কোভিড-১৯ প্রতিরোধে টিকার প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি, কার্যকারিতা, পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া, মনস্তাত্বিক সংকট ইত্যাদি নানা বিষয় নিয়ে আলোচনা ও সমালোচনা চলছে। এসব মাথায় রেখেই সরকার কোভিড-১৯ এর বিস্তার রোধে আগামীকাল ২৭ জানুয়ারি ঢাকায় টিকাদান কর্মসূচি শুরু করতে যাচ্ছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভার্চুয়ালি উপস্থিত থেকে রাজধানীর কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে টিকাদান কর্মসূচির উদ্বোধন করবেন। প্রথমে একজন নার্সকে টিকা দেয়ার মাধ্যমে এ কর্মসূচি উদ্বোধন করা হবে। এদিন বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে সম্মুখসারির কোভিড যোদ্ধাদের (যেমন; নার্স, চিকিৎসক, সহকারী স্বাস্থ্যকর্মী, বীর মুক্তিযোদ্ধা, পুলিশ ও সেনাসদস্য এবং সাংবাদিকসহ) মধ্যে থেকে ২০ থেকে ২৫ জনকে টিকা দেয়া হবে। ঢাকার পাঁচটি কেন্দ্রে টিকা দেয়া হবে ২৮ জানুয়ারি, বৃহস্পতিবার।
টিকাদানের জন্য নির্ধারিত ঢাকার কেন্দ্রগুলো ঘুরে দেখা যায়, সংশ্লিষ্ট ইউনিটের প্র¯ুÍতি, তালিকা প্রণয়ন এবং চিকিৎসক ও নার্সদের প্রশিক্ষণ ইতোমধ্যেই সম্পন্ন হয়েছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর কর্তৃপক্ষ জানায়, আগামীকাল কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে কোভিড-১৯ টিকাদান কর্মসূচি উদ্বোধনের জন্য সার্বিক প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে। এছাড়া, ২৮ জানুয়ারি যে পাঁচটি কেন্দ্রে টিকা দেয়া হবে সেগুলোও প্রস্তুত করা হয়েছে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) এবং ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল সরেজমিন পরিদর্শনে দেখা যায়, কোভিড-১৯ টিকাদান কর্মসূচিকে সামনে রেখে চলছে শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ)-এর পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ডা. জুলফিকার আহমেদ আমিন বাসস’কে জানান, ২৮ তারিখে কোভিড-১৯ টিকাদান কর্মসূচি পরিচালনার জন্য প্রশিক্ষিত জনবল প্রস্তুত করা, স্থান নির্ধারণ ও প্রাথমিক তালিকা প্রণয়নের কাজ ইতিমধ্যেই সম্পন্ন হয়েছে।
তিনি জানান, বিএসএমএমইউ-এর কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন সেন্টার স্থাপন করা হয়েছে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের মোড়ে। এ সেন্টারে মোট আটটি বুথ স্থাপন করা হয়েছে। এই বুথের প্রত্যেকটিতে দু’জন নার্স ও চারজন করে ভলান্টিয়ার দায়িত্বে থাকবেন। এছাড়া, দুটি মেডিকেল টিম, যার একটি ভ্রাম্যমান থাকবে, যাতে কোথাও কারো কোন অসুবিধা হলে দ্রুত সেখানে উপস্থিত হতে পারে। আরেকটি মেডিকেল টিম বুথের পাশেই সার্বক্ষণিক অবস্থান করবে। টিকা নেয়ার পর কোন ব্যক্তির শারিরীক কোন অসুবিধা হলে এই টিম তাৎক্ষণিক স্বাস্থ্যসেবা দিতে প্রস্তত থাকবে। এছাড়াও, টিকা পরবর্তী যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবেলায় ৮ শয্যার একটি পর্যবেক্ষণ ইউনিট ও ৪ টি ভেন্টিলেশন সেন্টার স্থাপন করা হয়েছে। টিকাদান কেন্দ্রে একটি এম্বুলেন্স সার্বক্ষণিক নিয়োজিত থাকবে। কোনো ব্যক্তিকে টিকা দেয়ার পর কমপক্ষে আধঘন্টা নিবিড় পর্যবেক্ষণে রাখা হবে। পরবর্তীতে কোনো অসুবিধা হলেও টিকাদানকারী কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
ব্রি, জে. ডা. আহমেদ আমিন বলেন, ২৮ তারিখে বিএসএমএমইউ-এর নিজস্ব জনবলের মধ্যে থেকে ২০০ জনকে আগ্রহের ভিত্তিতে টিকা দেয়া হবে। পরে পর্যায়ক্রমে হাসপাতালের সব স্টাফকে টিকার আওতায় আনা হবে।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল (ডিএমসিএইচ)-এর পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. নাজমুল হক বাসসকে বলেন, ‘২৮ তারিখে ডিএমসিএইচ-এ প্রথম দিন টিকা দেয়ার জন্য চারটি বুথ স্থাপন করা হয়েছে। এর মধ্যে দুটো বুথ থাকবে আমাদের পুরুষ স্টাফদের জন্য। আর দুটো বুথ থাকবে নারী স্টাফদের জন্য। আমরা আশা করছি, ঐদিন ডাক্তার, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মী, ডেইলি লেবার, ক্লিনারসহ বিভিন্ন পর্যায়ের স্টাফদের মধ্যে থেকে ১০০ জনকে টিকা দেব। পরে পর্যায়ক্রমে সব স্টাফকে তাদের আগ্রহের ভিত্তিতে টিকা দেয়া হবে।’
টিকা দেয়ার সার্বিক প্রস্ততির প্রায় সম্পন্ন হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এখন শেষ মুহূর্তের কাজ বাকি আছে। ২৭ তারিখের মধ্যে এসব সম্পূর্ণ প্রস্তত হয়ে যাবে। ২৭ তারিখে কেউ দেখতে চাইলে আমরা দেখাবো।
যাদের টিকা দেয়া হবে
কোভিড-১৯ এর টিকা নিয়ে সাধারণ মানুষের মনে কোন দ্বিধা বা সংশয় যাতে না তৈরি হয় সেজন্য টিকাদানকারী কর্তৃপক্ষ প্রথমদিন যারা টিকা নিতে আগ্রহী শুধু তাদের তালিকা প্রস্তত করছে।
ব্রি. জে. ডা. আহমেদ আমিন বলেন, ‘যারা টিকা নিতে আসবেন, তাদের প্রত্যেককে টিকা গ্রহণের আগে একটি সম্মতিপত্র পূরণ ও স্বাক্ষর করতে হবে। এতে প্রাথমিকভাবে ঐ ব্যক্তির সাধারণ ব্যক্তিগত তথ্য ছাড়াও তার শারীরিক অবস্থার তথ্য উপস্থাপন করতে হবে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নির্দেশনা অনুযায়ী যারা টিকা দেয়ার উপযুক্ত বলে গণ্য হবেন তাদের টিকা দেয়া হবে।’
টিকা গ্রহণে অন্যদের উদ্বুদ্ধ করার জন্য প্রথমদিন উপাচার্য, উপ-উপাচার্য এবং পরিচালক টিকা গ্রহণ করবেন। তবে, টিকা প্রদানে স্টাফদের সবার মধ্যে সমতা রক্ষার জন্য প্রথম দিন সব পর্যায়ের স্টাফদের মধ্যে থেকে ব্যক্তি নির্বাচন করে টিকা দেয়া হবে। এদিন মোট ৫০০ জনকে টিকা দেয়ার পরিকল্পনা রয়েছে বলে তিনি জানান।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর কার্যালয় সুত্র জানায়, সারাদেশে একযোগে টিকা গ্রহনে আগ্রহীদের তালিকা প্রণয়নের কাজ চলছে। আগামী ২৮ জানুয়ারি টিকাদান কর্মসূচি উদ্বোধনের পর প্রায় এক সপ্তাহ বিরতি দিয়ে ইপিআই-এর জাতীয় টিকাদান কর্মসূচির আওতায় সারাদেশে একযোগে কর্মসূচি পরিচালনা করা হবে। এ সময়ের মধ্যে তালিকাগুলো সম্পূর্ণ হবে বলে আশা করছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাগণ।
কর্মসূচির সফল ও যথাযথ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা অনলাইন নিবন্ধনের জন্য ইতিমধ্যেই ‘সুরক্ষা’ নামে একটি অ্যাপ তৈরি করেছে। টিকা পেতে আগ্রহীদের সুরক্ষা প্ল্যাটফর্মের ওয়েব অ্যাপ্লিকেশনে (িি.িংঁৎড়শশযধ.মড়া.নফ) গিয়ে অথবা মোবাইলে অ্যাপ ডাউনলোড করে নিবন্ধন করতে হবে। স্মার্ট ফোন ব্যাবহারকারীরা িি.িংঁৎড়শশযধ.মড়া.নফ ওয়েব পোর্টাল থেকে এই মোবাইল অ্যাপটি ডাউনলোড করে কোভিড-১৯ এর টিকার জন্য নিবন্ধন করতে পারবেন। ‘রিয়েল টাইম’ অ্যাপটি ফ্রি ডাউনলোড করা যাবে। নিবন্ধনের পর টিকা গ্রহণের তারিখ, সময় ও স্থান অ্যাপের মাধ্যমেই জানা যাবে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আগামীকাল কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে আয়োজিত কোভিড-১৯ টিকাদান কর্মসূচির উদ্বোধনকালে ‘সুরক্ষা’ অ্যাপটিও উদ্বোধন করবেন। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি অধিদপ্তরের প্রোগ্রামারদের নিজস্ব উদ্যোগ ও ব্যবস্থাপনায় কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম ‘সুরক্ষা’ সফটওয়্যারটি ব্যবহারের জন্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কাছে ইতিমধ্যেই হস্তান্তর করা হয়েছে।
টিকাদান কেন্দ্র স্থাপন
ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে সারাদেশে একযোগে টিকাদান কর্মসূচি শুরু করার প্রস্ততি হিসেবে টিকাদান কেন্দ্র স্থাপনের কাজও একযোগে চলছে বলে জানায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর কার্যালয় সূত্র। ২৮ জানুয়ারি ঢাকার যেসব কেন্দ্রে টিকাদান কর্মসূচি শুরু হবে এগুলোসহ ঢাকাতেই প্রায় ৩০০ কেন্দ্রে টিকা দানের পরিকল্পনা রয়েছে বলে সূত্র জানায়। টিকা প্রাপ্তি সাপেক্ষে সারাদেশে জেলা ও উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোকেও টিকাদান কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করা হবে।
কোভিড -১৯ টিকাদান কর্মসূচি পরিচালনার জন্য একটি দক্ষ জনবল তৈরিতে কাজ করছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। এজন্য টিকা প্রদানের সার্বিক প্রস্ততির অংশ হিসেবে চিকিৎসক থেকে শুরু করে সারাদেশে তৃণমূল পর্যায়ের স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছে।
ইপিআই কার্যালয় সুত্রে জানা যায়, গত ১২ ডিসেম্বর থেকে কোভিড-১৯ টিকাদানের প্রস্ততি স্বরূপ দক্ষ জনবল তৈরিতে সারাদেশে প্রশিক্ষণ শুরু করা হয়। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর টিকাদান প্রশিক্ষণের জন্য কোভিড-১৯ টিকাদান সহায়িকা প্রকাশ করেছে।
জরুরি অবস্থার প্রস্তুতি
কোভিড-১৯ এর টিকার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থাকতে পারে ধরে নিয়ে প্রস্ততি নিচ্ছে দেশের টিকাদানকারী কর্তৃপক্ষ।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল (ডিএমসিএইচ)-এর পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. নাজমুল হক বলেন, টিকা গ্রহণের ফলে কি ধরনের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া হয় দেখার জন্য টিকা দেয়ার পর আধা ঘন্টা তাদের নিবিড় পর্যবেক্ষণে রাখা হবে। ইপিআই কার্যক্রমের অংশ হিসেবেই প্রত্যেক টিকাদান কেন্দ্রে পর্যবেক্ষণ টিম থাকবে। এই টিম তাৎক্ষণিক কোনো জরুরি পরিস্থিতি তৈরি হলে সেবা প্রদান করবে।
তিনি জানান, হাসপাতালের নিয়মিত কার্যক্রম অব্যাহত রেখেই প্রশিক্ষিত জনবল দিয়ে টিকাদান কেন্দ্র পরিচালনার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে কর্তৃপক্ষ। প্রত্যেক টিকাদান কেন্দ্রের জন্য প্রশিক্ষিত চিকিৎসক ও নার্স ছাড়াও স্বেচ্ছাসেবী থাকবে। বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি এই স্বেচ্ছাসেবী সরবরাহ করবে।
সারাদেশে কোভিড-১৯ টিকাদান কর্মসূচির সফল বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে সরকার জনসচেতনতা তৈরিতে বিভিন্ন কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। ইতিমধ্যে সরকার সংবাদপত্র, টেলিভিশন ও রেডিওতে সচেতনতামূলক প্রচারণা চালাচ্ছে। বিভিন্ন স্থানে লিফলেট ও পোস্টার বিতরণের ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। সরকার জনসচেতনতা বৃদ্ধির জন্য বেসরকারি সংগঠনগুলোকেও ইতিমধ্যে যুক্ত করেছে।
বাংলাদেশ এনজিও নেটওয়ার্ক ফর রেডিও এন্ড কমিউনিকেশন (বিএনএনআরসি)’র চিফ এক্সিকিউটিভ অফিসার এএইচএম বজলুর রহমান বাসসকে বলেন, আমরা ‘কোভিড-১৯’ টিকা নিয়ে অপপ্রচার রোধে কাজ করছি। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সহায়তায় ‘বাংলাদেশে কোভিড-১৯ এর টিকাদান বিষয়ক সচেতনতা সৃষ্টি ও অপপ্রচার প্রতিরোধ কার্যক্রম’ পরিচালনা করছি। সারাদেশে কমিউনিটি রেডিও এ কার্যক্রমে অংশ নিচ্ছে।