পরিবর্তনের আশায় বিশ্ব

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে তুমুল লড়াইয়ের পর ঐতিহাসিক জয় পেয়েছেন জো বাইডেন। বিজয়ের প্রথম ভাষণে তিনি বিশ্বকে শুনিয়েছেন ‘বিভক্তি নয় ঐক্যের বারতা’। গত চার বছর ডোনাল্ড ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রকে যে বিভক্তির পথে নিয়ে গেছেন, প্রথম ভাষণে যেন তারই জবাব দিলেন বাইডেন। ট্রাম্প ‘যুক্তরাষ্ট্র শ্রেষ্ঠ’ নীতির নাম করে চলেছেন ‘একলা চলো’ নীতিতে আর বাইডেন চলতে চাইছেন সবাইকে নিয়ে। এ কারণেই হয়তো মার্কিন মুল্লুকের পাশাপাশি বাইডেনে আশা দেখছে অন্যান্য দেশওযুক্তরাষ্ট্র প্রভাবশালী দেশ হওয়ায় দেশটির মসনদে কে বসছেন এর প্রভাব গোটা বিশ্বে পড়ে। এর মধ্য দিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্য থেকে শুরু করে বিশ্ব-রাজনীতিতে মেরুকরণ হয়। বিশেষ করে ট্রাম্পের মতো প্রেসিডেন্ট চার বছর দেশ শাসনের পর নতুন কোনো প্রেসিডেন্ট ক্ষমতায় এলে সেই পরিবর্তন অপরিহার্য হয়ে পড়ে। ইতোমধ্যে জো বাইডেন ঘোষণা দিয়েছেন- ক্ষমতায় আসার পর প্রথম দিকে যে বিষয়গুলোতে হাত দেবেন সেগুলো হলো- করোনা ভাইরাস নিয়ন্ত্রণ, প্যারিস জলবায়ু চুক্তিতে ফেরা এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থায় (ডব্লিওএইচও) যোগ দেওয়া। এ তিনটি ইস্যুতেই ডোনাল্ড ট্রাম্প উল্টোপথে হেঁটেছেন। কাজেই বাইডেন ক্ষমতা হাতে নেওয়ার পর তার সামনে করণীয় হিসেবে এ বিষয়গুলো সুরাহা করা। এ ছাড়া গত মাসে নির্বাচনী প্রচারে বাইডেন বলেছিলেন- নির্বাচিত হলে প্রথম দিনেই মুসলিম দেশগুলোর ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করবেন তিনি। বাইডেন বলেছিলেন, আমার প্রশাসন প্রতিটি স্তরেই মুসলিম আমেরিকানদের অবদান দেখতে চাইবে। হোয়াইট হাউসে প্রথম দিনই আমি ট্রাম্পের অসাংবিধানিক মুসলিম নিষেধাজ্ঞার পরিসমাপ্তি ঘটাব। এবার তার সেই প্রতিশ্রুতি পূরণ করার পালা। প্রসঙ্গত, ২০১৭ সালে ক্ষমতায় এসে কিছু দিনের মধ্যে ডোনাল্ড ট্রাম্প ১৩টি মুসলিম দেশের নাগরিকদের ওপর যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন। এতে মুসলিমদের ওপর তার বিদ্বেষনীতি প্রকট হয়

এদিকে বাইডেনের জয়ে আরব বিশ্বে দেখা গেছে বাড়তি আশা। ফিলিস্তিনিরা উল্লাস প্রকাশ করেছেন। প্রথম ভাষণে বাইডেন বলেছেন, ‘এখন সময় নিরাময়ের’। এতে আরব বিশ্ব মনে করছে চার বছর ট্রাম্প কয়েকটি আরব দেশের ওপর যে ‘সর্বোচ্চ চাপ’ প্রয়োগ করেছেন বাইডেনের শাসনামলে তা লাঘব হবে। আরব দুনিয়ায় ট্রাম্প সবচেয়ে বিতর্কিত সিদ্ধান্তটি নিয়েছেন ফিলিস্তিনিদের ওপর। সেখানে জেরুজালেমকে ইসরায়েলের রাজধানী ঘোষণা করেন। সেই সময় মুসলিম বিশ্ব তো বটেই যুক্তরাষ্ট্রের অনেক মিত্র দেশও ট্রাম্পের এ সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেছিলেন। তবে ট্রাম্পের আগে মার্কিন প্রশাসনগুলো জেরুজালেম ইস্যুতে দ্বি-রাষ্ট্রনীতি অবলম্বন করেছে। এ বিষয়ে বাইডেন নাটকীয় সিদ্ধান্ত নিলেও নিতে পারেন বলে বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যে ট্রাম্পের আরেক শিকার ছিল ইরান। ক্ষমতায় আসার পর বহুল আলোচিত পারমাণবিক চুক্তি থেকে বেরিয়ে যান ট্রাম্প। এ বিষয়ে বাইডেনের অবস্থান হলো ইরানের সঙ্গে যৌক্তিক অবস্থানে যাওয়া। অন্যদিকে নির্বাচনী লড়াইয়ে বাইডেন যখন জয়ের পথে সেই সময়ই ইরানের প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানি ‘যুক্তরাষ্ট্রের পরবর্তী প্রেসিডেন্টকে চুক্তি অনুযায়ী প্রতিশ্রুতিতে ফেরার আহ্বান’ জানিয়েছেন।

বিবিসির বিশ্লেষণে বলা হয়, অনেকে মনে করতে পারেন নির্বাচনে ট্রাম্পের পরাজয়ে কিছুটা খুশি বেইজিং। কেননা চার বছর চীনের সঙ্গে ট্রাম্প যে ‘বাণিজ্যযুদ্ধ’সহ নানা দ্বন্দ্বে জড়িয়েছেন এতে তা মনে করাই স্বাভাবিক। কিন্তু কিছু বিশ্লেষক মনে করছেন, বাইডেন জিতে যাওয়ায় বরং অখুশিই হয়েছে বেইজিং। এর পক্ষে যুক্তি হিসেবে বলা হয়েছে- নিজ দেশে বিভক্তি সৃষ্টিকারী, বিদেশে বিচ্ছিন্নতাবাদী ট্রাম্পকে বিশ্বে মার্কিন আধিপত্যের পতন হিসেবে দেখত বেইজিং।

বাইডেন জয়ী হওয়ায় কি ভারতের সঙ্গে মার্কিন সম্পর্কের কোনো পরিবর্তন আসবে? কেননা কট্টর ট্রাম্পের সঙ্গে কট্টর মোদির একটা ভালো রসায়ন ছিল। বাইডেনে কি মোদি প্রশাসন কিছুটা অস্বস্তিতে পড়তে পারে? তবে ভারত-মার্কিন সম্পর্ক বেশ পুরনো। প্রতিরক্ষা খাত থেকে বেশ কিছু বিষয়ে রয়েছে দুই দেশের মধ্যে জোরালো সম্পর্ক। কাজেই দিল্লি হয়তো বাইডেনের চাপে পড়বে না।

জো বাইডেনকে এক সময় উত্তর কোরিয়া ‘পাগলা কুকুর’ বলে মন্তব্য করেছিল। এবার নিশ্চয়ই পিয়ংইয়ং সতর্ক হবে। কেননা ট্রাম্প ক্ষমতায় এসে প্রথম মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং উনের সঙ্গে দুবার বৈঠক করেন। যদিও বৈঠকের ফল তেমন আশাপ্রদ নয়। তার পরও ট্রাম্পের আমলে বিষয়টি আলোচিত ইস্যু। বাইডেন হয়তো এ পথে হাঁটবেন না।

ট্রাম্প যেসব বিশ্বনেতাদের আস্থাভাজন হয়েছিলেন তার মধ্যে যুক্তরাজ্যের ব্রেক্সিটপন্থি প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন অন্যতম। অনেক ইউরোপীয় নেতাকে ট্রাম্প ‘দুর্বল’ মনে করলেও জনসনের প্রশংসা করেছেন তিনি। এ ছাড়া ভাইস প্রেসিডেন্ট থাকার সময় বাইডেন স্পষ্ট বলেছিলেন তারা ব্রেক্সিটের পক্ষে নন। কাজেই জনসন-বাইডেন বন্ধুত্ব অতটা গাঢ় না-ও হতে পারে। যদিও বিশ্ব রাজনীতিতে মার্কিন-ব্রিটেন বন্ধুত্ব ‘চিরদিনের’। এদিকে নির্বাচনের কিছুদিন আগে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি হিসেবে রাশিয়ার ওপর দোষ চাপিয়েছিলেন বাইডেন। তা হলে এবার হয়তো ওয়াশিংটন-মস্কো সম্পর্ক আরও শীতল হয়ে পড়বে। মার্কিন নির্বাচনে বাইজেনের জয়ের কারণে ইউরোপের দেশ জার্মানি হয়তো বেশ স্বস্তি পেয়েছে। কেননা জার্মানির মাত্র ১০ শতাংশ মানুষ ট্রাম্পের বিদেশ নীতির ওপর আস্থা রাখতেন। বাইডেনের জয়ের ফলে প্রতিবেশী দেশ কানাডার সম্পর্ক ভালো হবে। কারণ ওবামা প্রশাসনের সঙ্গে জাস্টিন ট্রুডোর রয়েছে আন্তরিক ঘনিষ্ঠতা। যদিও ট্রাম্প আমলে কানাডার সঙ্গে সম্পর্ক কঠিন হয়ে পড়েছিল। সব মিলিয়ে বাইডেনের জয়ের কারণে বিশ্ব পরিবর্তন আশা করছে। সব জায়গায় পরিবর্তন না হলেও যেসব জায়গায় ট্রাম্প বেশি খামখেয়ালি করেছেন সেসব ইস্যুতে বাইডেন কেমন পদক্ষেপ নেন- আপাতত সেটিই দেখার বিষয়।

আন্তর্জাতিক শীর্ষ সংবাদ