মোবাইল অপারেটর রবির সঙ্গে একীভূত হওয়ার পর এয়ারটেলের নামে বরাদ্দকৃত স্পেকট্রামের (তরঙ্গ) মেয়াদ শেষ হওয়ার পর আগামী মাসে তা নবায়ন করতে হবে। এই নবায়নের ফির ওপর ১৫ শতাংশ হিসেবে ৫ কোটি ৪০ লাখ ডলার বা ৪৬০ কোটি টাকার ভ্যাটও আদায় হওয়ার কথা। অতীতে মোবাইল ফোন কোম্পানিগুলো নানা কায়দায় সরকারের বিপুল অঙ্কের টাকা ঝুলিয়ে রেখেছে বলে অভিযোগ। এবার তরঙ্গ নবায়নের আগেই সতর্ক জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। ফলে তরঙ্গ নবায়নের ফি পরিশোধকালে সরকারের ৪৬০ কোটি টাকা ভ্যাটের (মূল্য সংযোজন কর) অর্থ আদায় না হলে আটকে যেতে পারে রবির তরঙ্গ নবায়ন।
ইস্যুটি নিয়ে ইতিমধ্যে তরঙ্গ নবায়নকারী কর্তৃপক্ষ বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনকে (বিটিআরসি) চিঠি পাঠিয়েছে এনবিআরের বৃহত্ করদাতা ইউনিট (এলটিইউ-ভ্যাট)। চিঠিতে ভ্যাটের টাকা জমা নিশ্চিত করেই কেবল রবিকে (এয়ারটেলের জন্য) তরঙ্গ বরাদ্দ ও সচল করার জন্য বলেছে। শুধু তাই নয়, এর আগে এনবিআরের পাওনা আদায় না করে কেবল নিজেদের অর্থ আদায় করায় বিটিআরসির দিকে অভিযোগের আঙুল তুলেছে এনবিআরের ভ্যাট আদায়কারী এই প্রতিষ্ঠান। এলটিইউ-ভ্যাটের কমিশনার ওয়াহিদা রহমান চৌধুরীর পাঠানো চিঠিতে বলা হয়, এনবিআরের পাওনা আদায় না করে বিটিআরসির নিজস্ব অর্থ গ্রহণ করা আইনানুগ ছিল না। এখন প্রতিষ্ঠানগুলো আইনি জটিলতা সৃষ্টি করছে। যদি বিটিআরসি তাদের সেবামূল্য পরিশোধকালে পাওনা রাজস্ব আদায় করত, তাহলে এ ধরনের পরিস্থিতি তৈরি হতো না।
এনবিআর কর্মকর্তারা বলছেন, বিদ্যমান ভ্যাট আইন অনুযায়ী, যে কোনো ধরনের ফি আদায়কালে ভ্যাটের অর্থ উৎস কর্তনের বিধান রয়েছে। কিন্তু অতীতে মোবাইল ফোন কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে এ ধরনের ফি আদায়কালে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এনবিআরের প্রাপ্য রাজস্ব আদায় করেনি বিটিআরসি। পরবর্তী সময়ে ঐ টাকা আদায়ের উদ্যোগ নেওয়া হলে তা নিয়ে দেখা দেয় জটিলতা। আইনি জটিলতায় পড়ে কোম্পানিগুলোর কাছে পাঁচ থেকে ১০ বছর ধরে আটকে রয়েছে সরকারের হাজার হাজার কোটি টাকার রাজস্ব।
নবিআর কর্মকর্তারা বলছেন, বিদ্যমান ভ্যাট আইন অনুযায়ী, যে কোনো ধরনের ফি আদায়কালে ভ্যাটের অর্থ উৎস কর্তনের বিধান রয়েছে। কিন্তু অতীতে মোবাইল ফোন কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে এ ধরনের ফি আদায়কালে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এনবিআরের প্রাপ্য রাজস্ব আদায় করেনি বিটিআরসি। পরবর্তী সময়ে ঐ টাকা আদায়ের উদ্যোগ নেওয়া হলে তা নিয়ে দেখা দেয় জটিলতা। আইনি জটিলতায় পড়ে কোম্পানিগুলোর কাছে পাঁচ থেকে ১০ বছর ধরে আটকে রয়েছে সরকারের হাজার হাজার কোটি টাকার রাজস্ব।
অবশ্য ভ্যাট আদায় না করার বিষয়ে একটি ব্যাখ্যা রয়েছে বিটিআরসির। ভ্যাট আদায় করতে হলে নতুন ভ্যাট আইন অনুযায়ী আদায়কারী প্রতিষ্ঠানের ভ্যাট নিবন্ধন নম্বর থাকতে হবে। কিন্তু বিটিআরসি সরকারি রেগুলেটরি প্রতিষ্ঠান হওয়ায় তাদের ভ্যাট নিবন্ধন নম্বর নেই। ফলে বিটিআরসি এনবিআরের ভ্যাট আদায় করতে চাইছে না। গত ফেব্রুয়ারিতে বিটিআরসি এক চিঠিতে এনবিআরকে জানিয়েছিল, তারা কেবল তাদের পাওনা আদায় করবে। আর ভ্যাটসংক্রান্ত ইস্যুতে এনবিআর ব্যবস্থা নেবে।
বিটিআরসির ভাইস চেয়ারম্যান সুব্রত রায় মৈত্র ইত্তেফাককে বলেন, এক্ষেত্রে ভ্যাট আইনকে প্রাধান্য দিতে হবে। আইন অনুযায়ী আমাদের (বিটিআরসি) ভ্যাট নিবন্ধন নেই। সেক্ষেত্রে আমরা ভ্যাট নিতে পারব না। বিষয়টি আমরা এনবিআরকে জানিয়েছি। আমাদের যেহেতু নিবন্ধন নেই, আমরা কীভাবে দেব—তারা পরামর্শ দিক। নিবন্ধন না থাকায় এই অর্থ আদায়ে জটিলতা তৈরি হতে পারে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এখন তারাই বলুক আমরা কী করব। আইনের বাইরে তো কেউ না।
তবে এনবিআর বলছে, বিদ্যমান ভ্যাট আইন অনুযায়ী এই অর্থ আদায়কালে উৎসে
ভ্যাট কাটতে হবে। এনবিআর সদস্য (ভ্যাট নীতি) মাসুদ সাদিক ইত্তেফাককে বলেন, আইন অনুযায়ী বিটিআরসিকে উৎস ভ্যাট আদায় করতে হবে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, মোবাইল ফোন কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে উৎস ভ্যাট আদায়ের বিষয়ে আইনের ব্যাখ্যা দিয়ে ইতিমধ্যে বিটিআরসিকে চিঠি পাঠিয়েছে এনবিআর। ঐ চিঠিতে ২০১২ সালের ভ্যাট আইনের বিস্তারিত ব্যাখ্যা দিয়ে বলা হয়, সরকারি, আধাসরকারী, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান এবং স্থানীয় কর্তৃপক্ষ লাইসেন্স প্রদান বা নবায়নকালে সুবিধা গ্রহণকারীর কাছ থেকে প্রাপ্ত সব অর্থের ওপর ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট কর্তন করতে হবে। এছাড়া প্রদত্ত লাইসেন্স, রেজিস্ট্রেশন, পারমিটে উল্লেখিত শর্তের আওতায় রাজস্ব বণ্টন, রয়্যালিটি, কমিশন, চার্জ, ফি বা অন্য কোনোভাবে প্রাপ্ত সব অর্থের ওপর ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট কর্তন করতে হবে। অর্থাৎ আইনের বিধান অনুযায়ী উৎস কর্তনকারী স্বত্বা হিসেবে বিটিআরসি ভ্যাট কর্তন করতে হবে বলে সাফ জানিয়ে দেওয়া হয় এনবিআরের পক্ষ থেকে।
এনবিআরের ভ্যাট বিভাগের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে ইত্তেফাককে বলেন, ভ্যাট নিবন্ধন নম্বর নেই বলে ভ্যাটের অর্থ আদায় করা যাবে না বলে বিটিআরসির ব্যাখ্যা যৌক্তিক নয়। তারা সরকারি প্রতিষ্ঠান বা রেগুলেটরি প্রতিষ্ঠান। একইভাবে বিআরটিএ, নৌ পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন বিভাগ, আরজেএসসি (যৌথ মূলধ্বনি কোম্পানি ও ফার্মগুলোর নিবন্ধক), বিআরটিসিও (বাংলাদেশ সড়ক যোগাযোগ করপোরেশন) রেগুলেটরি প্রতিষ্ঠান। তারা তো ভ্যাট আদায় করে সরকারের কোষাগারে জমা দিচ্ছে। তারা ভ্যাট আদায় করলে একই ধরনের প্রতিষ্ঠান হয়ে বিটিআরসি কেন করবে না? তারা যে ফি নিচ্ছে, তার ওপর ভ্যাট আদায় করবে।
সরকারি প্রতিষ্ঠান হয়েও সরকারের ভ্যাট নিবন্ধন না থাকার অজুহাতে সরকারের রাজস্ব আদায়ে অনীহায় বিটিআরসির ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। অতীতের ন্যায় এবারও কোনো না কোনো অজুহাতে সরকারের বিপুল পরিমাণ রাজস্ব ঝুলে যায় কি না, তা নিয়েও উদ্বেগ তৈরি হয়েছে।
এদিকে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, ভ্যাট আদায় করবে না বলে ইতিমধ্যে মোবাইল ফোন অপারেটরদেরও চিঠি দিয়ে জানিয়ে দিয়েছে বিটিআরসি। ভ্যাট নিবন্ধন নেই—এমন অজুহাতে সরকারের বিপুল অঙ্কের টাকা আদায় করতে বিটিআরসির অনীহায় মোবাইল ফোন কোম্পানিগুলো সুযোগ নিতে পারে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
যোগাযোগ করা হলে রবির চিফ করপোরেট অ্যান্ড রেগুলেটরি অফিসার সাহেদ আলম ইত্তেফাককে বলেন, যে সেবার ওপর ভ্যাট প্রযোজ্য আইনগতভাবে আমরা তা দিতে বাধ্য। তবে ভ্যাট প্রদানকালে মূসক চালান (ভ্যাট রিসিপ্ট) পাওয়ার আইনগত অধিকারও আমাদের রয়েছে। ভ্যাট প্রদানের সঙ্গে সঙ্গে যেন যথাযথ ভ্যাট চালান দেওয়া হয়।