পায় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর (ডিএনসি)। ওই সময় মাদক তৈরির উপাদান ও কারখানার সন্ধান পাওয়া গেলেও হোতা ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়েছে। ওই সময় গোয়েন্দারা জানতে পারেন, আইসের উৎপত্তিস্থল অস্ট্রেলিয়া, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর ও চীন। জীবনঘাতী এই মাদক ব্যবহার করা হয় মূলত স্নায়ুর উত্তেজনা বাড়াতে। তবে ল্যাবের মালিক ও তৈরির হোতা হাসিব মোহাম্মদ রশিদকে এখনো গ্রেফতার করতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। বুধবার রাতে পুরান ঢাকার গেন্ডারিয়া এলাকায় অভিযান চালিয়ে প্রথমে চন্দন রায় নামে আইস বা ক্রিস্টালমেথ ডিলারকে গ্রেফতার করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। তার দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে গুলশান, বনানী ও ভাটারা এলাকায় অভিযান চালিয়ে আইস বিক্রি, সেবন ও পরিবহনের কাজে জড়িত থাকায় সিরাজ, অভি, জুয়েল, রুবায়েত ও ক্যানিকে গ্রেফতার করা হয়। এ সময় তাদের কাছ থেকে উদ্ধার করা হয় ৬০০ গ্রাম ‘আইস’ বা ‘ক্রিস্টালমেথ’। উদ্ধার হওয়া ওই মাদকের মূল্য প্রায় ৬০ লাখ টাকা। গোয়েন্দা পুলিশ বলছে, মালয়েশিয়া থেকে আমদানি করা আইস মাদক ব্যবসায়ীরা প্রতি ১০ গ্রাম বিক্রি করে থাকে এক লাখ টাকায়, যা রাজধানীর অভিজাত ও উচ্চবিত্তরা ব্যবহার করে থাকেন। প্রতিবার মাদক আইস সেবনে খরচ হয় ১০ থেকে ১২ হাজার টাকা। ধূমপানের মাধ্যমে, ইনজেক্ট করে বা ট্যাবলেট হিসেবে এটা নেওয়া যায়। ব্যয়বহুল এই মাদক অভিজাত শ্রেণির মাদকসেবী ছাড়া সেবন সম্ভব নয়। গতকাল ডিএমপি মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে অতিরিক্ত কমিশনার (ডিবি) এ কে এম হাফিজ আক্তার বলেন, ‘একটি নতুন মাদকের নাম আমরা বেশ কিছু দিন ধরে শুনে আসছিলাম। বাংলাদেশেও এর অস্তিত্ব আছে বলে আমরা খবর পাই। এর পরিপ্রেক্ষিতে ডিবি রমনা বিভাগের ডিসি এইচ এম আজিমুল হক, এডিসি জুয়েল রানা ও এসি জাবেদ ইকবালের নেতৃত্বে বুধবার রাতে গেন্ডারিয়া থেকে প্রথমে চন্দন রায়কে গ্রেফতার করা হয়। পরে তার দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে গ্রেফতার করা হয় আরও পাঁচজনকে।’ তিনি বলেন, ‘১০ গ্রাম আইসের দাম ১ লাখ টাকা। সেবু, ক্রিস্টালমেথ, ডি ম্যাথসহ আইসের আরও নাম রয়েছে। এর কেমিক্যাল নাম মেথান ফিটামিন। গ্রেফতার চন্দন রায় মূল ডিলার। তিনি তার প্রবাসী আত্মীয় শংকর বিশ্বাসের মাধ্যমে বিমানযোগে এগুলো সংগ্রহ করে ঢাকায় খুচরা বিক্রেতাদের মাধ্যমে উচ্চবিত্তদের কাছে বিক্রি করেন। অত্যন্ত দামি এই মাদক ব্যবহারে ক্ষতি অনেক বেশি। এটি সেবনের ফলে মাদকাসক্তরা দীর্ঘ সময় কাজ ও চিন্তা করার স্ট্যামিনা পায় বলে জানায়। দীর্ঘদিন এটি ব্যবহার করলে হৃদরোগ ও স্ট্রোক হয়। এ ছাড়া দাঁত ক্ষয়ে যায়। বাংলাদেশ উন্নয়নের দিকে যাচ্ছে। অভিজাত শ্রেণির লোকের সংখ্যা বাড়ছে। সব মাদকের বাজার তৈরির পেছনে অর্থলগ্নি করা হয়। বাংলাদেশে সেই চেষ্টা চলছে। এই মাদক গুলশান-বনানী এলাকার ইনডোর পার্টি সেন্টারে ব্যবহার করা হয়। এর সঙ্গে জড়িত আরও কয়েকজনের নাম জানা গেছে। তাদের গ্রেফতারের জন্য অভিযান অব্যাহত আছে। এ ঘটনায় মাদক আইনে গেন্ডারিয়া থানায় একটি মামলা করা হয়েছে।’
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ইয়াবার চেয়ে ১০০ গুণ মারাত্মক মাদক ‘আইস’। এটি সেবনে মস্তিষ্ক বিকৃতিসহ মৃত্যুও ঘটতে পারে। এই মাদকের মূল উপাদান মেথা ফেটামিন বিষণœতা থেকে মুক্তি ও প্রাণসঞ্চারে উজ্জীবিত হতে ১৯৫০ সালে ওষুধ হিসেবে ব্যবহৃত হলেও পরে তা বিবর্তিত হয়ে ভয়ংকর মাদকে রূপ নেয়। ইন্দ্রিয় অনুভূতি, সাহস ও শক্তি বৃদ্ধির পাশাপাশি যৌন উত্তেজনা বাড়াতে এই মাদক পরিচিতি পেলেও এর ক্ষতিকর দিকই বেশি বলে জানা গেছে। এই মাদক সেবনে অনিদ্রা, অতিরিক্ত উত্তেজনা, স্মৃতিভ্রম, অতিরিক্ত ঘাম হওয়া, শরীরে চুলকানিসহ নানা রোগ দেখা দেয়। ধোঁয়ার মাধ্যমের চেয়ে ইনজেকশনের মাধ্যমে এ মাদক নিলে মাত্র ১৫ থেকে ৩০ সেকেন্ডের মধ্যে এর কার্যক্রম শুরু হয়। আর এমন পরিস্থিতিতে যে কোনো কর্মকান্ড ঘটাতে দ্বিধা করে না এই মাদক গ্রহণকারীরা।
১৮৮৭ সালে জার্মানিতে মেথা ফেটামিনের উৎপত্তি ঘটে। পরে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এর বিবর্তনের মাধ্যমে জাপানি সৈন্যদের, বিশেষ করে যুদ্ধবিমানের চালকদের অনিদ্রা, উত্তেজিত ও নির্ভয় রাখার জন্য ব্যবহার শুরু হয়। ১৯৬০ সালে এর অপব্যবহার বেড়ে যায়। ১৯৭০ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সরকার মেথা ফেটামিনের ব্যবহার নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। পরে ১৯৯০ সালে মেক্সিকোর মাদক ব্যবসায়ীরা বিবর্তনের মাধ্যমে মাদক হিসেবে এটি ছড়িয়ে দেয় আমেরিকা, ইউরোপ, চেক রিপাবলিক ও এশিয়াসহ পৃথিবীব্যাপী। ২০১০ সালের একটি প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ওই বছর অস্ট্রেলিয়ায় মাদক হিসেবে এর ব্যবহার অনেক বেড়ে যায়। এশিয়ার দেশের মধ্যে সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, মিয়ানমার ও চীনে এর ব্যবহার রয়েছে ব্যাপক।